মতামত

ইমরানের সাজা ও সামরিক শাসক কেন আমেরিকার

ইমরান খান পাকিস্তানের গণতন্ত্রকে অস্থিতিশীল করেছেন। সে দেশের সংবিধানের আর্টিকেল ৫ অনুযায়ী, দেশের সকল নাগরিককে সংবিধান মানতে হবে। তিনি সেটা মানেননি। তাদের সংবিধাননে স্পষ্ট করে বলা আছে, কেউ যদি সংবিধান না মানে, এবং সেই না মানার কাজে সহযোগিতা করে- তাহলে তাদের প্রত্যেকের কাজকে সে দেশের সংবিধানের আর্টিকেল ৬ এর (১) এবং (২ ) অনুযায়ী রাষ্ট্রের সঙ্গে বড় মাপের বিশ্বাসঘাতকতা ( High Treason) বলে চিহ্নিত হবে। এই বড় মাপের বিশ্বাসঘাতকতা বা সংবিধানকে অমান্য করার কাজকে কোন কোর্ট, এমনকি হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্ট বৈধতা দিতে পারবে না।

Advertisement

রাষ্ট্রের সঙ্গে বড় মাপের বিশ্বাসঘাতকতা ( highly treason) কেউ বা কয়েকজন মিলে করলে তাদেরকে পাকিস্তানের ÔThe high treason act 1973 Pakistan’ এই আইন অনুযায়ী বিচার হবে। সে বিচারে যদি তারা সত্যি রাষ্ট্রের সঙ্গে বড় মাপের বিশ্বাসঘাতকতা অর্থাৎ সংবিধানের আর্টিকেল ৬ এ যা বলা আছে সে কাজ করে থাকে, তাহলে তাদের সাজা হয় মৃত্যুদণ্ড না হয় যাবজ্জীবন জেল।

পাকিস্তানে ৩ এপ্রিল সংসদে যে ঘটনা ঘটেছে সেটাকে সেদেশের দায়িত্বশীল পত্র-পত্রিকায় সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, তাদের প্রধানমন্ত্রী ইমরান আহমদ খান নিয়াজি যে কাজ করেছেন তা পাকিস্তানের গণতন্ত্রকে অস্থিতিশীল করা। সেদেশের পত্র-পত্রিকার সঙ্গে সঙ্গে থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সাংবাদিক ও গবেষক জাভেদ আহমদ খানও মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী ইমরান আহমদ খান নিয়াজি’র নির্দেশ মতো ডেপুটি স্পিকার যে অনাস্থা ভোট আনতে দেননি- এটা পুরোপুরি সংবিধানকে অমান্য করা। তাদের প্রধান দৈনিক ডনের সম্পাদকীয় যেমনটি বলছে, জাভেদও তেমনি বলেন, এ কাজ সংবিধানের আর্টিকেল ৫ কে অমান্য করা। এবং অমান্য করে আর্টিকেল ৬ এর (১) ও (২) এ বর্ণিত অপরাধ করা।

বাস্তবে পাকিস্তানের সংবিধান পর্যালোচনা করলে এবং তাদের সংসদীয় রুলস অফ বিজনেস অনুযায়ী, ডেপুটি স্পিকারের অনাস্থা ভোট বাতিল করার কোন ক্ষমতা নেই। এ কাজ তিনি সংবিধানের আর্টিকেল ৫ এর বিপরীতে গিয়ে করেছেন। এবং তার কথা মতো প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান নিয়াজি যে পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দিতে বলেছেন রাষ্ট্রপতিকে- এটাও সংবিধানের আর্টিকেল ৫ এ বিপরীতে যায়। যার ফলে জাভেদ আহমদ, ফখরুদ্দিন ইয়াজিদা’র মতো অনেক থিঙ্কট্যাংক মনে করছেন, ডেপুটি স্পিকার, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান নিয়াজি তিনজনই রাষ্ট্রের সঙ্গে বড় ধরনের বিশ্বাস ঘাতকতা করেছেন। এবং তারা তিনজনই পাকিস্তানের ‘হাই ট্রিজেন এ্যাক্ট ১৯৭৩’ অনুযায়ী বিচারের মুখোমুখি হবেন। এবং এ ক্ষেত্রে যেহেতু কাজ ইমরান খানের নির্দেশে হয়েছে, তাই তিনি মূল ব্যক্তি- বাদ বাকি দুজন তার সহযোগী। বিচারের খাড়া অনুযায়ী তাদের মাথার ওপর এখন মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন। যিনি মূল ব্যক্তি তার মৃত্যুদণ্ড হতে পারে। বাকিদের যাবজ্জীবন জেল ভোগ করতে হতে পারে।

Advertisement

ইমরান খান কেন এভাবে সংবিধান ভঙ্গ করতে গেলেন। ইমরান খান অবশ্য ARY News কে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলছেন, সে দেশের এস্টাবলিশমেন্ট তাকে তিনটি অপশন দিয়েছিলো। এক. পদত্যাগ করা। দুই. নো কনফিডেন্স। তিন. ইলেকশান। এস্টাবলিশমেন্ট বলতে এখানে কাকে বা কোন শক্তিকে ইঙ্গিত করছেন ইমরান তা অবশ্য পরিষ্কার করেননি। কিন্তু পাকিস্তানের রাজনীতি নিয়ে যাদের সামান্য নাড়া চাড়া করার অভিজ্ঞতা আছে -তারা সকলে জানেন, পাকিস্তানের এই ‘এস্টাবলিশমেন্ট’ অর্থ হলো, সে দেশের সামিরক বাহিনী। ইমরান আহমেদ খান নিয়াজি সামরিক বাহিনীরই লোক ছিলেন। তারাই তাঁকে ক্ষমতায় এনেছিলো। কিন্তু তারা যখন তাঁকে এই তিনটি পথ বাতলে দিয়ে মূলত সরে পড়তে বললো, সে সময়ে ইমরান খান ‘ওভার প্লে’ করে ফেলেছেন।

ইমরান খান অনেক বড় ক্রিকেটার। ক্রিকেট যতই মেথডিকাল ও সায়েনটিফিক খেলা হোক না কেন, ক্রিকেটের ভাগ্যের সঙ্গে একটা অনিশ্চয়তা জড়িয়ে যায় মাঝে মাঝে। ওই সময়ে অনেক ক্ষেত্রে ওভার প্লে করে খেলার ফলকে নিজের ঘরে তুলে আনা যায়। ইমরান খান স্পোটর্সম্যান থেকে পলিটিশিয়ান হয়েছেন। তাই হয়তো তিনি বুঝতে পারেননি, রাজনীতিতে তো ওভার প্লের কোন জায়গা নেই। তাছাড়া পাকিস্তানের মতো সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত রাজনীতির দেশে এ সুযোগ হতেই পারে না। যেখানে ইসলামাবাদের সিকিউরিটি ডায়ালগ অনুষ্ঠানে ১ এপ্রিল সে দেশের সেনাপ্রধান কামার জাভেদ বাজওয়া ভাষণ দিয়ে তার অবস্থান পরিষ্কার করে দিয়েছেন।

তারপরেও এই দুরন্ত গতির পেস বোলার ইমরান খান নিয়াজি কেন বুঝতে পারলেন না- তাও একটা বড় প্রশ্ন। ইমরান বলতে পারেন, তিনি তো এস্টাবলিশমেন্টের কথা অনুযায়ী নতুন নির্বাচনের পথে গেছেন। তার উত্তরে সবাই বলবে, তাকে তো সংবিধান অমান্য করে নির্বাচনের পথে যেতে বলেনি। তাকে অনাস্থা ভোটের মুখোমুখি হয়ে নির্বাচনে যাবার জন্যে বলা হয়েছিলো। তবে সত্য হলো, পাকিস্তানের রাজনীতিতে যেখানে জুলফিকার আলী ভুট্টোও এস্টাবলিশমেন্টের সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি, প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে তাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে, সেখানে একই পথে ইমরান আহমদ খান নিয়াজির মতো একজন ক্রিকেটার যাবে- তাতে আর অসুবিধা কি?

১ এপ্রিলে কামার জাভেদ বাজওয়ার দেয়া ভাষণটি যদি সংক্ষেপে এনালিসিস করা হয় তাহলে দেখা যায়, তিনি এ মুহূর্তের পৃথিবীতে আমেরিকার যেগুলো এজেন্ডা তার সপক্ষেই কথা বলেছেন। তাঁর ভাষণের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি অংশ ধারাবাহিক উল্লেখ করলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। তিনি বলেছেন, ‘যে কোন দুই রাষ্ট্রের মধ্যে সংঘাত বন্ধ, দারিদ্র্যদূর, ক্লাইমেট চেঞ্জ এফেক্ট, টেরোরিজম, সাইবার সিকিউরিটির পক্ষে’ পাকিস্তান কাজ করবে।

Advertisement

এরপরে তিনি বলেন , ‘ভূ রাজনৈতিক স্ট্রাটেজি অনুযায়ী উন্নয়ন সহযোগীদের সাহায্যে পাকিস্তানের নিজস্ব অর্থনীতিকে সুস্থির করতে চায়’। ‘দেশকে মডারেট দেশ হিসেবে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে যেতে চান’। এরপরেই বলেছেন, ‘আফগানিস্তানের এই সরকার ভালো করছে না। আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতার জন্যে সম্মিলিত (কালেকটিভ) চেষ্টা নিতে হবে এবং স্থিতিশীল সরকার গড়তে হবে সেখানে’।

‘কাশ্মির সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে’। এবং ‘ইউক্রেনের স্বাধীনতার পর থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক, এ সম্পর্ক থাকবে। পাশাপাশি তিনি রুশ আগ্রাসনসহ যে কোন বড় দেশের ছোট স্বাধীন দেশের আগ্রাসন নিন্দা যোগ্য বলে উল্লেখ করেন’। ‘সর্বোপরি দীর্ঘদিনের বন্ধু উন্নয়ন সহযোগীর সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার কথা বলেন।

পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের বন্ধু আমেরিকা, তাই কামার জাভেদ কার সঙ্গে সুসম্পর্ক চেয়েছে তা বুঝতে কারো কষ্ট হবার নয়। আমেরিকা এ মুহূর্তে চায় সকলেই ইউক্রেনে রাশিয়ান আগ্রাসনের বিপক্ষে দাঁড়াক ও নিন্দা করুক, সে কাজ বাজওয়া করেছেন। এছাড়া যারা রাজনীতি নিয়ে কম বেশি পড়াশুনা করেন, সকলেই জানেন, আফগানিস্তানের এই তালেবান সরকার মোটেই কোন স্থায়ী সরকার নয়।

এখানে আমেরিকার আরো খেলা আছে। আর সেটা বুঝেই চায়না খুব বেশি আফগানিস্তানে বিনিয়োগ করছে না। আর বাজওয়াই প্রথম কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যিনি প্রকাশ্যে বললেন, আফগানিস্তানের বর্তমান সরকার ভালো করছে না সেখানে স্থিতিশীল সরকারের দরকার। এর পরেও যদি ইমরান খান না বুঝতে পারেন, পাকিস্তানের রাজনীতি ও রাষ্ট্র ক্ষমতা কোথায় যাচ্ছে, এবং এস্টাবলিশমেন্ট তাকে যে পথ দেখিয়ে দিচ্ছে- সেখানে তার ওভার প্লে করার সুযোগ কম, তাহলে কেবল বলা যায়, তিনি যত বড় ক্রিকেটার তার ধারে কাছেরও পলিটিশিয়ান হতে পারেননি। তবে আবারও বলা যায়, পাকিস্তানের মাটিতে তার সান্ত্বনা আছে, যে মাটিতে জুলফিকার আলী ভুট্টো পারেননি সেখানে তিনি তো মাত্র ইমরান আহমদ খান নিয়াজি।

এখন প্রশ্ন, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী হঠ্যাৎ কেন আমেরিকার পক্ষে গেলো? বাস্তবে তৃতীয় বিশ্বের তাই ল্যাটিন আমেরিকা থেকে শুরু করে আফ্রিকা ও এশিয়ার যত দেশে সামরিক শাসন এসেছে, আসার সম্ভাবনা থাকে ওই সব দেশের সেনাবাহিনীর প্রধান বা যারা ক্ষমতা নিতে চান তারা সব সময়ই আমেরিকার পক্ষেই থাকে।

এমনকি একটা অলিখিত কথা যারা সামরিক শাসন নিয়ে কম বেশি পড়াশুনা করেন, তারা সকলেই স্বীকার করেন- যে সব দেশে একবার সামরিক শাসন হয়েছে, বা যেখানে রাজনীতি স্থিতিশীল নয় -ওই সব দেশের সেনাপ্রধানদের যতই সে দেশের রাষ্ট্রনায়ক বা সরকার প্রধান ওই পদে আসীন করুন না কেন, তারা বাস্তবে সবাই আমেরিকার লোক।

আর কেন তারা এভাবে আমেরিকার পক্ষে থাকে তারও কিন্তু শতভাগ কারণ আছে। সামরিক শাসকদের ইতিহাস দেখলে বোঝা যায়, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চায়না যে ক’টি দেশে সামরিক শাসক বসিয়েছে- তারা কিন্তু ওই শাসকদের খুব বেশি গ্রহণযোগ্যতা পৃথিবীতে দিতে পারেনি। এক্ষেত্রে সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি এবং চায়না বা তাদের গোয়েন্দা সংস্থা ব্যর্থ হয়েছে।

এই মুহূর্তের উদাহরণ দেখা যাক, প্রায় পাশাপাশি দুটো দেশ একটি মিয়ানমার ও অপরটি থাইল্যান্ড। মিয়ানমারের সামরিক শাসককে বসিয়েছে চায়না। সে পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন। আর থাইল্যান্ডের সামরিক শাসককে বসিয়েছে আমেরিকা, তাকে নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই- কোন দেশের। সব দেশের কাছে গ্রহণযোগ্য। এবং আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা সি আই এর আরো একটা সফলতা দেখা যায়, তারা তৃতীয় বিশ্বের প্রায় সব দেশের সামরিক শাসককে জনপ্রিয় শাসকে পরিণত করতে সমর্থ হয়।

ওইসব সামরিক শাসকরা রাজনীতিতে গিয়েও বড় বড় রাজনৈতিক দলের সঙ্গে টেক্কা দেয়। তাই যে কোন সামরিক অফিসার বা সেনাবাহিনী প্রধান- তিনি শিক্ষিত ব্যক্তি। তিনি সহজেই এ সত্য বোঝেন, ক্ষমতা দখল করে বিশ্বের সকল ফোরামে গ্রহণযোগ্যতা ও নিজদেশে জনপ্রিয় হবার জন্যে আমেরিকার স্ট্রাটেজিকাল সাহায্যের প্রয়োজন। আর এ কারণেই সামিরক শাসকরা আমেরিকারই হয়।

লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/জিকেএস