ধর্ম

শয়তান যে কারণে আদমকে (আ.) সেজদা করেনি

রহমতের মাস রজানের ৬ষ্ঠ তারাবি আজ। হাফেজে কোরআনদের কণ্ঠে শয়তানের সেই উদ্বত ও অবাধ্যতার কথা তেলাওয়াত হবে। যেখানে শয়তান নিজেকে শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করেছে। কেন শয়তান হজরত আদম আলাইহিস সালামকে আল্লাহর নির্দেশ পাওয়ার পরও সেজদা করেনি; অবাধ্যতার সেই কথাও মহান আল্লাহ কোরআনুল কারিমে তুলে ধরেছেন। কেন শয়তান হজরত আদম আলাইহিস সালামক সেজদা করেনি?

Advertisement

কোরআনের সবচেয়ে বহুল পঠিত ও গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমা প্রার্থনার দোয়াসহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু দোয়াও পড়া হবে আজ। যে দোয়া পড়ে ক্ষমা পেয়েছিলেন হজরত আদম ও হাওয়া আলাইহিমাস সালাম। সে দোয়াসহ সবগুলো দোয়া একত্রে তুলে ধরা হলো-

হজরত আদম ও হাওয়া আলাইহিমাস সালাম আল্লাহর কাছে এভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন-

رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنفُسَنَا وَإِن لَّمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ

Advertisement

উচ্চারণ : 'রাব্বানা জালামনা আংফুসানা ওয়া ইল্লাম তাগফিরলানা ওয়া তারহামনা লানাকুনান্না মিনাল খাসিরিন।'

'হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা নিজেদের প্রতি জুলম করেছি। যদি আপনি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন এবং আমাদের প্রতি অনুগ্রহ না করেন, তবে আমরা অবশ্যই অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাব।' (সুরা আরাফ : আয়াত ২৩)

জান্নাতিরা দোয়া করবে এভাবে। যেভাবে আমাদের দোয়া করা উচিত। আর তাহলো-

رَبَّنَا لاَ تَجْعَلْنَا مَعَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ

Advertisement

উচ্চারণ : 'রাব্বানা লা তাঝআলনা মাআল কাওমিলজ জালিমিন।'

'হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে এ জালেমদের সাথী করো না।' (সুরা আরাফ : আয়াত ৪৭)

এরপর আল্লাহর কাছে মুমিনরা ধৈয্য লাভ ও ঈমানি মৃত্যুর দোয়া করবে এভাবে-

رَبِّنَا لَمَّا جَاءتْنَا رَبَّنَا أَفْرِغْ عَلَيْنَا صَبْرًا وَتَوَفَّنَا مُسْلِمِينَ

উচ্চারণ : 'রাব্বানা লাম্মা ঝাআতনা রাব্বানা আফরিগ আলাইনা সাবরাও ওয়া তাওয়াফফানা মুসলিমিন।'

'হে আমাদের পরওয়ারদেগার! আমাদের জন্য ধৈর্য্যের দ্বার খুলে দাও এবং আমাদের মুসলমান হিসাবে মৃত্যু দান কর।' (সুরা আরাফ : আয়াত ১২৬)

> হজরত মুসা আলাইহিস সালাম নিজের জন্য তার ভাইয়ের জন্য রহমত ও দোয়া কামনা-

رَبِّ اغْفِرْ لِي وَلأَخِي وَأَدْخِلْنَا فِي رَحْمَتِكَ وَأَنتَ أَرْحَمُ الرَّاحِمِينَ

উচ্চারণ : 'রাব্বিগফিরলি ওয়া লিআখি ওয়া আদখিলনা ফি রাহমাতিকা ওয়া আংতা আরহামুর রাহিমিন।'

'হে আমার প্রভু! ক্ষমা কর আমাকে আর আমার ভাইকে এবং আমাদেরকে তোমার রহমতের অন্তর্ভুক্ত কর। তুমি যে সর্বাধিক করুণাময়। (সুরা আরাফ : আয়াত ১৫১)

> আল্লাহ সবচেয়ে উত্তম রক্ষাকারী ও গোনাহ মাগফকারী

أَنتَ وَلِيُّنَا فَاغْفِرْ لَنَا وَارْحَمْنَا وَأَنتَ خَيْرُ الْغَافِرِينَ

উচ্চারণ : 'আংতা ওয়ালিয়্যুনা ফাগফিরলানা ওয়ারহামনা ওয়া আংতা খায়রুল গাফিরিন।'

'তুমি যে আমাদের রক্ষক-সুতরাং আমাদেরকে ক্ষমা করে দাও এবং আমাদের উপর করুনা কর। তাছাড়া তুমিই তো সর্বাধিক ক্ষমাকারী।' (সুরা আরাফ : আয়াত ১৫৫)

হাফেজে কোরআনগন আজ সুরা আরাফের ১২ আয়াত থেকে তেলওয়াত শুরু করবেন। সুরা আনফালের ৪০নং আয়াত পর্যন্ত পড়া হবে আজ। সে সঙ্গে ৯ পাড়ার তেলাওয়াত শেষ হবে।

শয়তানের বাক-বিতন্ডায় শুরু হবে আজকের তারাবি। আল্লাহ তাআলার প্রশ্নের জবাবে বিতাড়িত শয়তান যে কথা বলেছিল  কোরআনের বর্ণনায় তা এভাবে ওঠে এসেছে-

قَالَ مَا مَنَعَکَ اَلَّا تَسۡجُدَ اِذۡ اَمَرۡتُکَ ؕ قَالَ اَنَا خَیۡرٌ مِّنۡهُ ۚ خَلَقۡتَنِیۡ مِنۡ نَّارٍ وَّ خَلَقۡتَهٗ مِنۡ طِیۡنٍ

'তিনি (আল্লাহ) বললেন, ‘কিসে তোমাকে বাধা দিয়েছে যে, সিজদা করছ না, যখন আমি তোমাকে নির্দেশ দিয়েছি’? সে বলল, ‘আমি তার চেয়ে উত্তম। আপনি আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছেন, আর তাকে সৃষ্টি করেছেন কাদামাটি থেকে।' (সুরা আরাফ : আয়াত ১২)

আল্লাহ তাআলা ইবলিসকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছেন। আর ইবলিসকে যদি জিন জাতির পিতা বলা হয়, তখন তো এ ব্যাপারে আর কোনো কথাই থাকে না। কেননা কোরআনের অনেক আয়াতে জিন জাতিকে আগুন থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, 'আর এর আগে আমরা সৃষ্টি করেছি জিনদের অতি উষ্ণ নিধুম আগুন থেকে।' (সুরা আল হিজর : আয়াত ২৭)

অন্য আয়াতে আরও স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, জিন জাতিকে ‘মারেজ’ থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আর ‘মারেজ’ হচ্ছে, নিধুম অগ্নিশিখা। আল্লাহ বলেন, 'আর জিনকে সৃষ্টি করেছেন নিধুম আগুনের শিখা থেকে।' (সুরা আর রহমান : আয়াত ১৫)

কোরআনুল কারিমের আয়াত থেকে এ কথা সুস্পষ্ট যে, আল্লাহ তাআলা জিন জাতিকে আগুণ দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। ইবলিস নিজেকে আগুনের সৃষ্টি বলে অহংকারবশত আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করেছে। হজরত আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করেনি। ফলে আল্লাহ তাআলা তাকে জিজ্ঞাসা করেন, কীসে তোমাকে আদমকে সেজদা করতে বাধা দিয়েছে? এ প্রশ্নের জবাবে ইবলিস জানায়-

اَنَا خَیۡرٌ مِّنۡهُ ۚ خَلَقۡتَنِیۡ مِنۡ نَّارٍ وَّ خَلَقۡتَهٗ مِنۡ طِیۡنٍ

‘আমি তার চেয়ে উত্তম। আপনি আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছেন, আর তাকে সৃষ্টি করেছেন কাদামাটি থেকে।' (সুরা আরাফ : আয়াত ১২)

ফসিরে আহসানুল বয়ানে এসেছে, প্রথমত : 'أَنْ تَسْجُدَ - সিজদা করতে তোমাকে বাধা কে দিল? 'কোন জিনিস তোমাকে বাধ্য করলো সেজদা না করতে?’ (ইবনে কাসির, ফাতহুল কাদির)

শয়তান কখনো ফেরেশতাদের জাতিভুক্ত ছিল না। বরং স্বয়ং কোরআনের বিবৃতি অনুযায়ী সে ছিল জিন জাতির একজন। আল্লাহ বলেন-

وَ اِذۡ قُلۡنَا لِلۡمَلٰٓئِکَۃِ اسۡجُدُوۡا لِاٰدَمَ فَسَجَدُوۡۤا اِلَّاۤ اِبۡلِیۡسَ ؕ کَانَ مِنَ الۡجِنِّ

'আর যখন আমি ফেরেশতাদের বলেছিলাম, তোমরা আদমকে সেজদা কর। এরপর তারা সেজদা করলো, ইবলিস ছাড়া। সে ছিল জিনদের একজন। সে তার রবের নির্দেশ অমান্য করলো।' (সুরা কাহফ : আয়াত ৫০)

তবে (ইবলিস) আসমানে ফেরেশতাদের সঙ্গে থাকার কারণে সেও আল্লাহর সেজদা করতে বলার সেই আদেশের আওতাভুক্ত ছিল, যা তিনি (আল্লাহ) ফেরেশতাদের করেছিলেন। আর এই কারণেই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ এবং তিরস্কারও করা হয়েছে। যদি সে এই আদেশে শামিল না থাকতো, তাহলে না তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতো, আর না সে (আল্লাহর দরবার থেকে) বিতাড়িত হতো।

দ্বিতীয়ত : শয়তানের এই ওজর আরো অপরাধমূলক। আল্লাহর নির্দেশের সামনে কে শ্রেষ্ঠ আর কে শ্রেষ্ঠ নয় এ প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করাই হল ইবলিসের অবাধ্যতা। যেমনিভাবে বলা হয় যে, 'পাপের জন্য ওজর পেশ করা আরো বড় পাপ।'

প্রকৃত জিনিস হল আল্লাহর নির্দেশ পালন। ইবলিসের এই ধারণাই ভুল যে, অধিক শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারীকে তার থেকে কম শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী ব্যক্তির সম্মান প্রদান করার নির্দেশ দেওয়া যেতে পারে না। অথচ ইবলিস আল্লাহর অবাধ্যতা করে সে নিজেকে উত্তম হওয়ার প্রমাণ এটাই দিল যে, সে আগুন থেকে সৃষ্ট, আর আদম মাটি থেকে। কিন্তু ইবলিস এ বিষয়টি চিন্তা করেনি যে, মহান আল্লাহ আদমকে নিজ হাত দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর নিজ হাতে সৃষ্ট আদমের সম্মান ও মর্যাদা কতবেশি।

আল্লাহ তাআলা আদমকে তাঁর নিজ হাত দিয়ে সৃষ্টি করেছেন এবং নিজের পক্ষ থেকে তাঁর মধ্যে আত্মা দান করেছেন। দুনিয়ার কোনো জিনিস কি এই সম্মানের মোকাবেলা করতে পারে?

তৃতীয়ত শয়তান আল্লাহর স্পষ্ট উক্তির মোকাবেলায় সে কিয়াস করলো; যা কোনো আল্লাহভীরু বান্দার কাজ হতে পারে না। এ ছাড়া তার কিয়াসও বাতিল। আগুন মাটি থেকে কিভাবে উত্তম? আগুনের মধ্যে তেজি, উত্তাপ এবং দহন ক্ষমতা ছাড়া আর কি আছে?

পক্ষান্তরে মাটির মধ্যে আছে স্থিরতা, দৃঢ়তা। এর মধ্যে আছে উদ্ভিদ-বৃদ্ধি, উৎপাদন এবং বস্তু পরিশুদ্ধ করণের যোগ্যতা। আর এ গুণগুলো আগুনের চেয়ে অবশ্যই উত্তম এবং বেশি উপকারীও বটে।

এই আয়াত থেকে সুস্পষ্ট যে,শয়তান আগুন থেকে সৃষ্টি হয়েছে। হাদিসে পাকেও এসেছে, ‘ফেরেশতারা নুর থেকে, ইবলিস অগ্নিশিখা থেকে এবং আদম আলাইহিস সালামকে মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে।' (মুসলিম)

এরপরই মহান আল্লাহ ইবলিসের প্রতি জান্নাত থেকে বের হয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। শয়তানকে লাঞ্ছিতদের অন্তর্ভূক্ত করেন। পরের আয়াতেই মহান আল্লাহর এ নির্দেশ এভাবে এসেছে-

 قَالَ فَاهۡبِطۡ مِنۡهَا فَمَا یَکُوۡنُ لَکَ اَنۡ تَتَکَبَّرَ فِیۡهَا فَاخۡرُجۡ اِنَّکَ مِنَ الصّٰغِرِیۡنَ

'তিনি বললেন, ‘সুতরাং তুমি এখান থেকে নেমে যাও। তোমার এ অধিকার নেই যে, এখানে তুমি অহঙ্কার করবে। সুতরাং বের হও। নিশ্চয়ই তুমি লাঞ্ছিতদের অন্তর্ভুক্ত।' (সুরা আরাফ : আয়াত ১৩)

লাঞ্ছিত ব অহংকারী কারা?

এ আয়াতে ইবলিসকে লাঞ্ছিতদের অন্তর্ভূক্ত বলা হয়েছে। কোরআনের ভাষায় ‘সাগিরিন’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। যার একক অর্থ হলো 'লাঞ্ছনা ও অবমাননার মধ্যে নিজেকে নিয়ে রাখা কিংবা সবচেয়ে কঠিন লাঞ্ছনা ও অবমাননার শিকার হওয়া। যে ব্যক্তি নিজেই লাঞ্ছনা, অবমাননা ও নিকৃষ্টতর অবস্থা অবলম্বন করে।

সুতরাং আল্লাহর বাণীর অর্থ হচ্ছে, 'আল্লাহর বান্দা ও সৃষ্টি হয়েও তোমার অহংকারে মত্ত হওয়া এবং তুমি নিজের মর্যাদা ও শ্রেষ্টত্বের যে ধারণা নিজেই তৈরি করে নিয়েছ তার দৃষ্টিতে তোমার রবের হুকুম তোমার জন্য অবমাননাকর মনে হওয়া ও সে জন্য তা অমান্য করার অর্থ নিজেই নিজেকে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করতে দেওয়া।

শ্রেষ্ঠত্বের মিথ্যা অহমিকা, মর্যাদার ভিত্তিহীন দাবি এবং কোনো জন্মগত স্বতঃসিদ্ধ অধিকার ছাড়াই নিজেকে অযথা শ্রেষ্ঠত্বের আসনে সমাসীন মনে করা কাউকে বড়, শ্রেষ্ঠ ও মর্যাদাশীল করতে পারে না। বরং এর ফলে তুমি মিথ্যুক, লাঞ্ছিত ও অপমানিতই হবে এবং তোমার এ লাঞ্ছনা ও অবমাননার কারণ হবে তুমি নিজেই।

কুরআনের অন্যত্র মিথ্যা অহংকারের পরিণাম বর্ণিত হয়েছে। কোথাও বলা হয়েছে যে, অহংকারী আল্লাহর আয়াতসমূহ ও তার নিদর্শনাবলী বুঝতে অক্ষম হয়ে যায়। সে তা থেকে হেদায়াত পায় না। আল্লাহ বলেন-

 سَاَصۡرِفُ عَنۡ اٰیٰتِیَ الَّذِیۡنَ یَتَکَبَّرُوۡنَ فِی الۡاَرۡضِ بِغَیۡرِ الۡحَقِّ ؕ وَ اِنۡ یَّرَوۡا کُلَّ اٰیَۃٍ لَّا یُؤۡمِنُوۡا بِهَا ۚ وَ اِنۡ یَّرَوۡا سَبِیۡلَ الرُّشۡدِ لَا یَتَّخِذُوۡهُ سَبِیۡلًا ۚ وَ اِنۡ یَّرَوۡا سَبِیۡلَ الۡغَیِّ یَتَّخِذُوۡهُ سَبِیۡلًا ؕ ذٰلِکَ بِاَنَّهُمۡ کَذَّبُوۡا بِاٰیٰتِنَا وَ کَانُوۡا عَنۡهَا غٰفِلِیۡنَ

'জমিনে যারা অন্যায়ভাবে অহংকার করে বেড়ায় আমার নিদর্শনসমূহ থেকে আমি তাদের অবশ্যই ফিরিয়ে রাখব। আর তারা প্রত্যেকটি নিদর্শন দেখলেও তাতে ঈমান আনবে না এবং তারা সৎপথ দেখলেও সেটাকে পথ বলে গ্রহণ করবে না, কিন্তু তারা ভুল পথ দেখলে সেটাকে পথ হিসেবে গ্রহণ করবে।' (সুরা আরাফ : আয়াত ১৪৬)

আবার কোথাও বলা হয়েছে যে, অহংকারীর ঠিকানা হচ্ছে জাহান্নাম। আল্লাহ বলেন-

 فَادۡخُلُوۡۤا اَبۡوَابَ جَهَنَّمَ خٰلِدِیۡنَ فِیۡهَا ؕ فَلَبِئۡسَ مَثۡوَی الۡمُتَکَبِّرِیۡنَ

'কাজেই তোমরা দরজাগুলো দিয়ে জাহান্নামে প্রবেশ কর, তাতে স্থায়ী হয়ে। এরপর অহংকারীদের আবাসস্থল কত নিকৃষ্ট।' (সুরা আন-নাহল : আয়াত ২৯)

আল্লাহ আরও বলেন-

 وَ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ تَرَی الَّذِیۡنَ کَذَبُوۡا عَلَی اللّٰهِ وُجُوۡهُهُمۡ مُّسۡوَدَّۃٌ ؕ اَلَیۡسَ فِیۡ جَهَنَّمَ مَثۡوًی لِّلۡمُتَکَبِّرِیۡنَ

'আর যারা আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করে কিয়ামতের দিন তুমি তাদের চেহারাগুলো কালো দেখতে পাবে। অহংকারীদের আবাসস্থল কি জাহান্নাম নয়?' (সুরা যুমার : আয়াত ৬০)

قِیۡلَ ادۡخُلُوۡۤا اَبۡوَابَ جَهَنَّمَ خٰلِدِیۡنَ فِیۡهَا ۚ فَبِئۡسَ مَثۡوَی الۡمُتَکَبِّرِیۡنَ

'বলা হবে, জাহান্নামের দরজাসমূহে প্রবেশ কর তাতে স্থায়ীভাবে অবস্থানের জন্য। অতএব অহংকারীদের আবাসস্থল কত নিকৃষ্ট।' (সুরা আয-যুমার : আয়াত ৭২)

 اِنَّ الَّذِیۡنَ یَسۡتَکۡبِرُوۡنَ عَنۡ عِبَادَتِیۡ سَیَدۡخُلُوۡنَ جَهَنَّمَ دٰخِرِیۡنَ

'নিশ্চয়ই যারা অহংকারবশত আমার ইবাদাত থেকে বিমুখ থাকে, তারা অচিরেই জাহান্নামে প্রবেশ করবে লাঞ্ছিত হয়ে।' (সুরা গাফির : আয়াত ৬০)

কোরআনুল কারিমের বর্ণনা থেকে সুস্পষ্ট যে, অহংকারী ও লাঞ্ছিতদের ঈমান নসিব হয় না। আল্লাহ তাআলা বলেন-

'শুধু তারাই আমার আয়াতসমূহের উপর ঈমান আনে, যারা সেটার দ্বারা উপদেশপ্রাপ্ত হলে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে এবং তাদের রবের সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে, আর তারা অহংকার করে না।' (সুরা আস-সাজদাহ : আয়াত ১৫)

সর্বোপরি কথা হলো- মহান আল্লাহ অপরাধী অহংকারীদের ভালোবাসেন না। এটি মহান প্রভু ঘোষণা-

لَاجَرَمَ اَنَّ اللّٰهَ یَعۡلَمُ مَا یُسِرُّوۡنَ وَ مَا یُعۡلِنُوۡنَ ؕ اِنَّهٗ لَا یُحِبُّ الۡمُسۡتَکۡبِرِیۡنَ

'নিঃসন্দেহে তারা যা গোপন করে এবং যা প্রকাশ্যে ঘোষণা করে, নিশ্চয় তা আল্লাহ জানেন। নিশ্চয়ই তিনি অহংকারীদের পছন্দ করেন না।' (সুরা আন-নাহল : আয়াত ২৩)

যুগে যুগে নবি-রাসুলদের দেওয়া সতর্কবার্তায় ভরপুর আজকের তেলাওয়াতকৃত দুই সুরা। শয়তানের ধোঁকা ও প্রতারণা থেকে হেফাজত থাকার সেরা সতর্ক বার্তা রয়েছে আজকের তারাবিতে।  এ ছাড়াও ৬ তারাবির তেলাওয়াতে যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর তেলাওয়াত হবে তার আলোচ্যসূচি সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো-

সুরা আরাফ (১২-২০৬)

সুরা আরাফের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, আল্লাহ তাআলা এ সুরার চার স্থানে মানবজাতিকে ‘হে আদম সন্তান!’ বলে সম্বোধন করেছেন।এ সুরায় হজরত আদম ও হাওয়া আলাইহিস সালামের ক্ষমা প্রার্থনার ঐতিহাসিক দোয়া তুলে ধরা হয়েছে।

শয়তানের অনুমতি প্রার্থনা

মানুষকে পথভ্রষ্ট করতে শয়তানের আল্লাহর কাছ থেকে ক্ষমতা চেয়ে নেয়ার বিষয়টি ওঠে এসেছে এ সুরায়। আল্লাহ তাআলা কুরআন সে কথা তুলে ধরেছেন এভাবে-

قَالَ اَنۡظِرۡنِیۡۤ اِلٰی یَوۡمِ یُبۡعَثُوۡنَ

সে বলল- আমাকে কেয়ামতের দিন পর্যন্ত অবকাশ দিন।

قَالَ اِنَّکَ مِنَ الۡمُنۡظَرِیۡنَ

আল্লাহ বললেন- নিশ্চয়ই তুমি অবকাশপ্রাপ্তদের অন্তর্ভূক্ত।

قَالَ فَبِمَاۤ اَغۡوَیۡتَنِیۡ لَاَقۡعُدَنَّ لَهُمۡ صِرَاطَکَ الۡمُسۡتَقِیۡمَ

সে বলল- আপনি আমাকে যেমন পথভ্রষ্ট করেছেন, আমিও তাদের জন্যে আপনার সরল পথে বসে থাকবো।

 ثُمَّ لَاٰتِیَنَّهُمۡ مِّنۡۢ بَیۡنِ اَیۡدِیۡهِمۡ وَ مِنۡ خَلۡفِهِمۡ وَ عَنۡ اَیۡمَانِهِمۡ وَ عَنۡ شَمَآئِلِهِمۡ ؕ وَ لَا تَجِدُ اَکۡثَرَهُمۡ شٰکِرِیۡنَ

এরপর তাদের কাছে আসবো; তাদের সামনের দিক থেকে, পেছন দিক থেকে, ডান দিক থেকে এবং বাম দিক থেকে। আপনি তাদের অধিকাংশকে কৃতজ্ঞ পাবেন না।' (সুরা আরাফ : আয়াত ১৪-১৭)

শয়তান আল্লাহর আল্লাহর হুকুম অমান্য করার পর বেহেশত থেকে বের হতে বাধ্য হয়েছিল। সেই জেদ থেকেই জান্নাতের নেয়ামতের পরিবর্তে মানুষকে পথভ্রষ্ট করার ক্ষমতা লাভ করে শয়তান। সব সময় মানুষকে ঈমান-আমল থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ে উলঙ্গ করে দেওয়ার চক্রান্তে লিপ্ত। যেভাবে আদি পিতা ও মাতাকে বেহেশতে থেকে উলঙ্গ করে বের করে দিয়েছিল শয়তান। আল্লাহ তাআলা তা উল্লেখ করেন বলেন-

 یٰبَنِیۡۤ اٰدَمَ لَا یَفۡتِنَنَّکُمُ الشَّیۡطٰنُ کَمَاۤ اَخۡرَجَ اَبَوَیۡکُمۡ مِّنَ الۡجَنَّۃِ یَنۡزِعُ عَنۡهُمَا لِبَاسَهُمَا لِیُرِیَهُمَا سَوۡاٰتِهِمَا ؕ اِنَّهٗ یَرٰىکُمۡ هُوَ وَ قَبِیۡلُهٗ مِنۡ حَیۡثُ لَا تَرَوۡنَهُمۡ ؕ اِنَّا جَعَلۡنَا الشَّیٰطِیۡنَ اَوۡلِیَآءَ لِلَّذِیۡنَ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ

'হে বনি আদম! শয়তান যেন তোমাদেরকে বিভ্রান্ত না করে; যেমন সে তোমাদের পিতা-মাতাকে জান্নাত থেকে বের করে দিয়েছে এমতাবস্থায় যে, তাদের পোশাক তাদের থেকে খুলিয়ে দিয়েছি-যাতে তাদেরকে লজ্জাস্থান দেখিয়ে দেয়। সে এবং তার দলবল তোমাদেরকে দেখে, যেখান থেকে তোমরা তাদেরকে দেখ না। আমি শয়তানদেরকে তাদের বন্ধু করে দিয়েছি, যারা বিশ্বাস স্থাপন করে না।' (সুরা আরাফ : আয়াত ২৭)

> উত্তম পোশাক পরে নামাজ আদায়ের নির্দেশ হয়েছে কুরআনে। কেননা নামাজ মুমিনের মেরাজ। সে কারণে আল্লাহ তাআলা নামাজে উত্তম পোশাক পরে নামাজ আদায়ের নির্দেশ দিয়ে বলেন-

 یٰبَنِیۡۤ اٰدَمَ خُذُوۡا زِیۡنَتَکُمۡ عِنۡدَ کُلِّ مَسۡجِدٍ وَّ کُلُوۡا وَ اشۡرَبُوۡا وَ لَا تُسۡرِفُوۡا ۚ اِنَّهٗ لَا یُحِبُّ الۡمُسۡرِفِیۡنَ

'হে বনি আদম! তোমরা প্রত্যেক নামাজের সময় সাজসজ্জা পরিধান করে নাও, খাও ও পান কর এবং অপব্যয় করো না। তিনি অপব্যয়ীদেরকে পছন্দ করেন না।' (সুরা আরাফ : আয়াত ৩১)

> জান্নাতের অধিবাসীরা দুনিয়ার সব ঘোষণার সত্যতা পাবে পরকালে। সে ঘটনার বর্ণনা এবং জাহান্নামিদের সঙ্গী হওয়া থেকে বিরত থাকতে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবে। সে ঘটনা ও দোয়া এভাবে তুলে ধরা হয়েছে-

 وَ نَادٰۤی اَصۡحٰبُ الۡجَنَّۃِ اَصۡحٰبَ النَّارِ اَنۡ قَدۡ وَجَدۡنَا مَا وَعَدَنَا رَبُّنَا حَقًّا فَهَلۡ وَجَدۡتُّمۡ مَّا وَعَدَ رَبُّکُمۡ حَقًّا ؕ قَالُوۡا نَعَمۡ ۚ فَاَذَّنَ مُؤَذِّنٌۢ بَیۡنَهُمۡ اَنۡ لَّعۡنَۃُ اللّٰهِ عَلَی الظّٰلِمِیۡنَ

'জান্নাতিরা দোযখের অধিবাসীদেরকে ডেকে বলবে, আমাদের সাথে আমাদের প্রতিপালক যে ওয়াদা করেছিলেন, তা আমরা সত্য পেয়েছি? অতএব, তোমরাও কি তোমাদের প্রতিপালকের ওয়াদা সত্য পেয়েছ? তারা বলবে, হ্যাঁ। অতপর একজন ঘোষক উভয়ের মাঝখানে ঘোষণা করবে- আল্লাহর অভিশাপ জালেমদের উপর।' (সুরা আরাফ : আয়াত ৪৪)

> এ সুরায় আসমান-জমিন সৃষ্টি ও তার অবস্থানের কথাও সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন এভাবে-

اِنَّ رَبَّکُمُ اللّٰهُ الَّذِیۡ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ فِیۡ سِتَّۃِ اَیَّامٍ ثُمَّ اسۡتَوٰی عَلَی الۡعَرۡشِ ۟ یُغۡشِی الَّیۡلَ النَّهَارَ یَطۡلُبُهٗ حَثِیۡثًا ۙ وَّ الشَّمۡسَ وَ الۡقَمَرَ وَ النُّجُوۡمَ مُسَخَّرٰتٍۭ بِاَمۡرِهٖ ؕ اَلَا لَهُ الۡخَلۡقُ وَ الۡاَمۡرُ ؕ تَبٰرَکَ اللّٰهُ رَبُّ الۡعٰلَمِیۡنَ

'নিশ্চয় তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ। তিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতপর আরশের উপর অধিষ্টিত হয়েছেন। তিনি পরিয়ে দেন রাতের উপর দিনকে এমতাবস্থায় যে, দিন দৌড়ে রাতের পিছনে আসে। তিনি সৃষ্টি করেছেন সূর্য, চন্দ্র ও নক্ষত্র দৌড় স্বীয় আদেশের অনুগামী। শুনে রেখ, তাঁরই কাজ সৃষ্টি করা এবং আদেশ দান করা। আল্লাহ, বরকতময় যিনি বিশ্বজগতের প্রতিপালক।' (সুরা আরাফ : আয়াত ৫৪)

> আল্লাহ মৃত জমিনকে যেভাবে বৃষ্টি দিয়ে সজিব করে মানুষের জীবিকার ব্যবস্থা করেন, তার ঘোষণা দিয়ে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন-

 وَ هُوَ الَّذِیۡ یُرۡسِلُ الرِّیٰحَ بُشۡرًۢا بَیۡنَ یَدَیۡ رَحۡمَتِهٖ ؕ حَتّٰۤی اِذَاۤ اَقَلَّتۡ سَحَابًا ثِقَالًا سُقۡنٰهُ لِبَلَدٍ مَّیِّتٍ فَاَنۡزَلۡنَا بِهِ الۡمَآءَ فَاَخۡرَجۡنَا بِهٖ مِنۡ کُلِّ الثَّمَرٰتِ ؕ کَذٰلِکَ نُخۡرِجُ الۡمَوۡتٰی لَعَلَّکُمۡ تَذَکَّرُوۡنَ -  وَ الۡبَلَدُ الطَّیِّبُ یَخۡرُجُ نَبَاتُهٗ بِاِذۡنِ رَبِّهٖ ۚ وَ الَّذِیۡ خَبُثَ لَا یَخۡرُجُ اِلَّا نَکِدًا ؕ کَذٰلِکَ نُصَرِّفُ الۡاٰیٰتِ لِقَوۡمٍ یَّشۡکُرُوۡنَ

'তিনিই বৃষ্টির আগে সুসংবাদবাহী বায়ু পাঠিয়ে দেন। এমনকি যখন বায়ুরাশি পানিপূর্ন মেঘমালা বয়ে আনে, তখন আমি এ মেঘমালাকে একটি মৃত শহরের দিকে হাঁকিয়ে দেই। অতপর এ মেঘ থেকে বৃষ্টি ধারা বর্ষণ করি। অতপর পানি দ্বারা সব রকমের ফল উৎপন্ন করি। এমনি ভাবে মৃতদেরকে বের করব যাতে তোমরা চিন্তা কর। যে শহর উৎকৃষ্ট, তার ফসল তার প্রতিপালকের নির্দেশে উৎপন্ন হয় এবং যা নিকৃষ্ট তাতে অল্পই ফসল উৎপন্ন হয় এমনিভাবে আমি আয়াতসমূহ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বর্ণনা করি কৃতজ্ঞ সম্প্রদায়ের জন্যে।' (সুরা আরাফ : আয়াত ৫৭-৫৮)

যুগে যুগে আল্লাহর একত্ববাদের দাওয়াত ও ইবাদতের যে দাবি নিয়ে নবি রাসুলদের আগমন ঘটেছিল তার উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা ওঠে এসেছে এ সুরায় আর তাহলো-

হজরত নুহ আলাইহিস সালামের দাওয়াত

 لَقَدۡ اَرۡسَلۡنَا نُوۡحًا اِلٰی قَوۡمِهٖ فَقَالَ یٰقَوۡمِ اعۡبُدُوا اللّٰهَ مَا لَکُمۡ مِّنۡ اِلٰهٍ غَیۡرُهٗ ؕ اِنِّیۡۤ اَخَافُ عَلَیۡکُمۡ عَذَابَ یَوۡمٍ عَظِیۡمٍ

'নিশ্চয় আমি নূহকে তার সম্প্রদায়ের প্রতি পাঠিয়েছি। সে বললঃ হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ব্যতিত তোমাদের কোনো উপাস্য নেই। আমি তোমাদের জন্যে একটি মহাদিবসের শাস্তির আশঙ্কা করি।' (সুরা আরাফ : আয়াত ৫৯)

হজরত হুদ আলাইহিস সালামের দাওয়াত

 وَ اِلٰی عَادٍ اَخَاهُمۡ هُوۡدًا ؕ قَالَ یٰقَوۡمِ اعۡبُدُوا اللّٰهَ مَا لَکُمۡ مِّنۡ اِلٰهٍ غَیۡرُهٗ ؕ اَفَلَا تَتَّقُوۡنَ

'আদ সম্প্রদায়ের কাছে প্রেরণ করেছি তাদের ভাই হুদকে। সে বলল- আমার সম্প্রদায়, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ব্যতিত তোমাদের কোনো উপাস্য নেই।' (সুরা আরাফ : আয়াত ৬৫)

হজরত সালেহ আলাইহিস সালামের দাওয়াত

وَ اِلٰی ثَمُوۡدَ اَخَاهُمۡ صٰلِحًا ۘ قَالَ یٰقَوۡمِ اعۡبُدُوا اللّٰهَ مَا لَکُمۡ مِّنۡ اِلٰهٍ غَیۡرُهٗ ؕ قَدۡ جَآءَتۡکُمۡ بَیِّنَۃٌ مِّنۡ رَّبِّکُمۡ ؕ هٰذِهٖ نَاقَۃُ اللّٰهِ لَکُمۡ اٰیَۃً فَذَرُوۡهَا تَاۡکُلۡ فِیۡۤ اَرۡضِ اللّٰهِ وَ لَا تَمَسُّوۡهَا بِسُوۡٓءٍ فَیَاۡخُذَکُمۡ عَذَابٌ اَلِیۡمٌ

'সামুদ সম্প্রদায়ের কাছে প্রেরণ করেছি তাদের ভাই সালেহকে। সে বলল- হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ব্যতিত তোমাদের কোনো উপাস্য নেই। তোমাদের কাছে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে একটি প্রমাণ এসে গেছে। এটি আল্লাহর উষ্ট্রী তোমাদের জন্যে প্রমাণ। অতএব একে ছেড়ে দাও, আল্লাহর ভুমিতে চড়ে বেড়াবে। একে অসৎভাবে স্পর্শ করবে না। অন্যথায় তোমাদেরকে যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি পাকড়াও করবে।' (সুরা আরাফ : আয়াত ৭৩)

হজরত লুত আলাইহিস সালামের সতর্কতা

 وَ لُوۡطًا اِذۡ قَالَ لِقَوۡمِهٖۤ اَتَاۡتُوۡنَ الۡفَاحِشَۃَ مَا سَبَقَکُمۡ بِهَا مِنۡ اَحَدٍ مِّنَ الۡعٰلَمِیۡنَ -  اِنَّکُمۡ لَتَاۡتُوۡنَ الرِّجَالَ شَهۡوَۃً مِّنۡ دُوۡنِ النِّسَآءِ ؕ بَلۡ اَنۡتُمۡ قَوۡمٌ مُّسۡرِفُوۡنَ

'আর আমি লুতকে প্রেরণ করেছি। যখন সে স্বীয় সম্প্রদায়কে বলল- তোমরা কি এমন অশ্লীল কাজ করছ, যা তোমাদের আড়ে সারা বিশ্বের কেউ করেনি? তোমরা তো কামবশতঃ পুরুষদের কাছে গমন কর নারীদেরকে ছেড়ে। বরং তোমরা সীমা অতিক্রম করেছ।' (সুরা আরাফ : আয়াত ৮০-৮১)

হজরত শোয়ায়েব আলাইহিস সালামের দাওয়াত

وَ اِلٰی مَدۡیَنَ اَخَاهُمۡ شُعَیۡبًا ؕ قَالَ یٰقَوۡمِ اعۡبُدُوا اللّٰهَ مَا لَکُمۡ مِّنۡ اِلٰهٍ غَیۡرُهٗ ؕ قَدۡ جَآءَتۡکُمۡ بَیِّنَۃٌ مِّنۡ رَّبِّکُمۡ فَاَوۡفُوا الۡکَیۡلَ وَ الۡمِیۡزَانَ وَ لَا تَبۡخَسُوا النَّاسَ اَشۡیَآءَهُمۡ وَ لَا تُفۡسِدُوۡا فِی الۡاَرۡضِ بَعۡدَ اِصۡلَاحِهَا ؕ ذٰلِکُمۡ خَیۡرٌ لَّکُمۡ اِنۡ کُنۡتُمۡ مُّؤۡمِنِیۡنَ

'আমি মাদইয়ানের প্রতি তাদের ভাই শোয়ায়েবকে প্রেরণ করেছি। সে বলল- হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ব্যতিত তোমাদের কোনো উপাস্য নেই। তোমাদের কাছে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে প্রমাণ এসে গেছে। অতএব তোমরা মাপ ও ওজন পূর্ন কর এবং মানুষকে তাদের দ্রব্যাদি কম দিয়ো না এবং ভুপৃষ্টের সংস্কার সাধন করার পর তাতে অনর্থ সৃষ্টি করো না। এই হল তোমাদের জন্যে কল্যাণকর, যদি তোমরা বিশ্বাসী হও।' (সুরা আরাফ : আয়াত ৮৫)

> আল্লাহকে ভয় করলে তার নেয়ামত দান করার বিষয়টিও ওঠে এসেছে এ সুরায়। আল্লাহ বলেন-

 وَ لَوۡ اَنَّ اَهۡلَ الۡقُرٰۤی اٰمَنُوۡا وَ اتَّقَوۡا لَفَتَحۡنَا عَلَیۡهِمۡ بَرَکٰتٍ مِّنَ السَّمَآءِ وَ الۡاَرۡضِ وَ لٰکِنۡ کَذَّبُوۡا فَاَخَذۡنٰهُمۡ بِمَا کَانُوۡا یَکۡسِبُوۡنَ

'আর যদি সে জনপদের অধিবাসীরা ঈমান আনত এবং পরহেযগারী অবলম্বন করত, তবে আমি তাদের প্রতি আসমানী ও পার্থিব নেয়ামত সমূহ উম্মুক্ত করে দিতাম। কিন্তু তারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে। সুতরাং আমি তাদেরকে পাকড়াও করেছি তাদের কৃতকর্মের বদলাতে। (সুরা আরাফ : আয়াত ৯৬)

হজরত মুসা আলাইহিস সালাম

হজরত মুসা আলাইহিস সালামকে দেওয়া মুজিজাগুলো ছিল সবচেয়ে বেশি স্পষ্ট। বিশেষ করে লাঠি ও শুভ্র হাতের মোজেজা দুটি। এ জাদুকে ফেরাউন ও তার লোকেরা জাদু মনে করত। মুসার মোকাবিলার জন্য জাদুকররা এসেছিল সাপ নিয়ে। মুসা আলাইহিস সালাম-এর হাতের লাঠিটি সাপ হয়ে সেগুলোকে গিলে ফেলে। এতে জাদুকররা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে ঈমান আনে। ফেরাউন ঈমানের ‘অপরাধে’ এদের শূলে চড়ায়। আল্লাহ তাআলা বলেন-

 لَاُقَطِّعَنَّ اَیۡدِیَکُمۡ وَ اَرۡجُلَکُمۡ مِّنۡ خِلَافٍ ثُمَّ لَاُصَلِّبَنَّکُمۡ اَجۡمَعِیۡنَ

'অবশ্যই আমি কেটে দেব তোমাদের হাত ও পা বিপরীত দিক থেকে। তারপর তোমাদের সবাইকে শূলীতে চড়িয়ে মারব।' (সুরা আরাফ : আয়াত ১২৪)

> মুসা আলাইহিস সালামের দাওয়াতের প্রত্যুত্তরে ফেরাউন ও তার জাতি অহংকারের পথ বেছে নিয়েছিল। এক পর্যায়ে আল্লাহ তাআলা তাদেরকে শাস্তিতে নিপতিত করেন। তুফান, দুর্ভিক্ষ, ফল-ফসলে ঘাটতি, পঙ্গপাল, উকুন ও ব্যঙ্গের উপদ্রব এবং যাবতীয় পানিকে রক্তে পরিণত করে আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দেন। আজাব দেখলে এরা তওবা করত; কিন্তু আবার হঠকারী হয়ে যেত। আল্লাহ বলেন-

 فَاَرۡسَلۡنَا عَلَیۡهِمُ الطُّوۡفَانَ وَ الۡجَرَادَ وَ الۡقُمَّلَ وَ الضَّفَادِعَ وَ الدَّمَ اٰیٰتٍ مُّفَصَّلٰتٍ ۟ فَاسۡتَکۡبَرُوۡا وَ کَانُوۡا قَوۡمًا مُّجۡرِمِیۡنَ

'সুতরাং আমি তাদের উপর পাঠিয়ে দিলাম তুফান, পঙ্গপাল, উকুন, ব্যাঙ ও রক্ত প্রভৃতি বহুবিধ নিদর্শন একের পর এক। তারপরেও তারা গর্ব করতে থাকল। বস্তুতঃ তারা ছিল অপরাধপ্রবণ। (সুরা আরাফ : আয়াত ১৩৩)

বনি ইসরাইল ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর আল্লাহ তাআলা মুসা আলাইহিস সালামের ওপর তাওরাত কিতাব নাজিল করেন। কিন্তু নবি মুসা তাওরাত আনতে তুর পাহাড়ে গেলে সামেরি এদের গো-পূজায় লিপ্ত করে। তাছাড়া তাদের শনিবারে মাছ ধরা নিষেধ থাকলেও তারা হিলা বাহানা করে মাছ ধরত। এ কারণেও তারা শাস্তি পেয়েছিল।

এ ছাড়া মুসা আলাইহিস সালাম আল্লাহকে দেখার যে আবেদন করেছিলেন সে আবেদন ও আল্লাহর দিদারের কথাও পড়া হবে আজ। আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَ لَمَّا جَآءَ مُوۡسٰی لِمِیۡقَاتِنَا وَ کَلَّمَهٗ رَبُّهٗ ۙ قَالَ رَبِّ اَرِنِیۡۤ اَنۡظُرۡ اِلَیۡکَ ؕ قَالَ لَنۡ تَرٰىنِیۡ وَ لٰکِنِ انۡظُرۡ اِلَی الۡجَبَلِ فَاِنِ اسۡتَقَرَّ مَکَانَهٗ فَسَوۡفَ تَرٰىنِیۡ ۚ فَلَمَّا تَجَلّٰی رَبُّهٗ لِلۡجَبَلِ جَعَلَهٗ دَکًّا وَّ خَرَّ مُوۡسٰی صَعِقًا ۚ فَلَمَّاۤ اَفَاقَ قَالَ سُبۡحٰنَکَ تُبۡتُ اِلَیۡکَ وَ اَنَا اَوَّلُ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ

'তারপর মুসা যখন আমার প্রতিশ্রুত সময় অনুযায়ী এসে হাজির হলেন এবং তাঁর সাথে তার পরওয়ারদেগার কথা বললেন, তখন তিনি বললেন, হে আমার প্রভু! তোমার দিদার (দেখা) আমাকে দাও, যেন আমি তোমাকে দেখতে পাই। তিনি বললেন, তুমি আমাকে কস্মিনকালেও দেখতে পাবে না, তবে তুমি পাহাড়ের দিকে দেখতে থাক, সেটি যদি স্বস্থানে দঁড়িয়ে থাকে তবে তুমিও আমাকে দেখতে পাবে। তারপর যখন তার পরওয়ারদগার পাহাড়ের উপর আপন জ্যোতির বিকিরণ ঘটালেন, সেটিকে বিধ্বস্ত করে দিলেন এবং মূসা অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। অতপর যখন তাঁর জ্ঞান ফিরে এল; বললেন, হে প্রভু! তোমার সত্তা পবিত্র, তোমার দরবারে আমি তওবা করছি এবং আমিই সর্বপ্রথম বিশ্বাস স্থাপন করছি।' (সুরা আরাফ : আয়াত ১৪৩)

> কুরআন তেলাওয়াত শোনায়ও রয়েছে আল্লাহর রহমত। তিনি বলেন-

 وَ اِذَا قُرِیٴَ الۡقُرۡاٰنُ فَاسۡتَمِعُوۡا لَهٗ وَ اَنۡصِتُوۡا لَعَلَّکُمۡ تُرۡحَمُوۡنَ

'আর যখন কোরআন পাঠ করা হয়, তখন তাতে কান লাগিয়ে রাখ এবং নিশ্চুপ থাক যাতে তোমাদের উপর রহমত হয়।' (সুরা আরাফ : আয়াত ২০৪)

সুরা আনফাল (১-৪০)

সুরা আনফাল মদিনায় নাজিল হয়েছে। এ সুরাটির রুকু সংখ্যা ১০ এবং আয়াত সংখ্যা ৭৫। এ সুরাটিতে ঐতিহাসিক যুদ্ধের ঘটনাবলীর পর্যালোচনা করা হয়েছে। সুরাটি দ্বিতীয় হিজরির বদর যুদ্ধের পর নাজিল হয়েছে। ইসলাম ও কুফরের মধ্যে সংঘটিত এ প্রথম যুদ্ধের ওপর বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। গণিমতের মাল সম্পর্কেও এসেছে বিস্তারিত আলোচনা।

প্রথম আয়াতে গণিমতের সম্পদ বণ্টননীতি প্রসঙ্গে আলোকপাত করা হয়েছে। তারপর আল্লাহ তাআলা মুমিনদের গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা করেছেন এবং আল্লাহ তাআলা বদরের যুদ্ধে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরামকে যে সাহায্য করেছেন, তার বিবরণ উল্লেখ করেছেন। যা ছিল ইসলামের ইতিহাসের প্রথম জেহাদ ও বিজয়। যে জেহাদে আল্লাহ তাআলা মুসলমানগণকে বিজয় দান করেছিলেন। প্রথম আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন-

 یَسۡـَٔلُوۡنَکَ عَنِ الۡاَنۡفَالِ ؕ قُلِ الۡاَنۡفَالُ لِلّٰهِ وَ الرَّسُوۡلِ ۚ فَاتَّقُوا اللّٰهَ وَ اَصۡلِحُوۡا ذَاتَ بَیۡنِکُمۡ ۪ وَ اَطِیۡعُوا اللّٰهَ وَ رَسُوۡلَهٗۤ اِنۡ کُنۡتُمۡ مُّؤۡمِنِیۡنَ

'লোকেরা তোমাকে গনীমতের মাল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে; বল, গনীমতের মাল আল্লাহ ও রাসূলের জন্য। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং পরস্পরের মধ্যকার অবস্থা সংশোধন করে নাও। আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর, যদি তোমরা মুমিন হও।' (সুরা আনফাল : আয়াত ১)

আল্লাহর স্মরণে মুমিনের হৃদয়ের অবস্থা কেমন হয় তা দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ তাআলা এভাবে তুলে ধরেছেন-

 اِنَّمَا الۡمُؤۡمِنُوۡنَ الَّذِیۡنَ اِذَا ذُکِرَ اللّٰهُ وَجِلَتۡ قُلُوۡبُهُمۡ وَ اِذَا تُلِیَتۡ عَلَیۡهِمۡ اٰیٰتُهٗ زَادَتۡهُمۡ اِیۡمَانًا وَّ عَلٰی رَبِّهِمۡ یَتَوَکَّلُوۡنَ

'মুমিন তো তারা, যাদের অন্তরসমূহ কেঁপে উঠে যখন আল্লাহকে স্মরণ করা হয়। আর যখন তাদের উপর তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করা হয় তখন তা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করে এবং যারা তাদের রবের উপরই ভরসা করে।' (সুরা আনফাল : আয়াত ২)

প্রকৃত মুমিন কারা?- এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা পরবর্তী একাধিক আয়াতে তা এভাবে বলা হয়েছে যে-

الَّذِينَ يُقِيمُونَ الصَّلاَةَ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنفِقُونَ

'সে সমস্ত লোক যারা নামায প্রতিষ্ঠা করে এবং আমি তাদেরকে যে রুযী দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে।' (সুরা আনফাল :  আয়াত ৩)

أُوْلَـئِكَ هُمُ الْمُؤْمِنُونَ حَقًّا لَّهُمْ دَرَجَاتٌ عِندَ رَبِّهِمْ وَمَغْفِرَةٌ وَرِزْقٌ كَرِيمٌ

'তারাই হল সত্যিকার ঈমানদার! তাদের জন্য রয়েছে স্বীয় প্রভুর কাছে মর্যাদা, ক্ষমা এবং সম্মানজনক রুজি।' (সুরা আনফাল : আয়াত ৪)

আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের দেওয়া দিক-নির্দেশনা তথা আমানতের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। আল্লাহ তাআলা কোরআনুল কারিমে ঈমানদের উদ্দেশ্য করে ঘোষণা করেন-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ لاَ تَخُونُواْ اللّهَ وَالرَّسُولَ وَتَخُونُواْ أَمَانَاتِكُمْ وَأَنتُمْ تَعْلَمُونَ

'হে ঈমানদারগণ! খেয়ানত করোনা আল্লাহর সঙ্গে ও রাসুলের সাথে এবং খেয়ানত করো না নিজেদের পারস্পরিক আমানতে জেনে-শুনে।' (সুরা আনফাল : আয়াত ২৭)

وَاعْلَمُواْ أَنَّمَا أَمْوَالُكُمْ وَأَوْلاَدُكُمْ فِتْنَةٌ وَأَنَّ اللّهَ عِندَهُ أَجْرٌ عَظِيمٌ

'আর জেনে রাখ, তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি অকল্যাণের সম্মুখীনকারী। বস্তুতঃ আল্লাহর কাছে রয়েছে মহা সওয়াব।' (সুরা আনফাল : ২৮)

আল্লাহ তআলা মুসলিম উম্মাহকে কুরআন বুঝে পড়ার এবং তাঁর ওপর আমল করার পাশাপাশি নিজেদের আকিদা-বিশ্বাসকে শিরকমুক্ত রাখার তাওফিক দান করুন। আমিন।

এমএমএস/জিকেএস