দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) হটলাইন নম্বর ও চিঠির মাধ্যমে আসা ব্যক্তি বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ক্রমেই কমছে। অন্যদিকে, করোনার অজুহাতে অভিযানও কমিয়েছে সংস্থাটির এনফোর্সমেন্ট ইউনিট। মামলা ও দুর্নীতিবাজদের সম্পদ জব্দে গতি থাকলেও নবগঠিত গোয়েন্দা ইউনিট চলছে ধীরগতিতে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা ও লোকবলের অভাবে দুদকের প্রতিরোধমূলক কাজে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।
Advertisement
সম্প্রতি দুদক প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদন দেখা যায়, গত তিন বছরের মধ্যে ২০২১ সালে সবচেয়ে কম অভিযোগ জমা পড়েছে দুদকে। প্রাপ্ত অভিযোগের মধ্যে মাত্র সাড়ে তিন শতাংশ অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করেছে দুদক। ওই বছর ১৪ হাজার ৭৮৯টি অভিযোগের মধ্যে মাত্র ৫৩৩টি অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করে সংস্থাটি। আর ২০২০ সালে ১৮ হাজার ৪৮৯টি অভিযোগের মধ্যে গ্রহণ হয় ৮২২টি। ২০১৯ সালে অভিযোগ জমা পড়ে ২১ হাজার ৩৭১টি।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-দুর্নীতি হাতেনাতে ধরতে ও ব্যবস্থা নিতে কমিশনের এনফোর্সমেন্ট ইউনিট ২০১৯ সাল থেকে সাংগঠনিক কাঠামোতে যুক্ত হয়। সে বছর এক হাজার একটি অভিযোগ পরিচালনা করে এনফোর্সমেন্ট ইউনিট। তবে ২০২০ সালে ৪৮৭টি ও ২০২১ সালে ২৪৫টি অভিযান পরিচালনা করেছে এনফোর্সমেন্ট।
অন্যদিকে, ২০১৮ সাল থেকে গোয়েন্দা ইউনিট কমিশনের সাংগঠনিক কাঠামোতে যুক্ত হয়েছে। ২০২১ সালের শেষ পর্যন্ত মোট ৬৬৫টি অভিযোগ গোপনে তথ্যানুসন্ধানের জন্য গৃহীত হয়, যার মধ্যে ২৫০টির নিষ্পত্তি হয়েছে এবং ৪১৫টি অভিযোগের গোপন তথ্যানুসন্ধান চলমান। তথ্যানুসন্ধানের পর গোয়েন্দা প্রতিবেদনের সুপারিশের ভিত্তিতে কমিশন চেয়ারম্যানের অনুমোদনক্রমে ১৫৪টি অভিযোগ প্রকাশ্য অনুসন্ধানের জন্য পাঠানো হয়েছে।
Advertisement
অভিযোগ অনুসন্ধানের হার কম হওয়ার বিষয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দুদক কমিশনার মোজাম্মেল হক খান বলেন, তদন্তকারী কর্মকর্তা স্বল্পতার জন্য বেশি অনুসন্ধান করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে দুদক একটি বড় নিয়োগের কাজ শেষ করেছে। এই প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হলে দুদকের কর্মতৎপরতা দিগুণ হয়ে যাবে। তখন এই সময়ের চেয়ে অনেক বেশি কাজ করতে পারবে দুদক।
তবে সক্ষমতার ঘাটতির কারণে দুদকের অভিযোগ ও অভিযান কমছে বলে মনে করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।
জাগো নিউজকে তিনি বলেন, সক্ষমতার ঘাটতি থাকায় অভিযান কমেছে। অন্যদিকে অভিযোগকারীরা প্রত্যাশা অনুযায়ী প্রতিকার পাচ্ছেন না। এ কারণেও অভিযোগ কমতে পারে। দুদকের উচিত আরও কার্যকরভাবে অভিযান পরিচালনা করা।
যদিও লোকবল বাড়ানোর কাজ করছে দুদক। এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদ্যমান সাংগঠনিক কাঠামোর আওতায় গত জানুয়ারিতে কক্সবাজার জেলা কার্যালয় কাজ শুরু করেছে। এছাড়া আগামী ১ জুলাইয়ে কার্যক্রম শুরুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে আরও ১৩টি জেলা কার্যালয়ের। সাংগঠনিক কাঠামোতে বিদ্যমান জনবল পূরণের অংশ হিসেবে ১৩২ জন সহকারী পরিচালক ও ১৪৭ জন উপ-সহকারী পরিচালক নিয়োগ প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে। একই সঙ্গে অন্যান্য পদের নিয়োগ প্রক্রিয়াও চলমান।
Advertisement
২০২০ সালে ছয়জন উপ-সহকারী পরিচালককে পদোন্নতি দিয়ে সহকারী পরিচালক করা হয়েছে। নতুন কমিশন দায়িত্ব গ্রহণের পর ২০২১ সালে ৩৪ জন সহকারী পরিচালককে পদোন্নতি দিয়ে উপ-পরিচালক, ৪৫ জন উপ-সহকারী পরিচালককে পদোন্নতি দিয়ে সহকারী পরিচালক ও পাঁচজন সাঁটলিপিকার কাম কম্পিউটার অপারেটরকে উপ-সহকারী পরিচালক পদে উন্নীত করা হয়েছে।
দুর্নীতিবাজদের ৫০৭ কোটি টাকার সম্পদ ক্রোক, মামলা নিষ্পত্তিতে সাফল্য
২০২০ ও ২০২১ সালে দুর্নীতিবাজদের প্রায় ৫০৭ কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ক্রোক ও দুর্নীতির সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়ায় এক হাজার ৩১৪ কোটি টাকার বেশি সম্পদ অবরুদ্ধ করা হয়েছে। দুদকের সম্পদ ব্যবস্থাপনা ইউনিট ওই সম্পদ দেখভাল করছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুদকের সম্পদ ব্যবস্থাপনা ইউনিটের অধীনে ২০২০ সালে আদালতের আদেশে ১৮০ কোটি ১১ লাখ ৯১ হাজার ৭৪৬ টাকার সম্পত্তি ক্রোক করা হয়েছে। একই সঙ্গে ১৫২ কোটি ৯২ লাখ ৮৬ হাজার ৪৯৬ টাকা অবরুদ্ধ করেছে। আর ২০২১ সালে ৩২৬ কোটি ৭১ লাখ ৪৬ হাজার ৬২৮ টাকার সম্পত্তি ক্রোক ও এক হাজার ১৬১ কোটি ৫৮ লাখ ১৪ হাজার ৪৮০ টাকার পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অবরুদ্ধ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিচারাধীন মামলার নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে কমিশনের সাফল্য অব্যাহত রয়েছে। ২০২০ সালে নিম্ন আদালতে দুদক ও বিলুপ্ত ব্যুরোর মোট বিচারাধীন তিন হাজার তিনশ ৮২টি মামলার মধ্যে একশ ৭৬টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। যার মধ্যে কমিশনের পক্ষে রায় হয়েছে একশ ২১টিতে। কমিশনের মামলায় সাজার হার ৭২ শতাংশ ও বিলুপ্ত ব্যুরোর মামলায় সাজার হার ৪৮ শতাংশ। অর্থাৎ গড়ে সাজার হার শতকরা ৬৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ। আবার ২০২১ সালে মোট তিন হাজার চারশ ৩৪টি মামলার মধ্যে দুইশ তিনটি নিষ্পত্তি হয়েছে। যার মধ্যে কমিশনের পক্ষে রায় হয়েছে ১১৯টিতে। কমিশনের মামলায় সাজার হার ৬০ শতাংশ ও বিলুপ্ত ব্যুরোর মামলায় সাজার হার ৩০ শতাংশ। অর্থাৎ গড়ে সাজার হার শতকরা ৫৮ দশমিক ৬২ শতাংশ।
ছোট দুর্নীতেই দুদকের আগ্রহ বেশি বলে মন্তব্য করেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার।
জাগো নিউজকে তিনি বলেন, দুদক চুনোপুঁটিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। রাঘববোয়ালদের ছেড়ে দেয়। এটার প্রতিফলন তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়। ছোটখাটো যারা সামনে পড়ছে দুদক তাদের ধরেছে অথচ অনেক বড় দুর্নীতিবাজরা ছাড় পাচ্ছে। মেগা প্রকল্পসহ সরকারি-বেসরকারি কাজে দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে দুদককে আরও বেশি অভিযান পরিচালনা করতে হবে, দুদককে আরও বেশি কার্যকর করতে হবে।
দুদকের কাজে ধীরগতি আসছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে সচিব মো. মাহবুব হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, কোথাও কোনো ঘটনা যদি ঘটলে প্রথমে তথ্য পাওয়ার চেষ্টা করি। যাচাই-বাছাই করি, কর্মপদ্ধতি তৈরি করি। তথ্য প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এখন আমরা থেমে নেই। কোনো কারণে থামার কোনো সম্ভাবনাও নেই। দুর্নীতিবাজদের ধরতে আমাদের এনফোর্সমেন্ট টিম ২৪ ঘণ্টা তৈরি থাকে। প্রতিদিনই আমাদের অভিযান চলছে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের টোল ফ্রি যে নম্বর রয়েছে ১০৬, এই নম্বরে ২০২০ ও ২০২১ সালে ১ লাখ ১৩ হাজার ৭৭৩টি কল এসেছে। এর মধ্য থেকে ২ হাজার ৪৪৯টি অভিযোগ আমলে নেওয়া হয়েছে। কেউ যদি দুর্নীতি বা অনিয়ম করে আমাদের বিধান মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
বার্ষিক প্রতিবেদনে সরকারি পাঁচ প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতির ৫৪টি উৎসের কথা জানিয়েছে দুদক। দুর্নীতি ঠেকাতে দিয়েছে একাধিক সুপারিশ। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরে ১০টি, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ছয়টি, সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে ১০টি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মৎস্য খাতে ১৩টি এবং প্রাণিসম্পদ খাতে দুর্নীতির ২৮টি উৎসের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
এসএম/আরএডি/এএ/এএসএম