বিশেষ প্রতিবেদন

প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি বাড়ালে ত্বরান্বিত হবে উন্নয়ন

বৈদেশিক ঋণের বোঝা কমাতে প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি ত্বরান্বিত করার বিষয়ে মত দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন করলে ঋণের টাকাও দ্রুত খরচ করা সম্ভব হবে। এতে কমবে পাইপলাইনে থাকা ঋণ।

Advertisement

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, বছর বছর বাড়তে বাড়তে ফুলে-ফেঁপে উঠেছে পাইপলাইনে থাকা ঋণ। চলতি অর্থবছরও (২০২১-২২) বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পের (এডিপি) অর্থ ব্যবহার করতে না পারায় ঋণসহায়তা কমেছে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার বা ১৭ হাজার ৭৭৪ কোটি টাকা।

ইআরডি সূত্র জানায়, বর্তমানে পাইপলাইনে থাকা বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ৬০ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে এ পরিমাণ ছিল ৫১ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলার। ফলে এক বছরের ব্যবধানে ৯ বিলিয়ন ডলার বেড়েছে পাইপলাইনে থাকা বৈদেশিক ঋণ। এর মধ্যে ইআরডির মাধ্যমে চুক্তি হয়েছে ৫০ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার এবং অন্যান্য স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে চুক্তি হয় ৯ বিলিয়ন ডলারের।

পাইপলাইনে থাকা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের ঋণস্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এয়ারক্রাফটের এক বিলিয়ন, ক্রুড অয়েলের জন্য ৪৪৩ মিলিয়ন, বিদ্যুতের জন্য পাঁচ বিলিয়ন, বাংলাদেশ ব্যাংককে দেওয়া আইএমএফ’র দুই বিলিয়ন, বিটিআরসির ১২৮ মিলিয়ন এবং কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) ৪৯৫ মার্কিন ডলার রয়েছে। এসব সংস্থার গত অর্থবছরে পাইপলাইনে পড়েছিল সাত বিলিয়ন, যা এবার দুই বিলিয়ন ডলার বেড়েছে। এভাবে প্রতিবছরই বৈদেশিক ঋণের বোঝা বাড়ছে পাইপলাইনে।

Advertisement

সংশ্লিষ্টরা জানান, স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত ইআরডির মাধ্যমে মোট ঋণচুক্তি হয়েছে ১২৭ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ছাড় হয়েছে ৭২ বিলিয়ন এবং পাইপলাইনে পড়ে রয়েছে ৫০ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে স্বাধীনতার পর থেকে মোট বৈদেশিক অনুদানের প্রতিশ্রুতি এসেছে ৩৪ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ছাড় হয়েছে ২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাকি ছয় বিলিয়ন ডলারের অনুদান পড়ে রয়েছে পাইপলাইনেই।

উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে সরকার প্রতি বছর কতটি ঋণচুক্তি করছে, আর কী পরিমাণ অর্থ ছাড় হচ্ছে, তা বিশ্লেষণ করা হয়েছে ইআরডির একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে। এতে দেখা গেছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে মোট ৭০৫ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি সই হয়েছে। ওই বছর ছাড় হয়েছে ৩৫৬ কোটি ডলার। ২০১৬-১৭ অর্থবছর ১ হাজার ৭৯৬ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি সই হয়। সে বছর ৩৬২ কোটি ডলার ছাড় হয়। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চুক্তি হওয়া ১ হাজার ৪৮৯ ডলারের মধ্যে ছাড় হয়েছে ৬৩৬ কোটি ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সই হওয়া ৯৯১ কোটি ডলার থেকে ছাড় হয় ৬২৬ কোটি ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি এসেছে সাড়ে ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ছাড় হয়েছে ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

বৈদেশিক ঋণের মধ্যে ৫০ দশমিক ২১২ বিলিয়ন ডলার এসেছে প্রজেক্ট সহায়তার জন্য। এছাড়া ১৩৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খাদ্যখাতে ঋণ এসেছে। তবে কমোডিটি এইডে কোনো ঋণ আসেনি।

পাইপলাইনে কোন দেশের কতপাইপলাইনে সবচেয়ে বেশি আছে জাপানের দেওয়া ঋণ। এর পরিমাণ প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলার। সাড়ে ছয় বিলিয়ন ডলার ভারত এবং চীনের আছে প্রায় চার বিলিয়ন ডলার। এছাড়া এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) এক বিলিয়ন, এশীয় পরিকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংকের (এআইআইবি) ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন, বিশ্বব্যাংকের ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন, আইডিবির পাঁচ বিলিয়ন এবং রাশিয়ার প্রতিশ্রুত আট বিলিয়ন ডলার ঋণ পাইপলাইনে পড়ে রয়েছে।

Advertisement

ইআরডির অতিরিক্ত সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসহ বর্তমানে ৬০ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ পাইপলাইনে রয়েছে। প্রতি বছর ১০ বিলিয়ন ডলার করে খরচ করলেও ছয় বছর লাগবে। কিন্তু বৈদেশিক ঋণ ব্যবহারের সক্ষমতা কম। ফলে প্রতি বছরই পাইপলাইনে বৈদেশিক ঋণ থেকে যাচ্ছে।

অদক্ষতায় প্রকল্প থেকে বাদ গেলো বৈদেশিক ঋণঋণ ব্যবহারের অদক্ষতা ও বৈদেশিক পলিসি মেনে চলাসহ নানান কারণে বিদেশি ঋণ ব্যবহার করা যাচ্ছে না সময়মতো। যেমন- প্রকল্পের নির্ধারিত চার বছর মেয়াদ শেষ হলেও যশোর, কক্সবাজার, নোয়াখালী ও পাবনার বিদ্যমান মেডিকেল কলেজের জন্য ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরুই করা যায়নি। ফলে এসব প্রকল্প থেকে ঋণ বাতিল করেছে ভারত। এ কারণে নতুন করে সম্পূর্ণ দেশীয় অর্থায়নে শুরু হচ্ছে এ প্রকল্পের কাজ। ফলে বাড়ছে প্রকল্পের সময়-ব্যয়।

পরিকল্পনা কমিশন থেকে জানা যায়, ‘এস্টাবলিশমেন্ট অব ৫০০ বেডেড হাসপাতাল ও এনসিলারি ভবন ইন পাবনা, যশোর, কক্সবাজার ও আব্দুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড জননেতা নুরুল হক আধুনিক হাসপাতাল, নোয়াখালী’ প্রকল্পের আওতায় এ ঘটনা ঘটেছে। প্রকল্পটি ২০১৮ সালের মে মাসে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদিত হয়। প্রকল্পের অনুমোদিত প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল দুই হাজার ১০৩ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি অর্থায়ন ছিল ৬৬৩ কোটি ৩২ লাখ এবং ভারতীয় ঋণ ছিল এক হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। জুন ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে দুই কোটি ৩৬ লাখ টাকা, যা প্রকল্পের মোট ব্যয়ের মাত্র ০ দশমিক ৩৬ শতাংশ। তবে অবকাঠামোগত অগ্রগতি শূন্য।

পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের উপ-প্রধান (স্বাস্থ্য উইং) ড. মোহাম্মদ আমজাদ হোসেন এ বিষয়ে জাগো নিউজকে বলেন, প্রকল্পটি সংশোধন প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। ঋণে ভারতের কিছু শর্ত ছিল, সেটা পূরণ হয়নি। প্রকল্পটি এখন সরকারি অর্থায়নে বাস্তবায়ন করা হবে। প্রকল্প থেকে ভারতীয় ঋণ বাদ পড়ছে। প্রথম সংশোধনীতে প্রকল্পটির মোট ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে দুই হাজার ৭৮১ কোটি ৭৬ লাখ টাকা, যা সম্পূর্ণ সরকারি খাত থেকে ব্যয় করা হবে।

পাইপলাইনে আটকা ঋণের এই দশা নিয়ে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে যেভাবে কমিটমেন্ট আদায় করা হয় সেভাবে ছাড় করা হয় না।

বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ব্যবহার না বাড়লে নতুন প্রতিশ্রুতি বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। দাতাদেরও কান্ট্রি ওয়াইজ একটা টার্গেট থাকে কোন দেশকে কোন প্রকল্পে ঋণ দেওয়া যায়। সরকারেরও এ বিষয়ে ইন্টারেস্ট থাকে। এসব কারণেই পাইপলাইনে ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। দাতারা পাস করলে পাইপলাইনে ঢুকে যায়। দেখা যায় পাঁচ বছর মেয়াদি প্রকল্প বাস্তবায়নে অনেক সময় আট বছর লাগে। নতুন কমিটমেন্ট বাড়ে। অর্থ থাকার পরও ব্যবহার হয় না। যতটা চতুরতার সঙ্গে কমিটমেন্ট আদায় করি ততটা চতুরতার সঙ্গে ডিসবার্সমেন্ট করতে পারি না।

‘প্রতি বছর পাইপলাইনে ফুলতেই থাকে ঋণ। প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি বাড়াতে হবে। বাস্তবায়ন দ্রুততার সঙ্গে করতে হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে সময় বেশি লাগে, এটা বন্ধ হতে হবে। অনেক সময় দেশি টাকা ব্যবহারে যতটা পারদর্শী, বিদেশি টাকা ব্যবহারে ততটাই অদক্ষতা দেখা যায়।’

ড. জাহিদ হোসেন আরও বলেন, অনেক বড় বড় দাতা কমিটমেন্ট চার্জ মাফ করে দেয়। অনেকে আবার কমিটমেন্ট চার্জ নেয়। যেমন- কমিটমেন্ট চার্জ নেয় চীন। এটা হলে কিন্তু সমস্যা। তাহলে বাংলাদেশকে লোকসান গুনতে হবে। সাধারণত ০ দশমিক ২৫ থেকে ০ দশমিক ৫ স্ট্যান্ডার্ড কমিটমেন্ট চার্জ। এই চার্জ সবাই নিতে থাকলে বাংলাদেশের জন্য বিপদ।

এমওএস/এমএইচআর/এএ/জেআইএম