ধর্ম

চূড়ান্ত সফলতা পেতে কোরআনের নির্দেশ ও দোয়া

কোরআনের হেদায়েত পাওয়ার মাস রমজান। মহান আল্লাহ তাআলার ঘোষণা এটি। তারাবি নামাজে চমৎকার সব আলোচনা, ঘটনায় মোড়ানো কোরআন তেলাওয়াতে মুখরিত তামাম দুনিয়ার মসজিদ। প্রথম তারাবিতে মহান আল্লাহ কত প্রাণবন্ত ঘোষণা দিয়েছেন-

Advertisement

شَهۡرُ رَمَضَانَ الَّذِیۡۤ اُنۡزِلَ فِیۡهِ الۡقُرۡاٰنُ هُدًی لِّلنَّاسِ وَ بَیِّنٰتٍ مِّنَ الۡهُدٰی وَ الۡفُرۡقَانِ ۚ فَمَنۡ شَهِدَ مِنۡکُمُ الشَّهۡرَ فَلۡیَصُمۡهُ

'রমজান মাস, এ মাসে কোরআন নাজিল করা হয়েছে মানুষের হেদায়াতের জন্য এবং হেদায়তের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে এ মাস পাবে সে যেন এ মাসে সিয়াম পালন করে।'

আজ ০৩ এপ্রিল রোববার। প্রথম রমজান অতিবাহিত হলো। সন্ধ্যায় পড়া রমজানের দ্বিতীয় তারাবি। সুরা বাকারার ২০৪নং আয়াত থেকে সুরা আল-ইমরানের ৯১ আয়াত পর্যন্ত পড়া হবে আজ। তারাবি নামাজের শুরুতেই পরিপূর্ণভাবে ইসলামের প্রবেশ আহ্বান থাকবে। মহান আল্লাহ তাআলা এভাবে জোরালো নির্দেশ দিয়েছেন যে-

Advertisement

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ ادْخُلُواْ فِي السِّلْمِ كَآفَّةً وَلاَ تَتَّبِعُواْ خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِينٌ

‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করো; আর শয়তানের পথ অনুসরণ করো না। নিশ্চিত রূপে সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ২০৮)

আয়াতে মহান আল্লাহ তাআলা ঈমানদারদের লক্ষ্য করে এ মর্মে নির্দেশ দিয়েছেন যে, তোমরা ইসলামে পরিপূর্ণরূপে প্রবেশ করো। এমনটি যেন না হয়, যে নির্দেশগুলো তোমাদের স্বার্থ ও মন মতো হবে, সেগুলোর উপর আমল করবে এবং অন্যান্য নির্দেশগুলো ত্যাগ করবে। আবার ইসলাম গ্রহণের আগে যে দ্বীন তোমরা ছেড়ে এসেছো, সে দ্বীনের কথাও ইসলামে প্রবেশ করানোর অপচেষ্টা করো না; বরং শুধু ইসলামকেই পূর্ণরূপে বরণ করে নাও। মুমিন মুসলমানের জন্য এমন প্রাণবন্ত নির্দেশ থেকে উত্তম নির্দেশনা আর কী হতে পারে!

এ আয়াতে দ্বীনের নামে বিদআতেরও খন্ডন করা হয়েছে। যারা ইসলামকে সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয় বরং দ্বীনকে কেবল (ব্যক্তিগত) ইবাদত অর্থাৎ, মসজিদে সীমাবদ্ধ রাখতে চায় তাদের প্রতিও ইসলামের এ আহ্বান করা হয়েছে।

Advertisement

এইভাবে মুমিন মুসলমানকেও বুঝানো হচ্ছে যে, যারা প্রচলিত প্রথা ও লোকাচার এবং আঞ্চলিক সভ্যতা-সংস্কৃতিকে পছন্দ করে, কোনো মতেই তারা এগুলোকে ত্যাগ করতে প্রস্তুত নয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে- মৃত্যু ও বিবাহ-শাদীতে ব্যয়বহুল ও অপচয়মূলক এবং বিজাতীয় রীতিনীতি ইত্যাদির অনুকরণ করে। বরং তাদের বলা হচ্ছে যে, তোমরা সেই শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না, যে ইসলাম পরিপন্থী কথা ও কর্মকে লোভনীয় ও শোভনীয় ভঙ্গীতে তোমাদের সামনে উপস্থাপন করে। যে মন্দের উপর খুব ভালোর লেবেল লাগিয়ে বেড়ায়। বিদআতকে নেকির কাজ বলে চালিয়ে দেয়।

মনে রাখত হবে

কোরআন নাজিলের মাসও রমজান। এ মাসের  প্রশিক্ষণ গ্রহণে ইসলামে পরিপূর্ণভাবে প্রবেশই হবে মুমিনের প্রথম ও প্রধান কাজ। কেননা ইসলামে পরিপূর্ণ প্রবেশেই মিলবে কোরআনের হেদায়েত।

মুমিন মুসলমান এক আল্লাহর ওপর বিশ্বাস করে। তার সন্তুষ্টি অর্জনে দিনরাত ইবাদত-বন্দেগি তথা দিনের সিয়াম সাধনা (রোজা) রাতের কিয়াম তথা তারাবি-তাহাজ্জুদে মগ্ন থাকে। পারস্পরিক লেনদেন, আচার-ব্যবহার, স্বভাব-আচরণ প্রকাশেও থাকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের প্রচেষ্টা। তাই জীবন পরিচালনায় হাদিসের আমল হবে এমন-

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘হে আনাস! তোমার পক্ষে যদি সম্ভব হয়, তুমি সকাল-সন্ধ্যা এমনভাবে অতিবাহিত করবে, তোমার অন্তরে কারও প্রতি কোনোরূপ বিদ্বেষ থাকবে না। তাহলে তুমি তাই কর। (এটাই তোমার জন্য কল্যাণকর)। কারণ এমন ধারণা পোষণ করা আমার সুন্নত। যে আমার সুন্নতকে জিন্দা করে সে যেন আমাকেই ভালোবাসে। আর যে আমাকে ভালোবাসে সে পরকালে আমার সঙ্গে জান্নাতে থাকবে।’ (তিরমিজি)

সব মানুষকেই একদিন মরতে হবে। আল্লাহর সামনে দাঁড়ানোর আগে পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করে নিজেদের পস্তুতি গ্রহণের যেমন বিকল্প নেই। তেমনি কোরআন নাজিলের মাস রমজানে নিজেদের ইসলামের বিধানে জড়িয়ে নিয়ে তারই কাছে ফিরে যেতে হবে। আর তাতেই মিলবে চূড়ান্ত সফলতা।

আজকের তারাবিতে পড়া হবে চমৎকার দোয়া। ইসলামের ওপর অটল ও অবিচল থাকতে মহান শেখানো দোয়ার চেয়ে উত্তম দোয়া আর কী হতে পারে। শুধু তাই নয়, এ দোয়ার আবেদনও চমৎকার। ইসলামের হেদায়েত পেয়ে এর ওপর অটল ও অবিচল থাকার দোয়া  এটি। স্বয়ং মহান রাব্বুল আলামিন শিখিয়েছেন দোয়া। রোজাদার মুমিন মুসলান এভবে দোয়া পড়বে-

رَبَّنَا لاَ تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِن لَّدُنكَ رَحْمَةً إِنَّكَ أَنتَ الْوَهَّابُ

‘হে আমাদের পালনকর্তা! সঠিক পথ দেখানোর পর তুমি আমাদের অন্তরকে সত্যলংঘনে প্রবৃত্ত করো না এবং তোমার কাছ থেকে আমাদের রহমত (মহাঅনুগ্রহ) দান কর। তুমিই সব কিছুর দাতা।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ৮)

আজকের দ্বিতীয় তারাবিতে আরও যেসব বিধিবিধান ও নির্দেশনা পড়া হবে; তাহলো-

> আয়াত ২০৪-২১৪

ইসলামের সামাজিক অবস্থার চিত্র তথা মুমিনের প্রকৃত পরিচয়, ইয়াহুদি জাতির ধ্বংসের কারণ এবং মুশরিকদের বিপরীতমুখী দৃষ্টিভঙ্গি প্রসঙ্গে বর্ণনা রয়েছে। মুসলিম উম্মাহর ঐক্যবদ্ধের মূলনীতি ঘোষণাপূর্বক জান্নাত পাওয়ার মিথ্যার আশ্বাসে লোভ-লালসা ও বিভ্রান্তিমূলক বর্ণনার বিষয়ে সতর্কতা রয়েছে।

> আয়াত ২১৫-২২০

দান-সাদকার অগ্রাধিকারভুক্ত খাতের উল্লেখ, ইসলামে জিহাদের গুরুত্ব, আল্লাহর মাসসমূহের মধ্যে সম্মানিত মাসের বিধান ও তাৎপর্যের বর্ণনা রয়েছে। মদ-জুয়া নিষিদ্ধে প্রথম কর্মসূচি ঘোষণা এবং দান-সাদকার পরিমাণ ও মাত্রা এবং ইয়াতিমের সম্পদ ব্যয় নির্বাহ ও অধিকার সংরক্ষণের বিবরণ রয়েছে।

> আয়াত ২২১-২৪২

মানুষের পারিবারিক জীবনের নীতিমালায় ইসলামে বিবাহের বিধান, যৌন জীবন, বিধর্মী ও মুশরিক নারী পুরুষকে বিবাহের বিধান, মহিলাদের ঋতুস্রাবের বিধান, শপথ সংক্রান্ত সতর্কতার বিধান ওঠে এসেছে।

স্বামী-স্ত্রীর ইলা’র বিধান, তালাকের বিধান ও মোহর, তালাক পরবর্তী হিল্লা বিয়ে সংক্রান্ত বিষয় ওঠে এসেছে।

সন্তানদের স্তন্যদানের বিষয়, বিধবা বা তালাকপ্রাপ্তা নারীর ইদ্দতকাল এবং বিধবার প্রতি ইসলামের উদারতা ও তাদের অধিকার সংরক্ষণে ইসলামি নীতি আলোচিত হয়েছে।

> আয়াত ২৪৩-২৫৮

ইয়াহুদিদের চরম হঠকারিতা, আল্লাহর পথে জিহাদ ও তার নেতৃত্বের সুফল, জালেমকে দিয়ে জালেমদের দমনের বিষয়টি ওঠে এসেছে। রিসালাত ও নবুয়ত প্রসঙ্গে নবীগণের মধ্যে পারস্পরিক মর্যাদার তারতম্য এবং কোরআনুল কারিমের সবচেয়ে বড় আয়াত ‘আয়াতুল কুরসি’ মধ্যে মহান আল্লাহ তাআলা অনেকগুলো গুণের আলোচনা এসেছে। ইসলামের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণে তাগুত বর্জন ঈমানের পূর্বশর্ত ও ব্যক্তি স্বাধীনতার আলোচনা রয়েছে।

> আয়াত ২৫৯-২৮৬

সর্বোপরি এ সুরায় সুদের মতো মারাত্মক ব্যাধির গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা রয়েছে। ব্যবসা ও সুদের নীতিগত পার্থক্য, সুদের অর্থনৈতিক ক্ষতি, সুদের শাস্তি ঘোষিত হয়েছে।

সুরার শেষাংশে লেনদেন ও চুক্তি সংক্রান্ত বিধিবিধানের পাশাপাশি ইসলামের সাক্ষ্য আইন, মেয়াদি ঋণ সংক্রান্ত নীতিমালা এবং বন্ধকীঋণ সংক্রান্ত নীতিমালার বিবরণ রয়েছে। আরও রয়েছে ঈমানের সঠিক রূপ-রেখার আলোচনা।

সুরা আল-ইমরান

সুরা আল-ইমরান মাদানি সুরা। এ সুরার সব আয়াতই হিজরতের পর বিভিন্ন সময়ে নাজিল হয়। ২০ রুকুর এ সুরাটির আয়াত সংখ্যা ২০০। এ সুরায় দু’টি দলকে সম্বোধন করা হয়েছে। একটি হলো আহলে কিতাব আর দ্বিতীয় দলটি হলো যারা প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর ঈমান গ্রহণ করেছিলেন।

> আয়াত ১-৩২

এ সুরায় আল্লাহ তাআলা তাওহিদের বিষয়ে অতিতের আসমানী কিতাবের রেফারেন্সসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরছেন।

পৌত্তলিকতা, খ্রিস্টবাদ ও আল্লাহর একত্ববাদের আলোচনা, তাওরাত ও ইঞ্জিলের ঐতিহাসিক পটভূমি, সব রিসালাতের উৎসের বিষয়ে বর্ণনা রয়েছে।

কোরআনে মুহকামাত ও মুতাশাবিহাত আয়াতের আলোচনাও রয়েছে। মুমিনের গুণাবলী ও তাঁদের প্রতি আল্লাহর সাহায্যের পাশাপাশি ইসলামের সামগ্রিক আলোচনা ও আমল ধ্বংস হওয়ার কারণ এবং বিধর্মীদের সঙ্গে বন্ধুত্বের ব্যাপারে নসিহত এবং আল্লাহ তাআলার সার্বভৌম ক্ষমতার বিষয় ওঠে এসেছে।

> আয়াত ৩২-৬৪

পূর্ববর্তী নবি রাসুলসহ অনেক মহীয়সী ব্যক্তিত্বের জীবনাচরণ ইবাদত-বন্দেগি ও মর্যাদা এবং শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা রয়েছে এ আয়াতগুলোতে। বিবি মরিয়ম ও হজরত ইসা আলাইহিস সালামের জন্ম, প্রেক্ষাপট, মুযিজা, নবুয়তি মিশন এবং ইসা আলাইহিস সালামকে হত্যায় ইয়াহুদিদের ষড়যন্ত ও মুবাহালার বিষয়ে বর্ণনা রয়েছে।

> আয়াত ৬৫-৯১

মুসলিম জাতির ঐক্য এবং মুসলমানদের ছদ্মাবরণে ইয়াহুদি ও ইসলাম বিদ্বেষীদের ষড়যন্ত্রসহ নৈতিকতার প্রশ্নে ইয়াহুদি ও খ্রিস্টানদের অবস্থান বিষয়ক আলোচনা রয়েছে।

শেষের আয়াতগুলোর দিকে আল্লাহর সঙ্গে নবিদের ওয়াদা এবং আল্লাহ তাআলা অবাধ্যতাকারী মুরতাদের তাওবা প্রসঙ্গে বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে খতম তারাবি নামাজে আদায় করার এবং কোরআনের আজকের অংশ বুঝে পড়ার তাওফিক দান করুন। কোরআন অনুযায়ী আমলি জিন্দেগি যাপন করার তাওফিক দান করুন। মুমিন মুসলমানের হৃদয়ে কোরআনের নূর সৃষ্টি করে দিন। আমিন।

এমএমএস/এএসএম