ধর্ম

ইবাদতের মাস রমজান

মোহাম্মদ হাসিব উল্লাহ

Advertisement

রমজান মাস। মুসলিম জাতির কাছে সবচেয়ে ফজিলতপূর্ণ একটি মাস। মহাগ্রন্থ আল-কোরআন অবতীর্ণ হওয়া, ইবাদতের মাধ্যমে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে ক্ষমা পাওয়ার উপযুক্ত সময়ও রমজান মাস। ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের তৃতীয় স্তম্ভ রোজা। মাসব্যাপী রোজা পালন করাসহ নানান দিক থেকে মাসটি সবার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রমজান মাস সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে বলেন-

 یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا کُتِبَ عَلَیۡکُمُ الصِّیَامُ کَمَا کُتِبَ عَلَی الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِکُمۡ لَعَلَّکُمۡ تَتَّقُوۡنَ

'হে বিশ্বাসীগণ! তোমাদের পূর্ববতী লোকদের ন্যায় তোমাদের উপরও সিয়াম তথা রোজাকে অপরিহার্য কর্তব্য রূপে নির্ধারণ করা হয়েছে। যেন তোমরা সংযমশীল হতে পারো।' (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৩)

Advertisement

আলোচ্য আয়াতের শেষ দুইটি শব্দ "لَعَلَّکُمۡ تَتَّقُوۡنَ" দ্বারা আল্লাহ তাআলা আমাদের এই সংবাদ দিয়েছেন যে, 'রমজান মাসে তোমরা বেশি বেশি আমার ইবাদত করো ও আমাকে স্মরণ করো, যাতে আমার সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারো এবং তোমরা সর্বদা আমার শাস্তিকে ভয় করো, যেন তোমরা নিজেদের হৃদয়ে পরহেজগারী অর্জনের বীজ স্থাপন করতে পারো।'

এছাড়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রোজাদার ব্যক্তিদের উদ্দেশ্যে সুসংবাদ ঘোষণা করে বলেছেন, 'যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে ও সওয়াবের আশায় রমজান মাসের রোজা রাখলো, তার আগের (জীবনের) গুনাহরাশি মাফ করা হলো।' (ইবনে মাজাহ)

এছাড়াও আল্লাহ তাআলা সৎকর্মশীল বান্দাদের ক্ষমা ও রহমত পাওয়া সম্পর্কে আশ্বস্থ করে পবিত্র কোরআনে এভাবে ঘোষণা দেন-

وَ لَا تُفۡسِدُوۡا فِی الۡاَرۡضِ بَعۡدَ اِصۡلَاحِهَا وَ ادۡعُوۡهُ خَوۡفًا وَّ طَمَعًا ؕ اِنَّ رَحۡمَتَ اللّٰهِ قَرِیۡبٌ مِّنَ الۡمُحۡسِنِیۡنَ

Advertisement

'আর তোমরা জমিনে বিপর্যয় ও বিশৃংখলা সৃষ্টি করো না তার সংশোধনের পর এবং তাঁকে ডাক ভয় ও আশা নিয়ে। নিশ্চয়ই আল্লাহর রহমত সৎকর্মশীলদের কাছাকাছি।' (সুরা আরাফ : আয়াত ৫৬)

এ আয়াতেও আল্লাহ তাআলা আমাদের উদ্দেশ্যে কিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। আমরা যখন ইবাদত করবো, তখন আমাদের অবশ্যই এমনভাবে ইবাদত করতে হবে, তা যেন লোক দেখানো না হয় এবং মানুষের সামনে নিজেকে খাঁটি বান্দা প্রমাণ করা উদ্দেশ্য না হয়। বরং অন্তরে আল্লাহর ভয়কে জাগ্রত করে ইবাদত করাই জরুরি। আর কোনোভাবেই আল্লাহর বিধানের লঙ্ঘণ করা যাবে না। বিশৃঙ্খলা বা বিপর্যয় সৃষ্টি করা যাবে না। তবেই মহান আল্লাহ তাআলা আমাদের সৎকর্মগুলো কবুল করেন এবং সব গুনাহের জন্য জাহান্নামের শাস্তি থেকে মুক্তি দেবেন। দান করনে অফুরন্ত রহমত।

আপনি আল্লাহর কাছে একনিষ্ঠ অন্তরে নিজের কৃতকর্মের জন্য চোখের পানি ছেড়ে তারই শেখানো ভাষায় হজরত মুসা আলাইহিস সালামের মতো ক্ষমা প্রার্থনা করে বলতে পারেন-

 رَبِّ اِنِّیۡ ظَلَمۡتُ نَفۡسِیۡ فَاغۡفِرۡ لِیۡ فَغَفَرَ لَهٗ ؕ اِنَّهٗ هُوَ الۡغَفُوۡرُ الرَّحِیۡمُ

'হে আমার প্রভু! নিশ্চয়ই আমি নিজের আত্মার উপর জুলুম করেছি, অতএব আমাকে ক্ষমা করুন। এরপর আল্লাহ তাকে ক্ষমা করলেন, অবশ্যই তিনি ক্ষমাশীল, অতি দয়ালু।' (সুরা কাসাস : আয়াত ১৬)

আল্লাহ ক্ষমাশীল। আল্লাহর কাছে আপনার ইবাদতের কোনো একটি অংশ যদি পছন্দ হয়ে যায়, তাহলে আপনার জাহান্নামের আজাব তথা শাস্তি থেকে বাঁচার অন্যতম একটি মাধ্যম এটি।

আর একনিষ্ঠভাবে ইবাদত শুধু নির্দিষ্টভাবে রমজান মাসেই নয়, বরং অন্যান্য মাসের দিন এবং রাতেও নিজেকে নিয়োজিত রাখতে হবে। তবেই আল্লাহর একনিষ্ঠ ইবাদতের মাধ্যমে আপনি তাহার একজন মুত্তাকি বান্দা হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে সক্ষম হবেন।

আমাদের চিন্তার জন্য এ বিষয়টি যথেষ্ট যে-

আমরা প্রতিনিয়িত অসংখ্য গুনাহের কাজে লিপ্ত থাকা সত্ত্বেও সুরা আরাফের ৫৬নং আয়াতের শেষাংশে আল্লাহ তাআলা আমাদের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ দিয়েছেন অর্থাৎ "رَحْمَت" শব্দটির সাথে আল্লাহ "بعيد" (অর্থ : দূর, দূরবর্তী) শব্দটি ব্যবহার না করে বরং আমাদের সুসংবাদ দিয়ে চমৎকার একটি শব্দ দ্বারা। আর তাহলো "قریب" (অর্থ: সন্নিকটে, কাছাকাছি প্রভৃতি) শব্দটি ব্যবহার করে। অর্থাৎ তোমরা যদি সব ধরনের গুনাহের কাজ থেকে বিরত থেকে সব সময় আমার সন্তুষ্টির জন্য ইবাদত করো এবং ব্যক্তি জীবনে আমার নির্দেশিত পথে চলো তবেই তোমরা আমার রহমতের কাছাকাছি হতে পারবে এবং রহমত পেতে সক্ষম হবে।

ইবাদতের এই মাসে পবিত্র কোরআন ও হাদিসে উল্লেখিত মুখে উচ্চারণ সহজ, পাঠ করতে কম সময় ব্যয় হয় কিন্তু সওয়াবের পরিমাণ অত্যাধিক, এমন অনেক আমল রয়েছে যার মাধ্যমে আমাদের যেমন আমলনামায় নেকির সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে তেমনি এই আমলগুলো পাঠের মাধ্যমে আল্লাহর স্মরণে তাহার সন্তুষ্টি অর্জন ও রহমত অর্জন করাও সম্ভব হবে ইনশাআল্লাহ। এসব সুরা ও আয়াতের মধ্য থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু আমল তুলে ধরা হলো-

১. সুরা মুলক তেলাওয়াত

হজরত আবু হুরায়রাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, 'কোরআনুল কারিমে তিরিশ আয়াতবিশিষ্ট একটি সুরা আছে। যে সুরাটি তার পাঠকের জন্য (কেয়ামতের দিন) সুপারিশ করবে, শেষ পর্যন্ত তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে। সুরাটি হচ্ছে-  تَبٰرَکَ الَّذِیۡ بِیَدِهِ الۡمُلۡکُ অর্থাৎ সুরা মুলক।' (আবু দাউদ)

শায়খ আলবানি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি রচিত 'তারগিব' গ্রন্থে এসেছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, 'যে ব্যক্তি প্রতি রাতে  تَبٰرَکَ الَّذِیۡ بِیَدِهِ الۡمُلۡکُ (উচ্চারণ: তাবারকাল্লাজি বিয়াদিহিল মুলক) অর্থাৎ সুরা মুলক তেলাওয়াত করে, আল্লাহ তাআলা তাকে কবরের আজাব তথা শাস্তি থেকে রক্ষা করবেন।

২. দরূদ পড়া

হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, 'যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরূদ পড়ে আল্লাহ তার উপর দশবার রহমত নাজিল করেন।' (মুসলিম)

যেমন আপনি যদি ছোট্ট এ দরূদটি একবার পাঠ করেন- صَلَّي اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم 'সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম' তাহলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘোষণা অনুযায়ী আল্লাহ আপনার প্রতি ১০বার রহমত নাজিল করবেন। এভাবে আপনি যদি প্রতিদিন একশত বার দরূদ পাঠ করেন তবে আপনার প্রতি আল্লাহ তাআলা ১০০০বার (১০০×১০=১০০০) রহমত নাজিল করবেন।

৩. তাসবিহ

হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, 'যে ব্যক্তি প্রতিদিন একশত বার- سُبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدهِ  ('সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি') বলবে তার গুনাহগুলো ক্ষমা করে দেওয়া হবে, যদিও তা সমুদ্রের ফেনা পরিমাণ হয়।' (বুখারি)

হজরত জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, 'যে ব্যক্তি (একবার) বলে- سُبْحَانَ اللهِ الْعَظِيْمِ وَبِحَمْدِهِ 'সুবহানাল্লাহিল আজিম ওয়া বিহামদিহি' (অর্থ : আমি মহান আল্লাহ তাআলার প্রশংসা সহকারে পবিত্রতা ঘোষণা করছি) তার জন্য জান্নাতে একটি খেজুর গাছ লাগানো হয়।' (তিরমিজি)

৪. জিকির

হজরত কাব ইবনে উজরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, 'এমন কতগুলো তাসবিহ রয়েছে, যার পাঠকারী তার সওয়াব থেকে বঞ্চিত হবে না। প্রত্যেক নামাজের পর সে 'সুবহানাল্লাহ' ৩৩ বার, 'আলহামদুলিল্লাহ' ৩৩ বার এবং ‘আল্লাহু আকবর' ৩৪ বার বলবে।' (নাসাঈ)

৫. নবিজীর জন্য কল্যাণ কামনা

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, 'যে ব্যক্তি বলবে, جَزَى اللهُ عَنَّا مُحَمَّدًا بِمَا هُوَ أَهْلُه 'ঝাযাল্লাহু আন্না মুহাম্মাদান বিমা হুয়া আহলুহু' (আল্লাহ তাআলা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আমাদের পক্ষ থেকে এমন উত্তম প্রতিদান দান করুক, যেই প্রতিদানের তিনি যোগ্য)। আর এই বাক্য পাঠকারীর জন্য সত্তর জন ফেরেশতা এক হাজার দিন পর্যন্ত সওয়াব লিখতে লিখতে ক্লান্ত হয়ে যাবে।' (তাবারানি)

৬. আল্লাহর অতি প্রিয় দুটি বাক্য

হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, 'দুইটি কলেমা বা বাক্য রয়েছে, যেগুলো রহমান অর্থাৎ দয়াময় আল্লাহ্‌র কাছে অতি প্রিয়, উচ্চারণে খুবই সহজ, মিজান তথা আমলের পাল্লায় অত্যন্ত ভারী। বাক্য দুটি হচ্ছে- سُبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدِهِ سُبْحَانَ اللهِ الْعَظِيْم 'সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি সুবহানাল্লাহিল আজিম' (আমরা আল্লাহ তাআলার প্রশংসাসহ তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করছি, মহান আল্লাহ অতি পবিত্র)।' (বুখারি)

৭. সুরা তাকাসুর

হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন  রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, 'তোমাদের এমন কেউ কি আছে যে প্রতিদিন এক হাজার আয়াত পাঠ করতে সক্ষম? সাহাবিগণ বললেন, কে এমনটি করতে সামর্থ রাখে? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমাদের মধ্যে যদি কেউ أَلْهَاكُمُ التَّكَاثُر (সুরা তাকাসুর) পাঠ করতে সক্ষম হয়; তাহলে সে এই সওয়াবের অধিকারী হবে।' (মুসতাদরাকে হাকেম) 

৮. তিনটি বাক্যের আমল

হজরত আবু সাঈদ আল-খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, 'যে ব্যক্তি বলে- رَضِيْتُ بِاللهِ رَبَّا وَّبِالإِسْلَامِ دِيْنًا وَّبِمُحَمَّدٍ رَسُوْلًا 'রাদিতুবিল্লাহি রাব্বাও ওয়া বিল ইসলামি দ্বীনাও ওয়া বিমুহাম্মাদিন রাসুলা' (অর্থ : আমি আল্লাহকে প্রভু, ইসলামকে জীবন ব্যবস্থা এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রাসুল হিসেবে সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নিয়েছি) তাহার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে গেছে।' (আবু দাউদ)

এভাবে কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত অনেক দোয়া রয়েছে, যা পাঠে অসংখ্য নেকি অর্জন করা সম্ভব। রমজান ও রোজা শুধুমাত্র খাবার না খেয়ে থাকার উৎসবে পরিণত না হয়ে, আত্মার পবিত্রতা অর্জনের জন্য জারিয়া হয়ে উঠুক রোজা ও রমজান মাস।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর সব রোজাদারকে কোরআন-সুন্নাহর আমলে জীবন সাজানোর তাওফিক দান করুন। রোজা ও রমজান মাসকে ইবাদতের মাস হিসেবে গ্রহণ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : শিক্ষার্থী, দাওয়াহ অ্যান্ড ইসলামীক স্টাডিজ বিভাগ, আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।

এমএমএম/জেআইএম