ডা. মো. রশিদুল হক। সহকারী অধ্যাপক, মানসিক রোগ বিভাগ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড হাসপাতাল)। ২ এপ্রিল বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস উপলক্ষে মুখোমুখি হয়েছেন জাগো নিউজের। বলেন, অটিস্টিকে ভোগা শিশুদের নিয়ে সবার আগে দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো জরুরি। আর রাষ্ট্র, সমাজের পক্ষ থেকে সহায়তা পেলেই এসব শিশু মূলস্রোতে এসে স্বাভাবিক জীবন যাপন করার সুযোগ পায়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।
Advertisement
জাগো নিউজ: অটিজম নিয়ে গবেষণা করছেন, লিখছেন। অনেকে অটিজমে আক্রান্তকে প্রতিবন্ধীদের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলেন। আপনার বর্ণনায় কী বলবেন?
ডা. মো. রশিদুল হক: অটিজমকে আমি স্বাভাবিক কোনো রোগ বলছি না। এটি হচ্ছে মস্তিষ্ক বিকাশজনিত সমস্যা। অটিজম নিয়ে গণমাধ্যমে এখন আলোচনা হচ্ছে। ধীরে ধীরে সবাই এই রোগ সম্পর্কে জানতে পারছে। মানুষ আগে এই রোগ সম্পর্কে সচেতন ছিল না। এমনকি সঠিকভাবে নির্ণয়ও হতো না। অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের ১৮ মাস বয়স থেকে ডায়াগনোসিস করা যায় আর পুরোদমে ডায়াগনোসিস করা সম্ভব ২৪ মাস বয়সী অটিস্টিক শিশুদের।
জাগো নিউজ: ডায়াগনোসিস সাধারণত কোন বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে হয়?
Advertisement
রশিদুল হক: অটিজম বৈশিষ্ট্যের শিশুদের সাধারণ কোনো ইনভেস্টিগেশন করে ডায়াগনোসিস করি না। শিশুর বিকাশ বা উন্নয়ন স্তর, সামাজিক যোগাযোগের ধরন, বাবা-মার কাছ থেকে পাওয়া হিস্ট্রি (তথ্য) ও শিশুকে পর্যবেক্ষণ করে আমরা তার রোগ ও চিকিৎসা নির্ণয় করি। অটিজম তো নতুন কিছু নয়, বহু আগে থেকেই রয়েছে।
জাগো নিউজ: চিকিৎসায় ফলাফল কী? স্বাভাবিকতায় ফিরতে পারে অটিজম শিশুরা?
রশিদুল হক: প্রথম স্তরে ডায়াগনোসিস বা চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার মধ্যে নিয়ে আসতে পারি, তাহলে অনেক শিশুই স্বাভাবিকতায় ফিরে আসে। স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। বিভিন্ন গবেষণায় তাই উঠে এসেছে, সঠিক ডায়াগনোসিস হলে ১০ থেকে ২০ শতাংশ শিশু স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে, ২০ থেকে ৩০ শতাংশ শিশু মোটামুটি চলতে পারে। এক্ষেত্রে তাদের কিছু সাপোর্ট দরকার হয়। অটিজম শিশুদের বড় একটি অংশ অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে জীবন যাপন করতে পারে।
অটিজম শিশুর কিছু বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। এই বৈশিষ্ট্য দেখা দিলেই প্রথমে কোনো চাইল্ড সাইকিয়াট্রিস্ট বা নিউরোলজিস্টের শরণাপন্ন হতে হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তার রোগ বা রোগের স্তর নির্ণয় করা সম্ভব হয়। এরপর বহুমুখী ব্যবস্থাপনার মধ্যে এই শিশুকে নিয়ে আসতে হয়।
Advertisement
এটি এমন রোগ নয় যে, ওষুধ দিলাম আর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলো। বয়স অনুসারে একই বাচ্চার মধ্যে বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দিতে পারে। তার চিকিৎসার ভিন্ন ভিন্ন চাহিদা তৈরি হতে পারে। যেমন- যদি কারও কথা বলার সমস্যা হয় তাহলে তাকে কথা বলার থেরাপি দিতে হবে। আবার কারও আচরণে সমস্যা থাকলে তাকে আচরণের ওপর থেরাপি দিতে হবে। অটিজম শিশুর চিকিৎসা হয় একটি টিমওয়ার্কের মাধ্যমে। নিউরোলজিস্ট, সাইকোলোজিস্ট, থেরাপিস্টের দরকার পড়তে পারে বয়স ও রোগের ধরনের ওপর ভিত্তি করে। যখন যা প্রয়োজন, তাই তাকে দিতে হবে।
আমি মনে করি, জাতীয় পর্যায় থেকে অটিস্টিক শিশুদের জন্য আরও দায়িত্ব নিতে হবে। অন্তত ডায়াগনোসিস পর্বটা যেন উপজেলা পর্যায় থেকেই শুরু হয়। অনেকেরই ভূমিকা আছে এখানে। সবাইকে নিয়েই কাজ করতে হবে।
জাগো নিউজ: অটিজম নিয়ে নানা দ্বিধা বা কুসংস্কারও আছে সমাজে। কেউ মনে করেন মা-বাবার পাপের ফল। আবার কেউ মনে করেন জিন-ভূতের কুনজর। কুসংস্কারের এই দেওয়াল তো কিছুটা ভেঙেও গেলো এতদিনে?
রশিদুল হক: হ্যাঁ। অটিজম নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের ভুল ধারণা ছিল। কুসংস্কার ছিল। অনেকে মনে করেছেন, এই শিশুদের জন্য তাদের মা-বাবাকে দোষারোপ করা হতো। মনে করা হতো মা-বাবার পাপের শাস্তি সন্তানের মধ্য দিয়ে হচ্ছে। এগুলো সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা। মানুষ এখন সচেতন হচ্ছে। নানা কারণেই শিশুরা অটিজমে আক্রান্ত হতে পারে। সময় মতো সুচিকিৎসা পেলে অনেক শিশুই সুস্থ হতে পারে। তারা স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে।
অটিজম কোনো পাপের ফল না বা জিন-ভূতের প্রভাব নয়, এই সচেতনতা সবার মধ্যে জাগ্রত করতে হবে। কুসংস্কার আঁকড়ে রাখলে এই শিশুরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পরিবেশগত কারণ, জেনেটিক কারণ, এমনকি গর্ভাবস্থায় মায়ের কিছু ওষুধ সেবন থেকেও শিশুরা অটিজমে আক্রান্ত হতে পারে। এই ধারণাগুলো সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।
জাগো নিউজ: মেয়ে শিশুর চেয়ে ছেলে শিশু অটিজমে আক্রান্ত হয় বেশি। এর কী ব্যাখ্যা?
রশিদুল হক: অটিজমে আক্রান্ত তিন ভাগের দুই ভাগই সাধারণ ছেলে শিশু। গবেষণায় অন্তত তাই বলে। কিন্তু কী কারণে ছেলেরা বেশি আক্রান্ত হয় তার ব্যাখ্যা এখনো পাওয়া যায়নি। অটিজম নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। কী কারণে ছেলেরা বেশি আক্রান্ত তারও কারণ হয়তো বেরিয়ে আসবে।
তবে গবেষণায় দেখা গেছে, বেশি বয়সে বাবা-মা সন্তান নিলে শিশুর অটিজমের ঝুঁকি থাকে। বিশেষ করে বাবার বয়স যদি ৪০ বছরের অধিক হয়, তাহলে শিশুর অটিজম ঝুঁকি বেশি।
জাগো নিউজ: অঞ্চলভেদে অটিজম আক্রান্তদের কোনো হেরফের আছে কি না?
রশিদুল হক: বাংলাদেশে গবেষণায় দেখা গেছে, গ্রামের চেয়ে শহরে অটিজম শিশুর হার অনেক বেশি। আর দক্ষিণ এশিয়ায় অটিজম আক্রান্ত রোগীর হার প্রায় সব দেশে একই। গবেষণায় এসেছে, বাংলাদেশে প্রতি এক হাজারে অটিজম আক্রান্ত শিশু নির্ণয়ের হার দশমিক ৭ শতাংশ। অন্য দেশেও কাছাকাছি।
জাগো নিউজ: অটিজম শিশুদের মূলস্রোতে রাখতে আপনার পরামর্শ কী?
ডা. মো. রশিদুল হক: সবার আগে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। অটিজম শিশুদের মধ্যে কী আছে আর কী নেই এই দিকে তাকানো ঠিক নয়। মানুষের চোখে দেখা দরকার। আমরা যদি তাদের আপন করে নেই, ভালোবাসা দেখাই, সহানুভূতিশীল হই, সময়মতো সুচিকিৎসার মধ্যে আনতে পারি, তাহলে স্বাভাবিক শিশু হিসেবেই বেড়ে উঠবে তারা।
অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের নিয়ে সবার আগে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো জরুরি। অটিজম শিশুদের আঁকা ছবি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী ঈদকার্ড ছাপছেন। এটি কিন্তু সবার জন্য বড় অনুপ্রেরণা। অনেক অটিজম শিশু স্বাভাবিক শিশুদের চেয়ে তীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী। তাদের সামান্য সহযোগিতা করলে এই শিশুরা অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারে। তারা আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠতে পারে। বৈষম্যের চোখে না দেখলেই তারা মূলস্রোতে আসতে পারবে।
ডিজঅ্যাবিলিটি ওয়েলফেয়ার অ্যাক্ট- ২০১৩ এবং নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন- ২০১৩ তে অটিস্টিক শিশুদের নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অটিস্টিক শিশুর মা-বাবাকেও আলাদাভাবে সহযোগিতা করতে হবে। এ ধরনের শিশুর মা-বাবা তার সন্তানকে নিয়ে অনেক কষ্ট করে থাকেন, তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় থাকেন। এ কারণে মা-বাবাকে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করলে অটিস্টিক শিশুরা উপকৃত হবে।
এএসএস/এমআরএম/জিকেএস