মতামত

ইউক্রেন যুদ্ধ ও ইজরায়েল

ইউক্রেন যুদ্ধ ইজরায়েলের ডেমোগ্রাফিক চিত্রে বড় প্রভাব রাখছে। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি, রাশিয়ার সৈন্যরা ইউক্রেনের সীমান্ত অতিক্রমের সাথে সাথে ইজরায়েল সরকার ইউক্রেনের সব ইহুদিকে তার দেশে অভিবাসী (আলিয়াহ) হিসেবে নিতে সক্রিয় হয়। আর এ জন্য যত প্রকার আইনি বাধা ছিল দ্রুত সেগুলোর নিষ্পত্তি করে। তেমনি দ্রুততার সাথে পোল্যান্ড, মলদোভা, রোমানিয়া এবং হাঙ্গেরিতে স্থাপিত হয় অভিবাসন কেন্দ্র।

Advertisement

এসব করতে যে অর্থের দরকার হয় তা শুধু ইজরায়েল সরকার দেয়নি, এসেছে বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠিত ইহুদি ফাউন্ডেশন সমূহ থেকে। প্রথম দফাতেই জিউস ফেডারেশন অব নর্থ আমেরিকা থেকে আসে ১৫ মিলিয়ন ডলার। অন্যান্য দেশ ও সংস্থা থেকে যা এসেছে সেগুলো সমন্বয় করে ইজরায়েলি পররাষ্ট্র দফতর।

এদের কাজ ছিল ইজরায়েলে নিয়ে না আসা পর্যন্ত সাময়িকভাবে ইউক্রেনীয় ইহুদিদের জন্য হোটেল, বাসস্থান, খাবার ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। সবচেয়ে জরুরি যে কাজটি তারা করেছে তা হলো এদের জন্য বিমানের ব্যবস্থা করা যেন তারা দ্রুততম সময়ে তেলআবিব পৌঁছুতে পারে।

এখন তারা এই ইউক্রেনীয় ইহুদিদের জন্য বাসস্থানের ব্যবস্থা করছে যেন তারা ইজরায়েলের মূল জনগোষ্ঠীর সাথে মিশে যেতে পারে। ধারণা করা হচ্ছে এই ধাক্কায় ইউক্রেন, রাশিয়া ও বেলারুশ থেকে প্রায় এক লাখ ইহুদি ইজরায়েলে আশ্রয় পাবে। আলিয়া (ইহুদি ভাষায় অভিবাসন) এক্সপ্রেস নামের এই কর্মসূচি করাই হয়েছে পৃথিবীর যে প্রান্তেই ইহুদিরা বিপন্ন বোধ করবে যেন তারা স্বল্প সময়ে ইজরায়েলে আশ্রয় পেতে পারে।

Advertisement

ইউক্রেনসহ এই অঞ্চলের হাজার হাজার ইহুদি এখন অনলাইনে আবেদন করছে ইজরায়েলি নাগরিকত্বের জন্য। ইউক্রেনের মোট জনসংখ্যার ০.১৩ মতাংশ হলো কট্টর ইহুদি, সংখ্যার হিসেবে যা ৫০,০০০। তবে সামগ্রিকভাবে ইউক্রেনে মোট ইহুদির বসবাস প্রায় দেড় লাখ। কোন কোন হিসেবে এই সংখ্যা দুই লাখেরও বেশি।

ইউক্রেন যুদ্ধকে ঘিরে ইজরায়েল তার অভিবাসন নীতিতে পরিবর্তন এনেছে। যেখানে নাগরিত্ব দেওয়া কঠোরভাবে নিষিদ্ধ সেই দেশ এক প্রকার খুলেই দিয়েছে তার দরজা, তবে কেবল ইহুদিদের জন্যই। বার্তা খুব পরিষ্কার– জায়নবাদি স্বপ্নের বাস্তবায়ন যা তারা লালন করছে দুই হাজার বছর ধরে। ইজরায়েলের লক্ষ্য- সারা বিশ্বের ইহুদি সম্প্রদায়ের স্বর্গ হবে ইজরায়েল এবং ভূমধ্যসাগর ও জর্দান নদীর মাঝে ইহুদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা চিরতরে প্রতিষ্ঠিত হবে।

ইজরায়েলের ডেমোগ্রাফিক কাঠামোর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ফিলিস্তিরা যারা দেশটির মোট জনসংখ্যার ২১ শতাংশ। ১৯৪৮ সালের পর থেকে ইজরায়েলি নিপীড়নে ফিলিস্তিন সম্প্রদায়ের যারা নিশ্চিহ্ন না হয়ে এখনও টিকে আছ, তারা নির্যাতনের পাশাপাশি আইনী ও নীতিগত বৈষম্যের শিকার। লক্ষ্য একটাই, ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা বাড়তে দেয়া যাবে না। এখানেই শেষ নয়, জমি, বাড়ি, স্থাপনা, আবাসস্থল দখল চলছে নিয়মিতভাবে যেন ফিলিস্তিনিদের ভৌগোলিক মালিকানা কমে আসে।

ইউক্রেন থেকে এভাবে ইহুদিদের পালিয়ে যাওয়া ইজরায়েলের জন্য এক নতুন সুযোগ এনে দিয়েছে তার জনসংখ্যার কাঠামোকে বদলের ফেলার জন্য। কেউ কেউ বলছে, ১৯৪৮ সালের পর ইজরায়েলে একসাথে আবার বড় আকারে ইহুদি ঢুকল। প্রথম ধাক্কা ছিল ১৯৩০-এ যখন নাৎসিদের অত্যাচারে ইহুদিরা ইউরোপ ছাড়তে শুরু করলো। মুসলিমদের সাথে সংঘাতে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চল থেকে নিয়মিতভাবেই ইহুদি স্থানান্তর ঘটেছে। ১৯৯০-এ সোভিয়েত পতনের পর দশ লাখেরও বেশি ইহুদি ইজরায়েলে ঢুকে।

Advertisement

হাজার হাজার ইউক্রেনীয় ইহুদির এই আগমনে এখনই বদলাবে না ইজরায়েলের জনসংখ্যার কাঠামো। এর অন্যতম কারণ ফিলিস্তিনের ব্যাপক জন্মহার। বিশেষ করে পশ্চিম তীর ও গাজায় ফিলিস্তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠতা এখনই কমছে না। তবে ইহুদি-মুসলিম ভারসাম্য অনেকখানি চলে আসবে। আবার এও ঠিক যে, ১৯৯০-এ সোভিয়েত পতন থেকে এখন পর্যন্ত যারা ইজরায়েলে এসেছে তারা সবাই ইহুদি নয়। এই সংখ্যা তিন থেকে চার লাখ।

আরেকটি বড় সংখ্যা সোভিয়েত অঞ্চল থেকে ইজরায়েল এসে চলে গেছে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপে। আর এ জন্য ইজরায়েলে এখন ধর্মান্তরিতকরণ প্রকল্প বাস্তবায়নে জোর দেয়া হচ্ছে। দুই লাখের মতো গেছে জার্মানিতে যারা এখন জার্মান ইহুদি নামে পরিচিতি পেয়েছে।

এত সুবিধা দেওয়ার পরও কেন ইজরায়েলে থাকতে চায় না ইউরোপীয় ইহুদিরা, সে নিয়ে নানা মত আছে। তবে একটি বড় অংশই ইজরায়েলকো একটি সংঘাতপূর্ণ এলাকা হিসেবে বিবেচনা করে যেখানে ফিলিস্তিনিদের সাথে চলে নিয়মিত যুদ্ধ। ইউক্রেনীয় ইহুদিদের অনেকেও বলছে এক সংঘাত থেকে তারা আরেক সংঘাতে গিয়ে পড়তে চায় না। ইজরায়েলে জীবনযাত্রার ব্যয়ও বেশি এবং আয়ের পথ তেমন প্রসারিত নয়।

ইজরায়েল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনি তাদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ হয়েছে। পৃথিবীর যে প্রান্তে যখনই কোন সংঘাতের সৃষ্টি হয়, ইজরায়েলি সরকার সক্রিয় হয় সেখানো কোন ইহুদি সম্প্রদায় থাকলে তাদের নিয়ে আসতে।

পূর্ব ইউরোপের সব ইহুদির কাছেই ইজরায়েল তাদের আরেক রাষ্ট্র। এবং এরা ভয়ংকরভাবে ফিলিস্তিন বিরোধী। আগামী দিনগুলোতে এই ইহুদিরা ইজরায়েলের নীতি প্রণয়ন ও প্রশাসনিক স্তরে বড় জায়গা নিবে বলে ধারণা করা হচ্ছে এবং আরও কঠিন করে তুলবে ফিলিস্তিনিদের জীবন।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি।

এইচআর/এমএস