মতামত

চাই না মহামারি, হত্যাযজ্ঞ

এক অপরকে সহযোগিতা নিয়ে বা সহযোগী হয়েই চলতে হয়। সুতরাং শান্তিপূর্ণ জীবন-যাপনে যুদ্ধ কখনোই কারো কাম্য হতে পারে না। তবুও বিভিন্ন কারণেই ঘটে যুদ্ধ। কখনও তা দেশের অভ্যন্তরে কখনও আবার দেশের সাথে দেশের যা পরিণত হয়েছে বিশ্বযুদ্ধে। বিশ্বমণ্ডলও একটি পরিবারের মত। পরিবারে যেমন একজন সদস্যের সাথে দ্বন্দ্ব বাঁধলে বাকিদের প্রভাব পড়ে ঠিক যুদ্ধও তেমন।

Advertisement

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোর ছয়টার দিকে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ইউক্রেনের ন্যাটো এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দিতে চাওয়ার ইচ্ছাও এ আক্রমণের আরেক কারণ। কারণ, অনেক দিন ধরে সেই বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছে রাশিয়া। রাশিয়ার দাবি, পশ্চিমা দেশগুলোকে নিশ্চয়তা দিতে হবে, 'ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দেবে না'।

ন্যাটো পশ্চিমা দেশগুলোর একটি সামরিক জোট, যেখানে ৩০টি দেশ রয়েছে। পুতিনের দাবি, ইউক্রেন পশ্চিমা দেশগুলোর হাতের পুতুল এবং কখনোই প্রকৃত রাষ্ট্র ছিল না। এ ছাড়াও আরেকটি কারণ হলো, ইউক্রেন দেশ হিসেবে স্বীকৃতির পরও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি দেশ হিসেবে রাশিয়ার সঙ্গে দেশটির গভীর সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ক রয়েছে। সেখানে রুশ ভাষাও ব্যাপকভাবে বলা হয়। রাশিয়া মনে করে, ইউক্রেন কোনোদিনই প্রকৃত অর্থে একটা রাষ্ট্র ছিল না। তিনি এর আগেও বলেছেন, এখন যা ইউক্রেন, তা আসলে 'প্রাচীন রুশ ভূখণ্ড।

তবে শুরুটা আরও আগে। ২০১৪ সালে যখন রাশিয়া প্রথমবার ইউক্রেনে প্রবেশ করে, তখন প্রেসিডেন্ট পুতিন-সমর্থিত বিদ্রোহীরা ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের বেশ বড় একটি এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এরপর থেকেই তারা ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে আসছে। তবে সাম্প্রতিক খবর হলো, বিদ্রোহীরা শুধু যেটুকু এলাকার নিয়ন্ত্রণ করছে, শুধু সেটাই দাবি করছে না, তারা পুরো দোনেৎস্ক এবং লুহানস্ক অঞ্চলকে নিজেদের বলে দাবি করছে। যুদ্ধ বন্ধে একটি আন্তর্জাতিক মিনস্ক শান্তি চুক্তি হয়েছিল, কিন্তু লড়াই তাতে থামেনি। আর এ কারণেই রাশিয়ার নেতা বলছেন, ওই অঞ্চলে তিনি তথাকথিত শান্তিরক্ষী পাঠাচ্ছেন।

Advertisement

বেলারুশের রাজধানী মিনস্কে ২০১৫ সালে এ চুক্তি হয়েছিল। যেখানে প্রধান শর্ত ছিল, পূর্ব ইউক্রেন থেকে সামরিক স্থাপনা, সামরিক সরঞ্জাম ও ভাড়াটে সেনাদের সরিয়ে নিতে হবে। এছাড়া বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চলগুলোকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়ার কথা বলা হয়। অঞ্চলগুলোতে নিজস্ব পুলিশবাহিনী ও স্থানীয় বিচারব্যবস্থা নিয়োগের কথাও উল্লেখ হয় চুক্তিতে। তবে সেসব চুক্তি বাস্তবায়ন করেনি কিয়েভ।

পূর্বেও আমরা বিভিন্ন যুদ্ধের ইতিহাস জেনেছি তাতে দেখা যায় কোন যুদ্ধই শান্তির বার্তা আনেনি। যুদ্ধের ফল যে কখনো সুখের হয় না, অতীতে ফিরে তাকালেই তা দেখা যায়। ইতিহাসের পাতা থেকে রইল তেমনই কিছু ভয়াবহ যুদ্ধ, যেগুলিতে প্রাণ গিয়েছিল অসংখ্য মানুষের।

লুসান রেবেলিয়ন : ৭৫৫-৭৬৩ সালে সংগঠিত এ যুদ্ধে মৃতের সংখ্যা ১ কোটি ৩০ লক্ষ থেকে ৩ কোটি ৬০ লক্ষ। চীনে ট্যাঙ্গ এবং ইয়ান রাজবংশের মধ্যে সিংহাসন দখলের এই লড়াইয়ে মৃত্যু হয়েছিল প্রায় দুই কোটি মানুষের।

মোঙ্গল শাসনকাল : ১২০৭-১২৭২ সালে সংগঠিত এ যুদ্ধে মৃতের সংখ্যা ৩ কোটি থেকে ৬ কোটি। প্রায় দুইশ’ বছর স্থায়ী ছিল মোঙ্গল সাম্রাজ্য। পূর্ব ইউরোপ থেকে জাপান এবং সাইবেরিয়া থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এই সাম্রাজ্য। ভয়ঙ্কর মোঙ্গলদের আক্রমণে এই সব অঞ্চলে সব মিলিয়ে মারা গিয়েছিলেন প্রায় ছয় কোটি মানুষ।

Advertisement

তৈমুর লং : ১৩৬৯-১৪০৫ সালে এই যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিলো। এতে মৃতের সংখ্যা ১ কোটি ৫০ লক্ষ থেকে ২ কোটি। মোঙ্গল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যুদ্ধ করেন তৈমুর লং। ভয়ঙ্কর তৈমুরের হাতে মৃত্যু হয়েছিল প্রায় দুই কোটি মানুষের।

কুইঙ্গ সাম্রাজ্যের পতন : এ যুদ্ধ ১৬১৬- ১৬৬২ সংগঠিত হয়েছিলো। এতে মৃতের সংখ্যা ২কোটি ৫০ লক্ষ। চীনের সর্বশেষ রাজবংশ হল কুইঙ্গ। মিঙ্গদের আক্রমণে এই রাজবংশের পতন হয়। সেই যুদ্ধে মৃত্যু হয়েছিল প্রায় আড়াই কোটি মানুষের।

নাপোলিওনিক যুদ্ধ : ১৮০৩-১৮১৫ সালে সংগঠিত হওয়া এ যুদ্ধে মৃতের সংখ্যা ৩৫ লক্ষ থেকে ৭০ লক্ষ। এক সঙ্গে একাধিক দেশ নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল সেই সময়ে। প্রায় বারো বছর ধরে বিভিন্ন সময়ে চলা সেই যুদ্ধে মৃত্যু হয়েছিল প্রায় ৭০ লক্ষ মানুষের।

তাইপিং বিদ্রোহ : ১৮৫১-১৮৬৪ সালে এ যুদ্ধ সংগঠিত হয়। এতে ২ কোটি মানুষ প্রাণ হারায়। এটি চীনের সবচেয়ে বড় গৃহযুদ্ধ।

দুনগান অভ্যুত্থান : ১৮৬২-১৮৭৭ সালে সংগঠিত এ যুদ্ধে মৃতের সংখ্যা ৮০ লক্ষ থেকে ১ কোটি ২০ লক্ষ। চীনে দুনগান জাতি বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল কুইঙ্গ রাজবংশের বিরুদ্ধে। গৃহযুদ্ধে প্রায় এক কোটি মানুষের মৃত্যু হয়।

রাশিয়ার গৃহযুদ্ধ : ১৯১৭-১৯২১ সালে সংগঠিত যুদ্ধে ৫০ লক্ষ থেকে ৯০ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারায়। বলশেভিক পার্টির অভ্যুত্থান এবং ক্ষমতা দখলের সেই গৃহযুদ্ধে মৃত্যু হয়েছিল প্রায় ৯০ লক্ষ মানুষের।

আধুনিক মানব ইতিহাসের সবচেয়ে নির্মম, করুণ বিষাদগাথা হলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু অবলোকন করা এই মহাযুদ্ধে আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছে লক্ষাধিক মানুষ। তার থেকেও বেশি মানুষ স্বামী ও পিতৃহারা হয়েছে। এমন একটি অস্পষ্ট পরিসংখ্যান দিয়েই ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত চলা পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি ও বীভৎসতাকে পরিমাপ করা হয়ে থাকে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্সের ৮০ লক্ষ, জার্মানির ১ কোটি ৩০ লক্ষ, আস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির ৯০ লক্ষ এবং ইতালির ৬০ লক্ষ সৈন্য অংশগ্রহণ করে। অন্যদিকে ব্রিটেন ৯০ লক্ষ সৈন্যকে যুদ্ধে পাঠিয়েছিল। এর মধ্যে তাদের উপনিবেশের অন্তর্গত বিভিন্ন দেশের সেনাবাহিনীও অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে এর অধিকাংশই ছিল ভারত থেকে আগত। যুক্তরাষ্ট্র এ যুদ্ধে ৪০ লক্ষ সৈন্য নিযুক্ত করেছিল। মৃত সৈনিকের সংখ্যা ১ কোটি বীভৎস এই যুদ্ধে জার্মানি এবং রাশিয়াতে মৃত্যুর মিছিলটা সবচেয়ে দীর্ঘ। এমনকি, আহতের সংখ্যাটাও এই দুটি দেশেই সবচেয়ে বেশি ছিল। সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মোট ১ কোটি সৈনিক মৃত্যুবরণ করে এবং আহত হয় তার দ্বিগুণ সংখ্যক মানুষ।

আসলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বেসামরিক সাধারণ মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা এতই বেশি ছিল যে, এটার কোন সঠিক পরিসংখ্যান আজ পর্যন্ত নির্ণয় করা যায়নি। এই যুদ্ধে ৬০ লক্ষ মানুষ যুদ্ধবন্দী হয়। যুদ্ধের কারণে ১ কোটি মানুষ গৃহহারা হয়। ৩০ লক্ষ নারী এই যুদ্ধের কারণে বিধবা হয় এবং অনাথ হয় ৬০ লক্ষ শিশু। এই যুদ্ধে প্রায় ১.৩ বিলিয়ন কামানের গোলা ব্যবহার নিক্ষেপ করা হয়। এই যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে প্রায় ১০ লক্ষ চিঠি যুদ্ধরত সৈনিক ও তাদের প্রিয়জনের মধ্যে বিনিময় হয়েছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মানবসভ্যতার ইতিহাসে এ যাবৎকাল পর্যন্ত সংঘটিত সর্ববৃহৎ এবং সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধ। ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল, এই ছয় বছর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়সীমা ধরা হলেও ১৯৩৯ সালের আগে এশিয়ায় সংগঠিত কয়েকটি সংঘর্ষকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়। তৎকালীন বিশ্বে সকল পরাশক্তি এবং বেশিরভাগ রাষ্ট্রই এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং দুইটি বিপরীত সামরিক জোটের সৃষ্টি হয়; মিত্রশক্তি আর অক্ষশক্তি।

এই মহাসমরকে ইতিহাসের সবচেয়ে বিস্তৃত যুদ্ধ বলে ধরা হয়, যাতে ৩০টি দেশের সব মিলিয়ে ১০ কোটিরও বেশি সামরিক সদস্য অংশগ্রহণ করে। অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্রসমূহ খুব দ্রুত একটি সামগ্রিক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং সামরিক ও বেসামরিক সম্পদের মধ্যে কোনরকম পার্থক্য না করে তাদের পূর্ণ অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা প্রয়োগ করা শুরু করে। পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র পারমাণবিক অস্ত্রের প্রয়োগ প্রভৃতি ঘটনায় কুখ্যাত এই যুদ্ধে প্রায় ৫ কোটি থেকে সাড়ে ৮ কোটি মানুষ মৃত্যুবরণ করে। এসব পরিসংখ্যান এটাই প্রমাণ করে যে এটাই পৃথিবীর ইতিহাসে নৃশংসতম যুদ্ধ।

ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের লক্ষ্যে তুরস্কের মধ্যস্থতায় মস্কো ও কিয়েভের মধ্যে আবারও সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই মধ্যস্থতায় খোদ তুর্কী প্রেসিডেন্টও অংশ নিয়েছেন। দুটো দেশের প্রতিনিধি দলের মধ্যে ইস্তাম্বুলে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দুই সপ্তাহের মধ্যে এটি প্রথম মুখোমুখি বৈঠক। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে এর আগেও সেখানে দু'পক্ষের মধ্যে কথাবার্তা হয়েছে।

আলোচনা শুরুর আগে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়িপ এরদোয়ান রাশিয়া ও ইউক্রেনের প্রতি আহবান জানিয়েছেন "যুদ্ধের এই ট্রাজেডি" বন্ধ করার জন্য। ইউক্রেন বলছে, নেটোতে যোগ না দিয়ে তাদেরকে নিরপেক্ষ থাকার যে দাবি মস্কো জানিয়েছে তারা সেটি বিবেচনা করবে।

যুদ্ধ কখনোই কোনো সুফল বয়ে আনে না। যুদ্ধ করে কেউ কখনো শান্তির পুরষ্কার অর্জন করেনি। যুদ্ধ করে কারো নাম ইতিহাসে ঠাঁই করে নেই নি। সুতরাং যুদ্ধ শুধু আনে ধ্বংস আর মৃত্যু। আনে হাহাকার আর দারিদ্র্য। যুদ্ধে যে দেশ নিজেকে বিজয়ী বলে ঘোষণা দেয়, প্রকৃতপক্ষে সে বিজয় দেশটির কোনো স্থায়ী সাফল্য এনে দেয় না।

আপাতত বীরত্বের খেতাবে ভূষিত হলেও বৃহত্তর অর্থে সেটা তার ক্ষতির কারণই হয়। তাই যুদ্ধ এড়িয়ে দু’পক্ষের বিরাজমান সমস্যাগুলো কূটনীতির মাধ্যমে সমাধান করাই বুদ্ধিমানদের কাজ বলে মনে হয়। দীর্ঘদিনের করোনাকাল কাটিয়ে সকলে যখন নির্মল পৃথিবীতে প্রাণোচ্ছল জীবনের কথা ভাবছি, তখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যেন আরেকটি মহামারির দিকে ধাবিত করছে বিশ্বকে। যার প্রভার দেখছি তেল-গ্যাসের বাজারে। চাই না আর মহামারি, চাই না হত্যাযজ্ঞ। শান্তির পথে আমরা একসাথে, শান্তিই পরম ধর্ম। শান্তিই হোক বীরত্বের, যুদ্ধ হোক বন্ধ।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

এইচআর/এমএস