গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জ ইউনিয়নে অবস্থিত জেলার একমাত্র কৃষিভিত্তিক কারখানা রংপুর সুগার মিল। এই মিলটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে উত্তরের জনপদ গাইবান্ধার কৃষি জমিতে আখ চাষ বেড়ে যায়। কৃষকরা আখ চাষের মাধ্যম সফলতা পেলেও সফলতার ছোঁয়া লাগেনি এই মিলের অর্থনীতিতে। ৫১৪ কোটি ১১ লাখ টাকা লোকসানের ফলে বন্ধ করে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি)। ফলে এই অঞ্চলের কৃষিতে আখ চাষের সম্ভাবনার দুয়ার বন্ধ হয়ে যায়।
Advertisement
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কৃষি অঞ্চল হিসেবে জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় আখ চাষের আরও প্রসার ঘটাতে ১৯৫৪ সালে এই চিনিকলটি স্থাপনের কার্যক্রম শুরু হয়। তিন বছর চেষ্টার পর ১৯৫৭ সালে রংপুর চিনিকল দৈনিক ১ হাজার মেট্রিক টন উৎপাদনের সক্ষমতা নিয়ে আখ মাড়াই কার্যক্রম শুরু করে। এই মিলের আখের চাহিদা মেটাতে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জ এলাকায় ১ হাজার ৮৪২ একর জমি লিজ নিয়ে ‘সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্ম’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এছাড়া মিল থেকে বিভিন্ন সহায়তা দিয়ে আরও ৩৯ হাজার একর জমিতে আখ চাষের জন্য আটটি সাব জোন ও ৪২টি আখ ক্রয় কেন্দ্র স্থাপন করা হয়।
দেশ স্বাধীনের পরে ১৯৯১ সালের বাংলাদেশ সরকার এই সুগার মিলটির দৈনিক মাড়াই ক্ষমতার ৫০০ মেট্রিক টন বাড়িয়ে ১ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন করে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মিলের কার্যক্রম গতিশীল না হয়ে ক্রমেই কারখানাটি লোকসান করতে থাকে। এভাবে গত ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত চিনিকলটি ৫১৪ কোটি ১১ লাখ টাকা লোকসান করেছে। এর মধ্যে গত ২০২০-২১ অর্থবছরে লোকসান গুনতে হয়েছে ৪০ কোটি টাকা। এর ফলে সরকার মিলটি বন্ধ করে দেয়।
এদিকে, মিলটি বন্ধের ফলে কোটি কোটি টাকার সম্পদ খোলা মাঠে মরিচা ধরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অবহেলা আর অযত্নে এই মিলের অবকাঠামোগুলোর দরজা-জানালাও চুরি হচ্ছে। অপরদিকে এই মিলের আওতায় ১ হাজার ৮৪২ একর কৃষি জমির কিছু অংশে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা তৈরি করতে বেপজার নির্বাহী চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. নজরুল ইসলাম গত বছরের ২৪ আগস্ট স্থানটি পরিদর্শন করেন। সেসময় তিনি এখানে ইপিজেড করার জন্য আশ্বাস দেন।
Advertisement
গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার রাখালবুরুজ ইউনিয়নের আখ চাষি জাহিদুল ইসলাম বলেন, রংপুর সুগার মিল আমাদের জন্য আশার আলো ছিল। আমরা আখ চাষের মাধ্যমে কৃষিতে সবচেয়ে বেশি আর্থিক সফলতা পেয়ে থাকি। কিন্তু এই মিলটি বন্ধের ফলে আমরা আখ চাষ বাদ দিয়ে সবজি ও ধান চাষ করছি।
মহিমাগঞ্জ ইউনিয়নের আখ চাষি আব্দুল কাদের বলেন, রংপুর সুগার মিল বন্ধের ফলে আমরা আর আখ চাষ করতে পরছি না। কারণ এখন আখ চাষ করলে জয়পুরহাট মিলে আখ দিতে হবে। এতে আমাদের যাতায়াতে হয়রানি হতে হবে।
তিনি আরও বলেন, গতবছর আমাদের জমিতেই আখ শুকিয়ে যায়। জয়পুরহাট মিলে নিতে অনেক সময় লেগেছে। ফলে আখের ওজন কমে যাওয়ায় আমরা ন্যায্য দাম পাইনি।
গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার রাখালবুরুজ ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য আনিছুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, আমরা রংপুর সুগার মিলের আওতায় আখ চাষ করতাম। মিলটি বন্দের ফলে গতবছর কাটাখালি বাঙ্গালী নদীর তীরের শতশত বিঘা আখ জমিতেই শুকিয়ে যাচ্ছিল। অনেক চাষি মিলে আখ দিতে না পেরে গুড় তৈরি করেছে। মিলটি চালু হলে এই অঞ্চলের কৃষিতে আবারও আখ চাষের সম্ভাবনার দুয়ার খুলবে।
Advertisement
রংপুর সুগার মিল শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের যুগ্ম সম্পাদক মো. আতাউর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, রংপুর সুগার মিলে আমি কানামুনায় (কাজ নাই মজুরি নাই) কর্মরত ছিলাম। সুগার মিল যতদিন চালু ছিল আমার সংসার বেশ ভালোয় চলছিল। মিল বন্ধ হওয়ার ফলে আমার কর্ম বন্ধ হয়ে যায়। ফলে আমার ছেলেমেয়ের পড়াশোনা খরচ যোগাতে মানবেতর জীবন কাটাতে হচ্ছে। আমার মতো শতশত শ্রমিকের একই অবস্থা।
রংপুর সুগার মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নুরুল কবির জাগো নিউজকে বলেন, রংপুর সুগার মিলের সঙ্গে আরও পাঁচটি মিল গত ২০২০ ২ ডিসেম্বর বন্ধ করে বাংলাদেশ চিনিও খাদ্যশিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি)। এই কারখানাগুলোকে আধুনিকায়ন করা হবে বলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। এই মিলের কর্মরতদের আমরা অন্য মিলে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আমারা শুধু দাপ্তরিক কার্যক্রম পরিচালনা করছি। এই মিলের যে ফার্মটি রয়েছে সেই ফার্মের জমিগুলো পরিত্যক্ত আছে। এই জমিতে ইপিজেড করা হচ্ছে বলে আমরা জেনেছি। প্রধানমন্ত্রী ইপিজেড করার পক্ষে আছেন। তবে এখনো জমিগুলো মিলের আওতায় আছে। মিলের ফার্মের অনেক জমি সাঁওতালরা দখল করেছে। এই বিষয়টি আমরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানিয়েছি।
মিলটি কেন বন্ধ করা হয়েছে এ বিষয়ে চাইলে তিনি বলেন, এই মিলের যন্ত্রগুলো অনেক পুরাতন। মিলটি চালু রাখতে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন তা মিলটি থেকে আসে না। চিনি উৎপাদনে যে পরিমাণ খরচ হয় তার চেয়ে চারগুণ কম দামে চিনি বিক্রি করতে হয়। এজন্য মিলটির লোকশান হচ্ছে। এই মিলটি চালাতে গিয়ে আমাদের ১৯৮ কোটি টাকা কৃষি লোন আর বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন থেকে লোন নেওয়া আছে ১৫ কোটি টাকা। এছাড়া এই মিল থেকে ২৬৬ কোটি ৭৯ লাখ টাকা হেড অফিসের এখনো পাওনা আছে। গত ২০২০-২১ অর্থবছরেও এই মিলটির লোকসান হয়েছে ৪০ কোটি টাকা; যার ৩০ কোটি টাকা লোনের সুদ দিতে হয়েছে।
রংপুর সুগার মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরও বলেন, এ অঞ্চলে আখ চাষ যেন ব্যাহত না হয় এজন্য চাষিদের জয়পুরহাট সুগার মিলের আওতায় নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। জয়পুরহাট সুগার মিলের একজন কর্মকর্তা রংপুর সুগার মিলের আখ চাষিদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার মাধ্যমে আখ চাষে উদ্বুদ্ধ করছেন।
এমআরআর/জেআইএম