খরচের তুলনায় আখের দাম না পাওয়া, চিনিকলে সময়মতো বিক্রি না হওয়া, আবার বিক্রি হলেও সময়মতো টাকা না পাওয়ায় নওগাঁয় আখ চাষে আগ্রহ হারিয়েছেন চাষিরা। ফলে আখ চাষের বদলে তারা ধান, সবজি ও পাট চাষে ঝুঁকেছেন। জেলায় গত পাঁচ বছর ধরে টানা আখের চাষ কমেছে।
Advertisement
তবে সময়মতো বীজ, সার ও কৃষি উপকরণ সরবরাহসহ প্রতিকূল আবহাওয়া ও বন্যা সহিষ্ণু উচ্চফলনশীল আখের ব্যবস্থা করা গেলে আবারও চাষে আগ্রহী হবেন বলে জানিয়েছেন চাষিরা। এছাড়া জয়পুরহাট সুগার মিলে আখের চাহিদা মেটাতে নতুন করে চাষিদের আখ চাষে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। ফলে নওগাঁয় আবারও আখ চাষ বাড়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর জেলায় ৪৫৫ হেক্টর জমিতে আখের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ৩৫ হেক্টর, রানীনগরে ২০ হেক্টর, মহাদেবপুরে ৭৫ হেক্টর, বদলগাছীতে ৮০ হেক্টর, মান্দায় ১০৫ হেক্টর, ধামইরহাটে ৭০ হেক্টর এবং পত্নীতলায় ৭০ হেক্টর জমিতে আখের চাষ হয়েছে। এর আগে ২০২১ সালে ৬৩৫ হেক্টর, ২০২০ সালে ৭২৫ হেক্টর, ২০১৯ সালে ৭৫০ হেক্টর এবং ২০১৮ সালে ৮৯৫ হেক্টর জমিতে আখের চাষ হয়েছিল। সে হিসাবে গত পাঁচ বছরের ব্যবধানে জেলায় আখের চাষ কমেছে প্রায় অর্ধেক।
দীর্ঘমেয়াদী ফসল আখ। বছরে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসে জমিতে রোপণ করা হয়। এরপর প্রায় ১১ মাস সময় লাগে পরিপক্ব হতে। প্রতি বিঘাতে ৪০০-৪৫০ মণ পর্যন্ত উৎপাদন হয়ে থাকে। একবার জমিতে রোপণ করা হলে ৪-৫ বছর পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়। প্রতি বিঘাতে প্রথম বছর বীজ, সার, কীটনাশক ও সেচসহ প্রায় ২০ হাজার টাকা খরচ হয়। দ্বিতীয় বছর খরচ কমে হয় ১৪-১৫ হাজার টাকা।
Advertisement
একসময় দাম ভালো পাওয়ায় আখ চাষে কৃষকদের আগ্রহ ছিল। অন্যদিকে বাজারে ধান ও সবজির দাম ওঠানামা করায় চাষিদের লোকসান গুনতে হতো। এতে চাষিদের মাঝে আখ চাষে কিছুটা আগ্রহ ছিল। তবে বর্তমানে সবজি ও ধানের দাম বেশি হওয়ায় চাষিরা আখ চাষে আগ্রহ হারিয়েছেন। এই আগ্রহ হারানোর কারণ হিসেবে চাষিরা জানিয়েছেন- খরচের তুলনায় আখের দাম কম, চিনিকলে সময়মতো বিক্রি না হওয়া এবং বিক্রি হলেও সময়মতো অর্থ না পাওয়া।
আবার অনেক চাষি নিজ উদ্যোগে আখ মাড়াই করে বাড়িতে গুড় উৎপাদন করতেন। তবে গুড় উৎপাদনের বিষয়টি জয়পুরহাট চিনিকল কর্তৃপক্ষ জানার পর চাষিদের নিষেধ করায় তারা তা বন্ধ করে দেন। ফলে আখ চাষের বদলে কৃষকরা ধান, সবজি ও পাট চাষ করছেন। আবারও যদি এসব ফসলের দাম কমে যায় আখ চাষে ঝুঁকবেন তারা।
এদিকে, জয়পুরহাট সুগার মিলে আখের যোগান দিতে জেলার বদলগাছী উপজেলার কোলা ইউনিয়নের ভান্ডারপুর গ্রামে একটি সেন্টার (কেন্দ্র) করা হয়েছে। এ কেন্দ্রের আওতায় এ বছর ৪০ জন চাষি প্রায় ২৫ একর জমিতে আখ চাষ করছেন। যেখানে চাষিদের ঋণের মাধ্যমে বীজ ও সার দিয়ে সহযোগিতা করা হচ্ছে। সময়মতো বীজ, সার ও কৃষি উপকরণ সরবরাহসহ প্রণোদনা দেওয়া, বিক্রির পর মূল্য পরিশোধ এবং প্রতিকূল আবহাওয়া ও বন্যা সহিষ্ণু উন্নতজাতের উচ্চ ফলনশীল আখ নিশ্চিত করা গেলে আখের সুদিন ফিরবে বলে মনে করছেন চাষিরা।
বদলগাছী উপজেলার তাজপুর গ্রামের কৃষক ঈসমাইল হোসেন বলেন, প্রায় ৩০-৩৫ বছর আগে দেড় বিঘা জমিতে আখ চাষ করতাম। সে সময় জয়পুরহাট চিনিকল থেকে লোকজন এসে জমি থেকে আখ নিয়ে যেত। আবার অনেক সময় জমিতে আখ কেটে রাখার পর কয়েকদিন পার হলেও তারা আসে না। এতে আখ শুকিয়ে ওজন কমে যায়। আবার দামও সময়মতো পাওয়া যেত না। নানা ধরনের ভোগান্তি পোহাতে হতো চাষিদের। এসব কারণে আখ চাষে আগ্রহ হারিয়েছেন কৃষকরা। এখন ওই জমিতে বিভিন্ন সবজি, পাট ও ধানের আবাদ করা হচ্ছে।
Advertisement
বারোফলা গ্রামের চাষি জামাল হোসেন বলেন, এক সময় গুড় ৮-১০ টাকা কেজি ছিল। আর এখন ৮০-১০০ টাকা কেজি। এখন গুড়ের দাম বেশি হওয়ায় অন্য ফসলের তুলনায় আখ চাষ লাভজনক বলে মনে হচ্ছে। এক সময় পাঁচ কাঠা জমিতে আখের আবাদ করতাম। আখের আবাদে ঝামেলা কিছুটা কম। দীর্ঘ সময়ের আবাদ। তবে বছর শেষে একসঙ্গে মোটা অঙ্কের টাকা পাওয়ায় কাজে লাগানো সম্ভব হতো।
একই গ্রামের আরেক চাষি নুরুল ইসলাম বলেন, আখ চাষের শুরুতে আমাদের আগ্রহী করা হতো। কিন্তু যখন আখ উৎপাদন হয় তখন পরিবহনের সমস্যা ও সময়মতো আমাদের পাওনা পরিশোধ করা হতো না। এ কারণে চাষিদের আগ্রহ কমতে কমতে এখন এলাকায় আখের আবাদ নেই। তবে সময়মতো যদি বীজ, সার ও কৃষি উপকরণ সরবরাহসহ প্রতিকূল আবহাওয়া ও বন্যা সহিষ্ণু উন্নতজাতের আখের ব্যবস্থা করা এবং সময়মতো দাম পরিশোধ করা হয় তাহলে আবারও আখ চাষ করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
নাজিরপুর গ্রামের আখ চাষি আব্দুর রউফ বলেন, আখ চাষে উদ্বুদ্ধ করতে কিছুদিন আগে আমাদের গ্রামে উঠান বৈঠকসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়। আমি উদ্বুদ্ধ হয়ে জয়পুরহাট সুগার মিল থেকে ৫০ শতাংশ জমিতে আখ চাষের জন্য বীজ ও সার ঋণ নিয়েছি। এছাড়া বিঘাপ্রতি ২ হাজার ৫০০ টাকা ভর্তুকি দেবে। আগে কখনো আখ চাষ করা হয়নি। তবে শুনেছি বাপ-দাদারা আখের চাষ করতেন। আখ উৎপাদনের পর যখন সুগার মিল আখ নেবে তখন ৯ শতাংশ হিসেবে তারা টাকা কেটে নেবে। নদীর চরের জমিতে আলুর সঙ্গে সাথি ফসল হিসেবে আখ লাগানোর কথা ছিল। কিন্তু বৃষ্টিতে আলু কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আলু উঠানোর পর জমিতে আখ রোপণ করবো। এলাকার ১২ জন চাষি আখের বীজ নিয়ে এসেছে। যেহেতু চরের জমি প্রতিবছর বন্যায় ডুবে যায়। যদি প্রতিকূল আবহাওয়া ও বন্যা সহিষ্ণু আখ হয় আমাদের জন্য চাষাবাদে সুবিধা হবে।
জয়পুরহাট সুগার মিলের সহায়তায় বদলগাছী উপজেলার আধাইপুর ইউনিয়নের অকোরবাড়ী গ্রামের চাষি বাবু হোসেন চার বিঘা জমিতে প্রথমবারের মতো আখ চাষ করছেন। তিনি বলেন, আগে কখনো আখ চাষ করিনি। আখ চাষে বীজ ও সার সহযোগিতা করা হয়েছে। চার বিঘা জমিতে আখ চাষের পাশাপাশি সাথী ফসল হিসেবে মসুর ও সরিষা লাগানো হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে তা উঠে যাবে। সব মিলিয়ে প্রায় ৪০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে। আর এ কাজে সহযোগিতা করছেন সুগার মিলের জাহাঙ্গীর হাসান ভাই। তিনি সার্বক্ষণিক পরামর্শ দিচ্ছেন জমিতে কখন কী করতে হবে। আমার মতো এ এলাকার ৪০ জন চাষি আখের আবাদ করছেন।
জয়পুরহাট সুগার মিলের কর্মচারী জাহাঙ্গীর হাসান হাসু বলেন, আখ চাষে উদ্বুদ্ধ করতে চাষিদের উন্নতজাতের বীজ-৩৪, সার ও কীটনাশক ঋণ হিসেবে দেওয়া হচ্ছে। সুগার মিল একটি রাষ্ট্রীয় সম্পদ। আর এ সম্পদকে রক্ষা করতে এবং ঐতিহ্যবাহী জয়পুরহাট সুগার মিলকে বাঁচাতে চাষিদের আখ চাষে আগ্রহী করা হচ্ছে। যেন সামান্য হলেও চাষিরা চাষ করেন। দক্ষতা, পরিচর্যা, সঠিকভাবে সার ও কীটনাশক প্রয়োগে চাষিদের সার্বিক পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া সাথী ফসল হিসেবে মসুর, সরিষা ও পেঁয়াজ চাষের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এতে করে চাষিদের বাড়তি আয় হবে। দেশে চিনির যে ঘাটতি তা আমরা পূরণ করবো। আর আখ যদি না থাকে চিনির দাম বৃদ্ধি পাবে এটাই স্বাভাবিক।
ভান্ডারপুর কেন্দ্র সম্ভাবনাময় উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ কেন্দ্রের আওতায় এ বছর প্রায় ২৫ একর জমিতে আখ চাষ করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে এটি বড় একটি কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত পাবে বলে আশা করছি। গত বছর ১৫০ টাকা মণ হিসেবে আখ কেনা এবং ২-৩ দিনের মধ্যে চাষিদের টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগামী বছর আখের দাম আরও বাড়বে। এছাড়া চাষিদের আখ চাষে সুবিধার জন্য প্রতি একরে ৪ হাজার ৪০০ টাকা ভর্তুকির ব্যবস্থা করা হয়েছে।
চিনি শিল্পকে রক্ষা করতে আখ চাষের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. শামছুল ওয়াদুদ বলেন, জেলায় আখ চাষের লক্ষ্যমাত্রা ৫০৫ হেক্টর নির্ধারণ করা হলেও সেখানে রোপণ হয়েছে ৪৫৫ হেক্টর।
তিনি বলেন, আখ লাভজনক ফসল। তবে উৎপাদিত আখ বিক্রি নিয়ে চাষিরা সমস্যায় পড়েন। এ কারণে চাষিদের অনীহা রয়েছে। তবে সুগার মিল কর্তৃপক্ষ যদি একটু সচেতন হয় এবং কৃষকদের উৎসাহ দেয় তাহলে আবারও আখ চাষ বাড়বে বলে মনে করছি।
শামছুল ওয়াদুদ আরও বলেন, দেশের বাইরে থেকে যেসব চিনি আমদানি করা হচ্ছে সে তুলনায় আমাদের দেশীয় চিনি গুণেমানে অনেক ভালো। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে কৃষকদের আখ চাষে প্রযুক্তিগত সহায়তাসহ সার্বিক পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
আব্বাস আলী/এমআরআর/জেআইএম