বিশেষ প্রতিবেদন

রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলে প্রতি কেজির উৎপাদন খরচ কত?

*চিনির উৎপাদন খরচ বাজারের দ্বিগুণের বেশি, সুদ ধরলে চারগুণ* শুধু উৎপাদন খরচ মিলভেদে ৯৩ থেকে ১৮৬ টাকা* মিলের দায় যুক্ত হলে খরচ ১৩১ থেকে ৩১১ টাকা* প্রতি কেজি চিনিতে গড় খরচ ২২৫ টাকা ৬০ পয়সা * বাজারদর ৭৪ টাকা

Advertisement

গত মৌসুমে (২০২০-২১ অর্থবছর) ঠাকুরগাঁও চিনিকলে প্রতি কেজি চিনি উৎপাদনে খরচ হয় ১৭৭ টাকা। এর সঙ্গে যদি মিলটির দায়দেনা ও ব্যাংক লোনের সুদহার যুক্ত হয় তাহলে প্রকৃত খরচ দাঁড়ায় প্রায় ৩০০ টাকা। পাইকারিতে বাজারে বিক্রি দাম ৭৪ টাকা। শুধু এ চিনিকল নয়, প্রতিটি চিনিকলে বেশি দামে উৎপাদন করে কম দামে বিক্রি করছে সরকার। এ রেওয়াজ চলছে তিন দশক ধরে।

পাঁচ মাড়াই মৌসুমের তথ্য নিয়ে চিনি উৎপাদন ও দামের একটি তুলনামূলক চিত্র তৈরি করেছে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি)। এতে দেখা যায়, ১৯৮৫-৮৬ থেকে ১৯৮৯-৯০ সালের পর থেকে প্রতি কেজি চিনি উৎপাদন খরচ গড় বিক্রয়মূল্যের চেয়ে বেশি হয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় ২০১৫-১৬ থেকে ২০১৯-২০ পর্যন্ত পাঁচ মাড়াই মৌসুমে মিলভেদে উৎপাদিত চিনির কেজিপ্রতি খরচ ৯৩ টাকা থেকে ১৮৬ টাকা পর্যন্ত পৌঁছেছে।

এ খরচ মিলের বিপরীতে গৃহীত ঋণের সুদসহ বিবেচনা করলে তা ১৩১ থেকে ৩১১ টাকা পর্যন্ত। গড় হিসাবে কেজিপ্রতি উৎপাদিত চিনির খরচ ২২৫ টাকা ৬০ পয়সা। অথচ বর্তমানে চিনির বাজারমূল্য ৭৮ টাকা, যা মিলগুলো ৭৪ টাকা দরে সরবরাহ করছে।

Advertisement

বিপুল এ অর্থ লোকসানের পেছনে রয়েছে বেশকিছু কারণ। এর মধ্যে বড় কারণ আখের সংকট। বেসরকারি খাতের চিনি আমদানি উদারীকরণ, মিলগুলোর ব্যবস্থাপনাগত সংকট, পরিবহনের সংকট, কারখানার প্রসেস লস, টেকনিক্যাল পারফরম্যান্সের সমস্যা, ঋণের সুদ পরিশোধের দায় ও চিনি বিক্রির যথাযথ উদ্যোগের অপ্রতুলতার কারণে দিন দিন বেড়েছে উৎপাদন খরচ।

বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় চিনিকল জয়পুরহাটে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত মৌসুমে আখের সংকটে মাত্র ১৮ দিন মাড়াই চলেছে সেখানে। তখন ২১ হাজার ৪৪৯ টন আখ মাড়াই করে এক হাজার ১৬২ টন চিনি উৎপাদন করা হয়েছে। চিনি আহরণের শতকরা হার ছিল ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। অর্থাৎ সারা বছরের মিলের খরচের দায়ভার পড়বে ওই ১৬২ টন চিনির দামের ওপর।

সবচেয়ে বড় মিলে এ পরিস্থিতির কারণ জানতে চাইলে মিলটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আখলাছুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আখ সংকটে এবছর মাড়াই হয়নি। সামান্য উৎপাদন করা গেছে। এ সমস্যার কোনো সমাধান নেই।’

তিনি বলেন, ‘আখ যদি না থাকে লোকসান কীভাবে কমানো সম্ভব? চিনিকল ফেলে রেখে কোনো কিছু সম্ভব নয়।’

Advertisement

উৎপাদন খরচের আরেক বড় কারণ সরকারি চিনিকলগুলো প্রায় সব পুরোনো। তিনটি গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকের, তিনটি পঞ্চাশের দশক, সাতটি ষাটের দশক এবং দুটি স্বাধীনতার পর স্থাপিত হয়েছে। যন্ত্রপাতি পুরোনো হওয়ায় তা মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে খরচ হচ্ছে কোটি কোটি টাকা।

এমন পরিস্থিতিতে ছয়টি চিনিকল বন্ধ করা হয়। তারপরও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। সম্প্রতি লোকসানের কারণে রংপুর বিভাগের সেতাবগঞ্জ ও পঞ্চগড়ের সুগারমিল বন্ধ করে সরকার। তবে চালু রাখা হয় ঠাকুরগাঁওয়ের সুগারমিলটি। কিন্তু তাতেও লাভ হয়নি। গত মৌসুমে ২৪ ডিসেম্বর মিলটি চালু হওয়ার পর যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে কয়েক দফায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। খরচ বেড়েছে অনেক।

এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁও চিনিমিলের ব্যবস্থাপক শাহজাহান কবির বলেন, যন্ত্রপাতি পুরোনো হয়ে যাওয়ায় তা মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে খরচ অনেক বেশি। ফলে খরচ অনেক বেড়ে যাচ্ছে। এরপর আবার মিলের বিপরীতে গৃহীত ঋণের সুদসহ বিবেচনা করলে সেটা তারও দ্বিগুণ হয়। এটা একটি বড় সমস্যা।

অন্যদিকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এমন পরিস্থিতিতে ঝিনাইদহের মোবারকগঞ্জ কলে এককেজি চিনি উৎপাদন করতে খরচ হয় ১২৩ টাকা। অন্যান্য ব্যয় হিসাবে নিলে সেটা ১৮২ টাকায় দাঁড়ায়। অর্থাৎ ১৮২ টাকার খরচায় উৎপাদিত এককেজি চিনিতে ব্যাংক সুদ ৫৯ টাকা। নাটোর চিনিকলে শুধু চিনি উৎপাদন খরচ ১২৫ টাকা এবং জিল বাংলায় ১৮২ টাকা।

এনএইচ/জেআইএম