রমজানে অনেকের টিকা নেওয়ার তারিখ। বিষয়টি নিয়ে অনেকেই চিন্তিত। রমজানে টিকা নেওয়ার মেসেজ পেয়ে অনেকেরই জিজ্ঞাসা- রোজা রেখেও কি টিকা নেওয়া যাবে? দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই, রোজা রেখেও নেওয়া যাবে টিকা। ডায়াবেটিস রোগীরা নিতে পারবেন নিয়মিত ইনসুলিন। এমনকি জরুরি প্রয়োজনে অনেক রোগী ইনজেকশনও গ্রহণ করতে পারবেন। দেশের ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বিশ্বব্যাপী ইসলামিক স্কলার ও গ্র্যান্ড মুফতিদের ভাষ্য অনুযায়ী, রোজা রেখেও টিকা, ইনসুলিন, ইনজেকশন এমনকি প্রয়োজনে স্যালাইনও নেওয়া যাবে।
Advertisement
রোজা রাখা আল্লাহর নির্দেশ। কিন্তু অসুস্থতার কারণে কিংবা মহামারি ভাইরাস থেকে আত্মরক্ষায় মাংসপেশী, শিরায় কিংবা চামড়ার নিচে ইনসুলিন বা টিকাজাতীয় ইনজেকশন নিতে হয়। কেউ কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত আবার কেউ ভাইরাস কিংবা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়। রোজায় তারা মাংসপেশী, শিরায় কিংবা চামড়ার নিচে টিকা-ইনসুলিনজাতীয় ইনজেকশন নিতে পারবে। ইসলামিক স্কলাররা এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
রমজান মাসে রোজা রেখে করোনাভাইরাসের টিকা নেওয়া যাবে, টিকা নিলে রোজা নষ্ট হবে না। ১৪ মার্চ ২০২১ (রোববার) ইসলামিক ফাউন্ডেশনের এক সভায় আলেমরা এই মত জানিয়েছেন বলে ১৫ মার্চ (সোমবার) ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছিল, যা দেশের প্রায় সব গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল।
Advertisement
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, রোববার (১৪ মার্চ) ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সভাকক্ষে ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক মো. মুশফিকুর রহমানের সভাপতিত্বে দেশের বরেণ্য উলামায়েকেরাম এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নূরুল ইসলাম প্রধান অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন।
সভায় পবিত্র রমজান মাসে কোভিড-১৯ এর চলমান টিকা কার্যক্রম বিষয়ে আলোচনা করা হয় এবং দেশের জনগণের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ও জীবন রক্ষার স্বার্থে করোনার টিকা গ্রহণের প্রতি গুরুত্বরোপ করা হয় বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
এতে আরও বলা হয়, আলোচনায় উপস্থিত আলেম সমাজ সর্বসম্মতভাবে একমত পোষণ করেন যে-‘করোনাভাইরাসের টিকা মাংসপেশিতে গ্রহণ করা হয় এবং তা সরাসরি খাদ্যনালী ও পাকস্থলিতে প্রবেশ করে না। তাই রমজান মাসে রোজাদার ব্যক্তি দিনের বেলায় শরীরে করোনাভাইরাসের টিকা গ্রহণ করলে রোজা ভঙ্গ হবে না।’
ইসলামি আইন শাস্ত্রের সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত হলো-‘প্রয়োজনের তাগিদে যে কোনো ধরনের টিকা বা ইনজেকশন নিলে রোজা নষ্ট হবে না। চাই তা শিরায় দেওয়া হোক কিংবা চামড়ার নিচে, মাংসে বা পেটে। টিকা ও ইনজেকশন নেওয়ার ধরনগুলো হলো-১. মহামারি করোনা থেকে আত্মরক্ষায় টিকা নিতে হয়।২. কুকুরে কামড় দিলে নিয়মিত নির্দিষ্ট সংখ্যক ইনজেকশন নিতে হয়।৩. ডায়াবেটিস রোগীদের নিয়মিত ইনসুলিন নিতে হয়।৪. হার্টের রোগীদের পেটে কিংবা চামড়ার নিচে ইনজেকশন নিতে হয়।৫. যে কোনো ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আগে কিংবা পরে টিকা নিতে হয়।৬. প্রয়োজনে সালাইনও গ্রহণ করতে হয়।
Advertisement
অধিকাংশ ইসলামিক স্কলারের মতে এটা সুস্পষ্ট যে- এতে তাদের রোজা ভাঙবে না। প্রয়োজনের তাগিদে টিকা, ইনসুলিন ও স্যালাইন গ্রহণ করা যাবে।
গবেষণায় রোজা না ভাঙার কারণ হিসেবে যা উল্লেখ করা হয়েছে তাহলো-বিশ্ববিখ্যাত ইসলামিক স্কলারদের গবেষণা ও ফতোয়া এবং আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণার সম্বন্বয়ে এটা প্রমাণিত। তাই নির্ধারিত ক্ষেত্রে টিকা ইনসুলিন, ইনজেকশন কিংবা অসুস্থতায় স্যালাইন গ্রহণ করলে রোজা ভাঙবে না।
ইনজেকশনের মাধ্যমে যেসব ওষুধ শরীরে প্রবেশ করনো হয়, তা রোজা ভেঙে যাওয়ার জন্য যে শর্ত রয়েছে এসব ইনজেকশন তার আওতায় পড়ে না। কেননা রোজা ভেঙে যাওয়ার জন্য যে খাদ্যনালী বা মস্তিষ্কের রাস্তা পথ কিংবা যে গ্রহণযোগ্য রাস্তা রয়েছে তা দিয়ে ইনজেকশন, ইনসুলিন, স্যালাইন কিংবা টিকা ইত্যাদি প্রবেশ করানো হয় না।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের গ্র্যান্ড মুফতির ফতোয়াবিশ্বব্যাপী প্রাণঘাতী বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক হিসেবে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন রোজা রেখে নেওয়া যাবে কিনা এ বিষয়ে সুস্পষ্ট ফতোয়া দিয়েছেন- সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রধান মুফতি শায়খ ড. আহমাদ বিন আব্দুল আজিজ আল-হাদ্দাদ।
গ্র্যান্ড মুফতি জানান, ‘রোজাদার ব্যক্তি মুখ, নাক ও অন্যান্য খোলা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়ে কোনো খাবার, পানীয় ও ওষুধ জাতীয় কোনো কিছু গ্রহণ করতে পারবে না। আর করোনার টিকা সূঁচের মাধ্যমে (ইন্ট্রামাস্কুলার) মাংসে দেওয়া হয়। সূঁচের মাধ্যমে মাংসে টিকা নিলে রোজা ভাঙবে না বিধায় রোজাদার ব্যক্তি করোনার টিকা গ্রহণ করতে পারবে।'
গ্যান্ড মুফতি আল-হাদ্দাদ আরও জানিয়েছেন, ‘নাকের শ্লেষ্মা বা রক্তের ফোঁটা থেকে করোনা পরীক্ষার নমুনা নেওয়া হলেও রোজা ভাঙবে না। তাই প্রয়োজনে রোজা রেখে করোনা ভাইরাসের পরীক্ষাও করা যাবে। আর এ পরীক্ষার ফলে নাকের ভেতর নরম কাঠির মাধ্যমেও কোনো জিনিস প্রবেশ করে না। অধিকাংশ ইসলামিক স্কলারদের মতে, এতে রোজা ভাঙবে না বলেও জানিয়েছেন তিনি।
বিশ্ববিখ্যাত ইসলামিক স্কলারদের গবেষণা, ফতোয়া ও আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণার সম্বন্বয়ে এটা প্রমাণিত যে- ইনসুলিন, ইনজেকশন, টিকা কিংবা অসুস্থতায় স্যালাইন গ্রহণে রোজা ভাঙবে না।
কারণ ইনজেকশন দ্বারা যেসব ওষুধ শরীরে প্রবেশ করনো হয়, তা রোজা ভেঙে যাওয়ার জন্য যে শর্ত রয়েছে; তার মধ্যে পড়ে না। রোজা ভেঙে যাওয়ার জন্য যে গ্রহণযোগ্য রাস্তা তথা খাদ্যনালী বা মস্তিষ্কের রাস্তা পথ রয়েছে তা দিয়ে ইনজেকশন, ইনসুলিন, স্যালাইন কিংবা টিকা ইত্যাদি প্রবেশ করানো হয় না।
উল্লেখ্য, ভ্যাকসিনের টিকা বা এ ওষুধগুলো শরীরের ভেতরে প্রবেশ করে তা খাদ্যনালী দিয়ে পেটে যায় না। বরং অন্য রগ দিয়ে তা ঢুকে থাকে। তাই ইনজেকশন জাতীয় চিকিৎসা গ্রহণের দ্বারাও রোজা ভাঙবে না।
তবে তাদের জন্য সতর্কতা!যারা রোজার কষ্ট কমানোর উদ্দেশ্যে স্যালাইন গ্রহণ করবে তাদের রোজা মাকরূহ হয়ে যাবে। সুতরাং এ মানসিকতা থেকে বিরত থাকতে হবে।
আবার এমনটিও যেন না হয় যে-ডায়াবেটিস কিংবা ইনজেকশন নিতে হয় বলে রোজা রাখা যাবে না। এ অজুহাতে রোজা থেকে বিরত থাকার কোনো সুযোগ নেই।
মনে রাখতে হবেরোজা আল্লাহর ফরজ বিধান। এ বিধান পালনে মহান আল্লাহ অনেক সহজ বিধান দিয়েছেন। যেমন মহান আল্লাহ ঘোষণা দিয়েছেন এভাবে-‘কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এ মাসের রোজা রাখবে। আর যে লোক অসুস্থ কিংবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে সে অন্য দিনে গণনা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান; তোমাদের জন্য জটিলতা কামনা করেন না যাতে তোমরা গণনা পূরণ কর এবং তোমাদের হেদায়েত দান করার দরুন আল্লাহ তা'আলার মহত্ত্ব বর্ণনা কর, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৫)
সুতরাং যাদের টিকার ম্যাসেজ এসেছে কিংবা রমজানের মধ্যে রোজার তারিখ পড়েছে, তাদের টিকা গ্রহণে কোনো বাঁধা নেই। নিঃসন্দেহে রোজা রেখে ভাইরাসের টিকা গ্রহণ করা যাবে।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে রোজার যথাযথ হক আদায় করে তা পালনের তাওফিক দান করুন। রোজার বরকতের অসুস্থদের সুস্থ করে দিন। আমিন।
এমএমএস/জেআইএম