দেশজুড়ে

খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে জয়পুরহাট সুগারমিল

বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের জেলা শহর জয়পুরহাটে ১৯৬০ সালে অর্থাৎ ৬২ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয় জয়পুরহাট সুগার মিল। তখন দৈনিক ১ হাজার ১৬ মেট্রিক টন আখ মাড়াই ও বাৎসরিক ১০ হাজার ১৬০ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে প্রায় ২১৭ একর জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় চিনিকলটি। বর্তমানে নতুন বয়লার স্থাপনের (বিএমআরআই) পর দৈনিক আখ মাড়াই ক্ষমতা বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৩২ মেট্রিক টন ও বাৎসরিক চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা বেড়েছে ২০ হাজার ৩২০ মেট্রিক টন।

Advertisement

জানা গেছে, বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প সংস্থার আওতাধীন জয়পুরহাট সুগার মিলে ১৯৬৩-৬৪ অর্থবছরে মাড়াই মৌসুম শুরু হয়। এরপর থেকে মিলটিতে লাভ-লোকসান মিলিয়ে চললেও ১৯৯৪-৯৫ অর্থবছরে মাড়াই মৌসুমের পর থেকে মিলটি আর লাভের মুখ দেখেনি।

সবশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রয়োজনীয় আখ না পাওয়ায় এ মিলে ২১ হাজার ৪৪৫ মেট্রিক টন আখ মাড়াইয়ে চিনি উৎপাদন হয় মাত্র ১ হাজার ১৬২ মেট্রিক টন। চিনি আহরণের হার ছিল ৫ দশমিক ৪০ শতাংশ, যা গত পাঁচ বছরে সবচেয়ে কম।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত মৌসুমের প্রায় ৭৭ কোটি টাকা লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে দেশের বৃহত্তম চিনি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান জয়পুরহাট চিনিকলে ২০২১-২২ আখ মাড়াই মৌসুম শুরু হয়। ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর শুরু হয়ে আখ মাড়াই বন্ধ হয়ে যায় ২০২২ সালের ১৮ জানুয়ারি। চিনিকলের ৫৯তম আখ মাড়াই মৌসুম চলেছে অন্য দুটি বন্ধ হওয়া রংপুরের শ্যামপুর ও গাইবান্ধার মহিমাগঞ্জ চিনিকলের আখ নিয়ে। তারপরও মিল চলে মাত্র ১৮ দিন।

Advertisement

জয়পুরহাট চিনিকলের গুদামে ২০২২ সালের মার্চ মাসের অর্ধেক পর্যন্ত প্রায় ৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা মূল্যের চিনি আছে। মোলাসেস (চিটাগুড়) আছে ১ কোটি ২৯ লাখ টাকার। বর্তমানে চিনিকলের ২১২ কোটি টাকা পুঞ্জীভূত ঋণের বিনিময়ে প্রতি বছর সুদ দিতে হয় ৩৮ কোটি ৯১ লাখ টাকা।

২২০ টাকা উৎপাদন খরচ হলেও মাত্র ৭৪ টাকা দরে চিনি বিক্রি করতে হচ্ছে মিল কর্তৃপক্ষকে। বেশি মূল্যের পাশাপাশি আমদানি করা চিনি অপেক্ষা জয়পুরহাট চিনিকলের চিনির রং লালচে হওয়ায় বাজারে এর চাহিদা কম। ফলে মান ভালো হলেও জয়পুরহাট চিনিকলের চিনি কেনেন না স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।

এ মিলের দীর্ঘদিনের পুরোনো যন্ত্রপাতি সংস্কার এবং দক্ষ শ্রমিকের অভাব ও কানামনা (কাজ নাই মজুরি নাই) জনবল দিয়ে কাজ করায় মিলের কর্মদক্ষতা কমেছে। বর্তমানে কারখানায় শ্রমিক-কর্মচারীর ১ হাজার ২৩৯ পদের মধ্যে ৫৫৫ জন কর্মরত। এছাড়া অন্য দুটি মিলের ৪০০ জন শ্রমিক-কর্মচারী এখানে যোগ দিয়েছেন।

মিলের নিজস্ব জমির পরিমাণ প্রায় ২১৭ একর। এর মধ্যে আবাদযোগ্য জমি ৬৫ একর, কারখানা ২৭ একর, অফিস-বাসা-স্কুল ৫১ একর, আখ ক্রয় কেন্দ্র ২৪ একর, পুকুর/জলাশয়-কবরস্থান-খেলার মাঠ-রাস্তা-বনায়নসহ ৫০ একর। ১২ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন চিনি গুদামজাতকরণের গুদাম দুটি, ১ হাজার মেট্রিন টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন চিটাগুড় সংরক্ষণের জন্য স্টিল ট্যাংক আটটি। আখ ক্রয় কেন্দ্রের সংখ্যা ৬৬টি। সাত কোটি টাকা ব্যয়ে বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) প্রকল্প একটি।

Advertisement

আরও জানা গেছে, ২০২১-২২ মাড়াই মৌসুমে জয়পুরহাট সুগারমিল এলাকার ২৫ হাজার মেট্রিন টন আখসহ রংপুরের শ্যামপুর ও গাইবান্ধার মহিমাগঞ্জ এলাকার ৫ হাজার মেট্রিক টন আখ আসার পরও এবার মিল চলেছে মাত্র ১৮ দিন। চিনি উৎপাদন হয়েছে পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন ১ হাজার ১৬২ মেট্রিক টন। এবার মিলগেটে আখের মূল্য কুইন্টালপ্রতি ৩৫০ টাকা এবং বাইরের কেন্দ্রগুলো থেকে ৩৪৩ টাকা দরে আখ কেনা হয়। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে চাষিদের আখের মূল্য পরিশোধের উদ্যোগ নিয়েছে চিনিকল কর্তৃপক্ষ।

আগের বছরগুলোতে আখের কম দাম নির্ধারণ, মূল্য পরিশোধে চিনিকল কর্তৃপক্ষের গড়িমসিসহ কৃষক হয়রানির কারণে আখের বদলে কৃষকরা ঝুঁকে পড়েছেন বিকল্প ফসল চাষে। এছাড়া আখের মূল্য সময়মতো পরিশোধ না করায় গত কয়েক বছর আগে ১৬৮ একর আখের মুড়ি উপরে ফেলেন কৃষকরা। ফলে জয়পুরহাট চিনিকল এলাকায় আশঙ্কাজনকভাবে আখ চাষ কমে যায়। ফলে জয়পুরহাটসহ বন্ধ হয়ে যাওয়া দুটি চিনিকল এলাকার আখ নিয়েও খুঁড়িয়ে চলছে দেশের বৃহত্তম এ চিনিকল। এ অবস্থায় কৃষক হয়রানি বন্ধ হলে আবারও ঘুরে দাঁড়াবে এ চিনিকল, এমন পরামর্শ কৃষকদের। অন্যদিকে চিনিকলটির আগের অবস্থা ফিরিয়ে আনার পথ খুঁজছেন সংশ্লিষ্টরা।

জয়পুরহাট চিনিকল এলাকার সদর উপজেলার বেলআমলার রেজাউল করিম, নিশির মোড় এলাকার সুজন কুমার মণ্ডল, পাঁচবিবি ফিসকাঘাট এলাকার আহসান হাবীব ও কড়িয়া হাজীপাড়া গ্রামের শহীদুল ইসলাম বলেন, এক সময় মিলে আখ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টাকা পরিশোধ করা হতো। তখন তারা আখ আবাদ করেছেন। এখন মিলে আখ দেওয়ার পর টাকার জন্য অপেক্ষা করতে হয়, ধরনা দিতে হয়, আবার দামও কম, এজন্য আখের আবাদ করেন না। সুদিন এলে অবশ্যই আবাদ করবেন।

জয়পুরহাট চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি মো. আলী আকতার বলেন, কম দামের বিদেশি চিনি আমদানির কারণে দেশে উৎপাদিত চিনি উন্নতমানের হলেও তা বারবার স্থানীয় বাজারে মার খাচ্ছে। এ কারণে জয়পুরহাটসহ দেশের চিনিকলে উৎপাদিত চিনি বিক্রি হচ্ছে না।

তিনি আরও বলেন, মিল চলবে কী চলবে না দোটানায় এবার আখ অনেকটা কম রোপণ করেছেন কৃষকরা। তবে আগামী আখ মাড়াই মৌসুমে অধিক আখ রোপণের জন্য কাজ করছেন কর্মচারীরা। আমরা আশা করছি, প্রায় ৪০ দিন মিল চলবে এবং চিনি উৎপাদনও অনেক বেশি হবে। আখের দাম বাড়ানোসহ মূল্য ঠিক সময়ে পরিশোধ করলে আখের উৎপাদন বাড়বে।

জয়পুরহাট চিনিকল আখচাষি কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. খাজা নাজিমউদ্দিন বলেন, প্রণোদনাসহ আখের মূল্য কুইন্টালপ্রতি ৫০০ টাকা নির্ধারণ করলে ও সময়মতো টাকা পরিশোধ করলে কৃষক অবশ্যই আখ আবাদ করবেন।

জয়পুরহাট চিনিকলের ভারপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক (কৃষি) মো. তারেক ফরহাদ বলেন, ২০২২-২৩ রোপণ মৌসুমে ৭ হাজার ৫০০ একর জমিতে লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছিল। এ পর্যন্ত ২ হাজার ৫৭৭ একর জমিতে আখ রোপণ করা হয়েছে।

তিনি বলেন, পাঁচ বছর ধরে আখের আবাদ কমে আসার প্রধান কারণ স্পল্পমেয়াদি ফসলের দাম বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে আখের মূল্য কম ও মূল্য পরিশোধ সম্ভব হয় না। মিল জোন এলাকায় শ্রমিক সংকট ও নদী-তীরবর্তী এলাকায় মাটি কাটার কারণে আখ চাষ করা সম্ভব হচ্ছে না।

জয়পুরহাট চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কৃষিবিদ আখলাছুর রহমান বলেন, আখের আবাদ বৃদ্ধিসহ সুগারমিল সচল রাখতে মিল কর্তৃপক্ষ কাজ করছে। প্রতি বছর নতুন নতুন যন্ত্রপাতি সংযোজন করাসহ নতুন উন্নয়ন প্রকল্পের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।

এমআরআর/জিকেএস