দেশজুড়ে

বন্ধ চিনিকলেও বাড়ছে দেনা

টানা লোকসানের মুখে ২০২০-২১ মৌসুম থেকে মাড়াই কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে রংপুরের একমাত্র চিনিকল শ্যামপুর সুগার মিল। সেই থেকে বন্ধ মিল এলাকার আখ চাষও। এক সময়ের প্রাণচাঞ্চল্যে ঘেরা এ মিলে এখন কেবলই সুনসান নীরবতা। দাপ্তরিক কার্যক্রম চললেও কর্মকর্তা-কর্মচারীর উপস্থিতি কম। নেই কর্মচাঞ্চল্য, নেই শ্রমিক-চাষিদের আগের মতো হাঁকডাক।

Advertisement

এদিকে দীর্ঘ সময় উৎপাদন বন্ধ থাকায় চিনিকলের যন্ত্রপাতি প্রায় নষ্টের উপক্রম। বিকল হয়ে পড়ে আছে আখ পরিবহনে ব্যবহৃত ট্রাক্টরগুলো। ফলে মিল বন্ধের পরও বাড়ছে দেনা। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনসহ অন্য খাত মিলে বকেয়া প্রায় ২১ কোটি টাকা। এ অনিশ্চয়তা কাটাতে বিকল্প উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির লক্ষ্যে কিছু প্রস্তাবনা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হলেও এখনো আলোর মুখ দেখেনি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার শ্যামপুর বন্দরে ১৯৬৪ সালে নির্মাণ হয় শ্যামপুর সুগার মিল। ১১১ দশমিক ৪৫ একর জমির ওপর নির্মিত এ মিলে আনুষ্ঠানিকভাবে মাড়াই শুরু হয় ১৯৬৭ সালে। দৈনিক আখ মাড়াইয়ের সক্ষমতা রাখা হয় ১ হাজার ১৬ টন। বার্ষিক উৎপাদনক্ষমতা ধরা হয় ১০ হাজার ১৬১ টন। বছরে মিলের মেশিন চালু থাকে তিন মাস।

চালুর পর থেকে লাভের মুখ দেখলেও ২০০০ সালের পর থেকে টানা লোকসানের মুখে পড়ে মিলটি। ব্যাংক ঋণ, ঋণের সুদ ও শ্রমিক-কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ডসহ বিভিন্ন খাত মিলে শেষ পর্যন্ত লোকসান বেড়ে হয় ৫০৫ কোটি টাকা। এ পরিস্থিতিতে শিল্প, বাণিজ্য, অর্থ ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি মিলটির মাড়াই কার্যক্রম বন্ধের সুপারিশ করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০-২১ মাড়াই মৌসুমে মিলের কার্যক্রম বন্ধ করে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন।

Advertisement

মিল এলাকায় আখ উৎপাদন কমে যাওয়া ও আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাবে লোকসানের বোঝা বাড়ছে বলে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ দাবি করলেও তা মানতে নারাজ ছিলেন শ্রমিক-কর্মচারী ও আখ চাষিরা। কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, অদক্ষ জনবল ও অব্যবস্থাপনাসহ নানা কারণে লোকসানের পরিমাণ বাড়ছে বলে দাবি তাদের।

এ নিয়ে আন্দোলন শুরু করে চিনিকল অ্যামপ্লয়ীজ ইউনিয়ন ও আখ চাষি কল্যাণ সমিতি। তবে শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি সেই আন্দোলন। অব্যাহত লোকসান দেখিয়ে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় মিলটি। সেই থেকে মিল এলাকায় বন্ধ আখচাষও। এর পরিবর্তে ভুট্টা, আলু ও ধানসহ বিভিন্ন ফসলের চাষাবাদ করছেন কৃষকরা।

চিনিকল অ্যামপ্লয়ীজ ইউনিয়নের সদস্য ও চিনিকলের অফিস সহায়ক আমিনুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, গত বছরের জুন মাস থেকে বেতন বন্ধ। এর মধ্যে গত জানুয়ারি মাসের বেতন পেলেও বাকি আট মাসের বেতন বন্ধ। এ অবস্থায় পরিবার-পরিজন নিয়ে কষ্টে দিন পার করতে হচ্ছে। সরকারিভাবে ভর্তুকি দিয়ে হলেও মিলটি পুনরায় চালুর দাবি জানাই।

মিল সূত্রে জানা যায়, কার্যক্রম চালু থাকাকালে মিলে সর্বশেষ ৪৯৩ জন স্থায়ী ও অস্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিলেন। মিলটি বন্ধের পর অনেকেই অবসর গ্রহণ করেছেন এবং কিছু জনবল অন্য মিলে বদলি করা হয়েছে। বর্তমানে শ্যামপুর চিনিকলে ১০৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিক বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত।

Advertisement

তিন বছর আগে অবসর গ্রহণ করেন একজন বোর্ডিং হাউসের মেকানিজ নুরুর ইসলাম। এখন পর্যন্ত তার প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকার কোনো খবর নেই। কবে নাগাদ টাকা পাবেন তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।

নুরুল ইসলাম বলেন, ২০১৯ সালে অবসর নিয়েছি। নিজের কোনো জমি নেই। অন্যের জমি বর্গা নিয়ে আখ চাষ করলেও এখন মিল বন্ধ থাকায় সেটা সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় টাকা না পেয়ে কষ্টে দিন কাটছে।

মিলটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কৃষিবিদ মো. আহ্সান হাবিব বলেন, কৃষিনির্ভর উত্তরাঞ্চলের অন্যতম একটি ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান ছিল শ্যামপুর সুগার মিল। এর সঙ্গে জড়িত ছিল কয়েক হাজার পরিবার। কিন্তু মিলটি বন্ধ হওয়ায় এখন দুর্বিষহ অবস্থা বিরাজ করছে।

এলাকার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে মিলটি পুনরায় চালুর দাবি জানিয়ে আহ্সান হাবিব বলেন, শ্রমিক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ড বাবদ ৭ কোটি, গ্রাচ্যুয়িটি বাবদ ১০ থেকে ১১ কোটি এবং বেতন বাবদ প্রায় ৪ কোটি টাকা বকেয়া। এ অবস্থায় মিলটি উৎপাদনমুখী করতে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে গত বছরের নভেম্বরে কিছু প্রস্তাবনা সংশ্লিষ্ট দফতরে পাঠানো হয়েছে। এগুলো হলো- মিলের নিজস্ব জায়গায় আলুর কোল্ড স্টোরেজ নির্মাণ, কৃষিভিত্তিক শিল্পকারখানা স্থাপন এবং পিপি ব্যাগ ও চিনির প্যাকেট তৈরির কারখানা স্থাপন, যা থেকে বার্ষিক কয়েক লাখ টাকা আয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। এসব প্রস্তাবনা সংশ্লিষ্ট দফতরে পাঠিয়েছি। আশা করছি প্রস্তাবনাগুলোর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

এসজে/জিকেএস