তার নেতৃত্বেই ক্রিকেটে সর্বপ্রথম কোন বিশ্ব আসরে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ। বছর দুয়েক আগে যুব বিশ্বকাপের আসরে ভারতকে হারিয়ে শিরোপা জিতেছিল বাংলাদেশ। ফাইনালে জুনিয়র টাইগারদের জয়ের স্থপতি ও নায়ক অধিনায়ক আকবর আলী।
Advertisement
দলের চাপের মুখে একদিক আগলে রেখে ধৈর্য্য, সংযম ও পরিণত মস্তিষ্কের পরিচয় দিয়ে ৪৩ রানের এক অসাধারণ ইনিংস উপহার খেলে সাহসী নাবিকের মতো দলকে জয়ের বন্দরে পৌঁছে দিয়ে ম্যাচসেরাও হন আকবর। তারপর থেকে বাংলাদেশের ক্রিকেটে তিনিই হয়ে উঠেছিলেন নতুন যুবরাজ।
কিন্তু ঐ বিশ্বকাপ মিশনের পর যেনো সেভাবে আগাতে পারেননি আকবর। তার নেতৃত্বে খেলা পারভেজ হোসেন ইমন, শামীম পাটোয়ারী, মাহমুদুল হাসান জয়, শরিফুল ইসলামদের তুলনায় দিনকে দিন পিছিয়েই পড়েছিলেন। যুব বিশ্বকাপের সেই উদ্যমী ও সংকল্পবদ্ধ আকবরের দেখা মেলেনি গত দুই বছর।
প্রিমিয়ার লিগ, বিপিএল, এনসিএল ও বিসিএলে ঠিক নিজের নামের প্রতি সুবিচার করতে পারছিলেন না দেশকে যুব ক্রিকেটের ট্রফি উপহার দেয়া রংপুরের এ ২০ বছরের আত্মপ্রত্যয়ী যুবা। অবশেষে এবারের লিগে যেন নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন আকবর, জ্বলে উঠেছে তার ব্যাট। শেষ তিন ম্যাচেই রান পেয়েছেন।
Advertisement
সিটি ক্লাবের বিপক্ষে ৩০ বলে ২৭ রানের ইনিংস দিয়ে শুরু। খেলাঘরের সঙ্গে মাত্র ১ রানে ফিরলেও শাইনপুকুরের বিপক্ষে ৬০ বলে ৬১ এবং পরের দুই ম্যাচে ১৮০+ স্ট্রাইকরেটে ২৩ বলে ৪২ (প্রতিপক্ষ ব্রাদার্স) ও ৪৫ বলে ৮৯ (প্রতিপক্ষ মোহামেডান) রানের ইনিংস খেলে দলকে জিতিয়েছেন গাজী গ্রুপের এবারের অধিনায়ক।
বুধবার বিকেএসপিতে মোহামেডানের বিপক্ষে ৪৫ বলে হাফ ডজন ছক্কা ও ৫ বাউন্ডারি দিয়ে সাজানো আকবরের হার না মানা টর্নেডো ইনিংসের কাছেই তছনছ হয়ে গেছে সাদাকালোদের বোলিং। লম্বা সময় নিজেকে মেলে ধরতে না পারা আকবর আলী আবার পাদপ্রদীপের আলোয়।
হঠাৎ কীভাবে নিজেকে খুঁজে পাওয়া? মাঝে প্রায় হারিয়ে যেতে বসা সময়টা কেমন ছিল? আগামীতে কী করতে চান আকবর? জাগো নিউজের সঙ্গে একান্ত আলাপে সেসব কথা বলেছেন আকবর।
জাগো নিউজ: আপনার অধিনায়কত্বে দল বিশ্বকাপ জিতলেও আপনি সেই দলের অনেকের চেয়ে পিছিয়ে পড়েছিলেন। এবার প্রিমিয়ার লিগে এসে রান পাওয়া, জ্বলে ওঠা। এর পেছনের গল্পটা কী?
Advertisement
আকবর: আসলে কিছুই না। আমি কিছু বদলাইনি, আগের মতোই আছি। ব্যাটিং অর্ডার একটু পাল্টেছি। শেষবার সাত-আট নম্বরে ব্যাটিং করেছি। এবার মনে হয়েছে, ব্যাটিং পজিশন একটু ওপরে আনা উচিৎ। তাই আমি পাঁচ-ছয়ে নামার চেষ্টা করছি। যদি কোনো কিছু পাল্টানোর কথা বলেন, তাহলে ঐ ব্যাটিং পজিশনটাই পাল্টেছে শুধু। এবার আমি ভালো জায়গায় ব্যাটিংয়ের সুযোগ পাচ্ছি, কাজে লাগানোর চেষ্টা করছি।
জাগো নিউজ: তাহলে কি আপনি বলতে চাচ্ছেন, এবার প্রিমিয়ার লিগে একটু ওপরে ব্যাট করতে নামাটাই আপনার আগের চেয়ে ভালো খেলার অন্যতম কারণ?
আকবর: ব্যাটিং পজিশনটা গুরুত্বপূর্ণ। ওপরে খেলতে পারলে উইকেটে বেশি সময় কাটানোর সুযোগ থাকে। তখন আপনাআপনি বড় রান করারও সুযোগ বেড়ে যায়। এখনও বলবো না যে অনেক ওপরে চলে এসেছি, এখন পাঁচ-ছয়ে ব্যাট করছি। চেষ্টা থাকে টিমের অবস্থা বুঝে খেলার।
নিজের ব্যক্তিগত সাফল্য-কৃতিত্ব নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাই না। আমার কাছে শেষ কথা হলো দলের সাফল্য। ম্যাচ পরিস্থিতি ও দলের অবস্থা বুঝে খেলাই আমার প্রধান লক্ষ্য থাকে। দলের জয়ে ভূমিকা রাখতে পারাই আমার কাছে অধিক মূল্যবান। আমি বড় রান করলাম কিন্তু টিম জিতলো না, সেটার মূল্য নেই আমার কাছে।
জাগো নিউজ: সমসাময়িক কয়েকজন জাতীয় দলে ঢুকে গেছেন। কিন্তু আপনি আপনার নিজের মানের পারফরম করতে পারছিলেন না, সেটা কতটা হতাশার ছিল? আপনি কি হতোদ্যম হয়ে পড়েছিলেন?
আকবর: অবশ্যই ভাবিয়ে তুলেছিল। আপনি যখন ভালো খেলতে পারবেন না তখন একটা না পারার যন্ত্রণা তো চলে আসেই। তবে আমি হতাশায় না ডুবে বরং নিজেকে নিয়ে ভেবেছি। কোন জায়গায় সমস্যা হচ্ছে, কেন নিজেকে সেভাবে মেলে ধরতে পারছি না? সে জায়গাগুলো খোঁজার চেষ্টা করেছি। আমি এখনও শেখার চেষ্টা করছি। যে ঘাটতি ও দূর্বলতা আছে তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
জাগো নিউজ: আপনার নেতৃত্বে বিশ্বকাপ খেলা দলের পারভেজ হোসেন ইমন, শামীম পাটোয়ারী, মাহমুদুল হাসান জয় ও শরিফুল ইসলামরা অনেক বেশি পরিচিতি পেয়েছে। পরের তিনজন জাতীয় দলের নিয়মিত পারফরমারও বনে গেছে। আপনি কোথাও ছিলেন না, সেটা কতটা হতাশার ছিল?
আকবর: সত্যি কথা বলতে আমি সেভাবে চিন্তাই করিনি। আমি ভেবেছি যে, বিশ্বকাপের পর ওরা যে যে জায়গায় সুযোগ পেয়েছে, সেখানে ভালো করেছে বলেই জাতীয় দলে জায়গা পেয়েছে। আমি ভালো করতে পারিনি, সুযোগ পাইনি। আমার কাছে গোটা ব্যাপারটা ঠিক এমনই ছিল। আমি জটিল চিন্তা না করে সহজ সরলভাবে ভেবেছি। চিন্তা করেছি, আমি যদি কখনও ভালো করি আমারও সুযোগ আসবে। ওদেরটা নিয়ে আমার কোনো সমস্যাই নেই। ওদের সঙ্গে নিয়মিত কথা হয়। আগের মতোই স্বাভাবিকভাবে কথা বলি। আমার চেষ্টা একটাই, আমি নিজে কিভাবে উন্নতি করবো।
জাগো নিউজ: দেশে উইকেটরক্ষক ব্যাটারদের ছড়াছড়ি। মুশফিকুর রহিম, লিটন দাস, মোহাম্মদ মিঠুন, নুরুল হাসান সোহানদের ভিড়ে আপনি নিজের অবস্থান নিয়ে কি চিন্তিত?
আকবর: আমি যখন যে টুর্নামেন্ট খেলি তা নিয়েই ভাবি। আমি সামনে কী করবো? আগামী দিনগুলোয় কী হবে? সামনের সময়ে কী ঘটবে? তা নিয়ে না ভেবে বর্তমানটাকেই গুরুত্ব দেই বেশি। এখন যে টুর্নামেন্ট খেলি, সে চিন্তাই বেশি করি। আমার যে দুর্বলতা-ঘাটতি আছে, তা নিয়ে কাজ করি। সব জায়গায় পারফরম করার চেষ্টা করি। এর বাইরে আমার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তাই আমি ওসব নিয়ে ভাবি না। পারফরম্যান্স ভালো করার দিকেই বেশি ফোকাস থাকি।
জাগো নিউজ: বয়সভিত্তিক পর্যায় থেকে বের হওয়ার পর আপনি এ দীর্ঘসময় নিজের সমস্যা নিয়ে কার সঙ্গে কথা বলেছেন? এ সময়টায় আপনার গাইড বা মেন্টর কে ছিল?
আকবর: আমি গত দুই বছর এইচপিতে ছিলাম। সেখানে এহসান স্যার (জাফরুল এহসান) আমাকে নিয়ে কাজ করেছেন। বলতে পারেন আমি তার সান্নিধ্যেই ছিলাম। ব্যাটিং নিয়ে কাজ করেছি। টবি রেডফোর্ড খুব কম সময়ের জন্য এসেছিলেন। তার সান্নিধ্যও পেয়েছি। তবে মূলত এহসান স্যারের সঙ্গেই কাজ করেছি। ব্যাটিংয়ের ক্ষেত্রে এখন এহসান স্যারই দেখছেন আমাকে। এমনি আমার মেন্টাল গাইডের জন্য হান্নান সরকার স্যারের সঙ্গেও কথা হয়।
জাগো নিউজ: মোহামেডানের বিপক্ষে আপনার সামনে সুযোগ ছিল সেঞ্চুরি করার। তা না হওয়ায় কি খানিক হতাশ?
আকবর: সেঞ্চুরি হলে অবশ্যই খুব ভালো লাগতো। বলতে পারেন ভালো লাগাটা পরিপূর্ণ হয়ে উঠতো। তবে শতরান করতে পারিনি বলে, আমি যে হতাশ- তাও না। প্রথম কথা দল জিতেছে, আমি অবদান রাখতে পেরেছি, ইনিংসটা কাজে দিয়েছে- সেটাই অনেক বেশি ভালো লাগার।
তবে মাঝখানে আমি স্ট্রাইকও কম পেয়েছি। আর পাঁচ-সাত বল খেলতে পারলে হয়তো সেঞ্চুরি হয়ে যেতো। তবু দল জিতেছে আর সে জয়ে আমার ভালো অবদান ছিল, সেটাই অনেক ভালো লাগার।
জাগো নিউজ: এই ৪৫ বলে ৮৯ রানের ঝড়ো ইনিংসটি কি আপনার ক্যারিয়ারের সর্বসেরা ইনিংস?
আকবর: নাহ! সর্বসেরা বলবো না। তবে অন্যতম সেরা ইনিংস অবশ্যই।
জাগো নিউজ: পরবর্তী ম্যাচগুলোয় টার্গেট কী?
আকবর: পরের খেলাগুলোয় টার্গেট অবশ্যই দলের প্রয়োজন মেটানো। টিমের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলা ও জয়ে অবদান রাখা। হাফসেঞ্চুরি-সেঞ্চুরি নিয়ে ভাবি না আমি। হাফসেঞ্চুরি করতে হবে, সেঞ্চুরি করতে হবে- এসব আমার মাথায়ই নেই। দলে জয়ের জন্য যেনো অবদান রাখতে পারি সেটাই টার্গেট।
জাগো নিউজ: দল পরিচালনা কি বাড়তি চাপ?
আকবর: বাড়তি কোনো কিছু মনে হয় না। আমি চাপ হিসেবে দেখিনা। মাঠে দল পরিচালনা করা, বোলার ব্যবহার, ফিল্ডিং সাজানো ও বোলারদের সহযোগিতা করাই আমার মনে হয় অধিনায়কের মূল কাজ। আমার মনে হয় না, এর বাইরে খুব আহামরি কিছু করার আছে। সবচেয়ে বড় কথা অধিনায়কত্বটা আমি উপভোগ করি।
এআরবি/এসএএস/এএসএম