রফিকুল ইসলাম
Advertisement
'পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে প্রান্তে জ্বলন্ত / ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে / মতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক / এই বাংলায় / তোমাকেই আসতে হবে, হে স্বাধীনতা।'
কবি শামসুর রাহমানের কবিতার এই পঙক্তিমালা এ নিবন্ধের উদ্দীপক। স্বাধীনতা ছিল বঙ্গবন্ধুর সময়ের ডাক। কবির আস্থা ছিল বঙ্গবন্ধুর বিজয়ের জ্বলন্ত ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে জাতীয় পতাকা উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক এই বাংলায় স্বাধীনতা আসবেই। নবীন রক্তের প্রাণস্পন্দন আর আত্মত্যাগের মহিমায় বাঙালিরা স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে আনবেই।
এ দেশ স্বাধীনতার জন্য অনেকবার খাণ্ডবদাহন ও রক্তগঙ্গা দেখেছে। বারবার দানবেরা আমাদের স্বাধীনতাকে হরণ করতে চেয়েছে। এ দেশ বারবার রক্তস্রোতে ভেসেছে, এবার স্বাধীনতা অর্জন করে তবেই ক্ষান্ত হবে এ দেশের মানুষ। তারা অপরিমিত ত্যাগ-তিতিক্ষার পথ বেছে নিয়েছে স্বাধীনতা লাভ করতে। তাই এক অনন্য অনুভবে ঋদ্ধ অধিকারের নাম স্বাধীনতা।
Advertisement
২৬ মার্চ, সেই মহান স্বাধীনতা দিবস। বঙ্গবন্ধুর ২৪ বছরের সংগ্রামের ফসল স্বাধীন বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে একটি নামের অন্তর্ভুক্তি ঘটে। এ দিনের নবীন সূর্যোদয়ের মধ্য দিয়ে আমাদের জাতীয় জীবনে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। এ স্বাধীনতা দিবসের আনন্দোজ্জ্বল মুহূর্তের মধ্যে প্রথমেই স্মরণ করতে হয় অসংখ্য দেশপ্রেমিক শহিদের আত্মদানের কথা। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলার মানুষ পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক স্বৈরশাসনের ২৪ বছরের গ্লানি থেকে খুঁজে পেয়েছিল মুক্তির পথ।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের নামে কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে সময়ক্ষেপণ শুরু করে। নেপথ্যের ষড়যন্ত্র টের পেয়ে অভূতপূর্ব এক বিচক্ষণতায় ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে জাতিকে মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান - ''এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।" এতে মুক্তি পাগল জনতা জ্বলে ওঠে আপন শক্তিতে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ছিল আমাদের জাতীয় জীবনে এক বিভীষিকা ও সংকটময় দিন। ইয়াহিয়া খানের সামরিক জান্তা নিরস্ত্র বাঙালির ওপর রাতের আঁধারে গণহত্যা মেতে ওঠে। অন্যদিকে গ্রেফতার করা হয় বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। কিন্তু গ্রেফতার হওয়ার আগে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়ে দেন স্বীয় দূরদর্শিতায়। এ দিনে আমরা প্রথমবারের মতো নিজেদের শক্তি সম্বন্ধে সচেতন হই। বঙ্গবন্ধুর এই নির্দেশে বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধের জন্য উম্মুখ জনতা সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। এভাবেই শুরু হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ। যদিও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ ও দলীয় এদেশীয় দোসররা স্বাধীনতার বিরোধীতায় পাকিস্তানি সৈন্যদের নানাভাবে সহযোগিতা করে।
'শুধু ভিক্ষা করে কখনো স্বাধীনতা লাভ করা যায় না। স্বাধীনতা অর্জন করতে হয় রক্ত দিয়ে, সংগ্রাম করে। স্বাধীনতার মূল্য দিতে হয় শক্তি দিয়ে' - নেতাজী সুভাসচন্দ্র বসুর এ কথা মনের জানালায় উঁকি দেয় এজন্য যে, লাখো শহিদের রক্তে রাঙানো আমাদের স্বাধীনতার সূর্য। তাই এ দেশের জাতীয় জীবনে স্বাধীনতা দিবস সবচাইতে গৌরবময় ও পবিত্রতম দিন; অনন্য ঘটনা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশের জনগণ শ্রেণি ও গোষ্ঠী নির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের মাধ্যমে পাকিস্তান দখলদার বাহিনীকে পরাস্ত করে। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যেরও তাই গর্বভরা তেজোদ্দীপ্ত কণ্ঠ - 'সাবাস বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়; / জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার, তবুও মাথা নোয়াবার নয়।'
Advertisement
আজ সেই স্বাধীনতা দিবসের ৫১তম বর্ষপূর্তি। স্বাধীনতার আদর্শ ও লক্ষ্য থেকে জাতিকে বিচ্যুত করার লক্ষ্যে ভেতরের ছদ্মবেশী শত্রু ও বাইরের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্টে হত্যা ও ক্যুর মাধ্যমে জাতির ওপর চরম আঘাত হানে। বহু মীমাংসিত বিষয়কে পুনরায় অমীমাংসিত করে তুলে। বিতর্কিত করে তুলে জাতীয় পরিচয়কে। আমাদের স্বাধীনতার ঘোষক কে- এ নিয়েও বিতর্কের সূচনা করে তারা। পাল্টে দেয় বাংলাদেশের রাজনৈতিক দিগন্ত। তারপর সেই লক্ষ্যে আমাদের মহান স্বাধীনতা দিবসটিকে শুধু জাতীয় দিবস হিসেবে আখ্যায়িত করে পালনের প্রচেষ্টা চালায়। তাতে ক্ষুব্ধ দেশবাসীর চাপা বিক্ষোভ ও স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির বিরূপ প্রতিক্রিয়ার মুখে পিছু হটে এর উদ্যোক্তারা। তখন থেকে দিনটি পালিত হয়ে আসছে স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস হিসেবে।
পৃথিবীর বহু দেশে স্বাধীনতা দিবসটি জাতীয় দিবস হিসেবে পালিত হয়। আর কিছু কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা ও কারণে কোনো কোনো দেশের স্বাধীনতা দিবস ও জাতীয় দিবস পালিত হয় পৃথক আঙ্গিকে। যেমন: ফ্রান্সে জাতীয় দিবস হিসেবে পালিত হয় বাস্তিল দুর্গ পতনের দিনটি। সেখানে উক্ত দিনে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক বিপ্লবী অভ্যুত্থানে জনসাধারণ অত্যাচারের প্রতীক বাস্তিল দুর্গ গুঁড়িয়ে দেয়।
এছাড়া ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময় এক পর্যায়ে ভারতীয় কংগ্রেস রিপাবলিক ডে বা প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে পালত করতে শুরু করে ২৬ জানুয়ারি। পাকিস্তানি শাসকরা পাকিস্তান দিবস হিসেবে পালন করে ২৩ মার্চ। কারণ ১৯৪০ সালের এই দিনে মুসলিম লীগ লাহোর প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল। অথচ পাকিস্তান ও ভারতের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে ১৯৪৭ সাল থেকে যথাক্রমে ১৪ ও ১৫ আগস্ট।
বস্তুত স্বাধীনতা দিবস ও জাতীয় দিবসের মর্মবাণীর মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। কিন্তু আমাদের মহান স্বাধীনতা দিবসটিকে শুধু জাতীয় দিবস হিসেবে উল্লেখ করার প্রয়োজনের পিছনে সেদিন স্বাধীনতার পরাজিত শক্তির উদ্দেশ্য ছিল ভিন্নতর। একই কারণে তারা 'বাংলাদেশের বেতার'কে 'রেডিও বাংলাদেশ' নামে অভিহিত করতে থাকে।
আজ স্বাধীনতার ৫১তম বর্ষপূর্তি পালন করতে গিয়ে এ কথাটা ভুলে গেলে চলবে না যে, দীর্ঘ ২১ বছর সামরিক শাসনামলে ও বেসামরিক পোশাকে স্বৈরাচারের শাসন ক্ষমতা পরিচালনা দেশবাসীকে স্বাধীনতার আদর্শ ও লক্ষ্য থেকে ক্রমাগত দূরে ঠেলে দিয়েছে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে এবং প্রতিরোধ গড়ে তুলতে গিয়ে অগণিত তরুণ, রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী নিহত হয়েছেন; শিকার হয়েছেন কারাভোগ ও নির্যাতনের।
তারপর ক্ষণিক সাফল্য এসেছে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে। কিন্তু অশুভ শক্তি ও তার সহযোগীদের চক্রান্ত গণতন্ত্রের এই অভিযাত্রাকে মন্থর করে দেয়। পদে পদে ব্যাহত করে তার বিকাশ। স্বাধীনতার শত্রুরা প্রশাসন ও সরকারে তাদের আধিপত্য বিস্তার রাখে। গণতন্ত্র এক মেঘাচ্ছন্ন প্রভাতের মতো আমাদের মনে সেভাবে প্রাণের উত্তাপ ছড়াতে পারেনি।
বরং ১৯৯৬ সালে সাধারণ নির্বাচনের পর স্বাধীনতা পক্ষের শক্তি চতুর্থবার জাতির আদর্শ ও লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ পেলেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই শক্তিগুলোর মধ্যে অনৈক্য-বাধাগ্রস্ত করছে সামনে চলার পথ। উপরন্তু ক্ষমতাসীন দলের নিজেদের মধ্যেও ক্ষমতা, অর্থ ও যশের ভাগাভাগি নিয়ে আত্মঘাতী দ্বন্দ্ব ক্ষয়রোগগ্রস্ত রোগীর মতো নির্জীব করছে জাতির প্রাণশক্তি।
স্বাধীনতার পর দীর্ঘদিন অতিবাহিত হয়েছে। একটি প্রজন্ম অতিক্রান্ত হয়ে সূচনা ঘটেছে আরেকটি প্রজন্মের। কিন্তু স্বাধীনতা শব্দটির সঙ্গে যে স্বপ্ন একদা দেশবাসী দেখেছিল আজও তা বাস্তবে রূপান্তরিত করা সম্ভব হয়নি। স্বাধীনতার পর থেকে সরকার পরিবর্তনের একটি ক্রমধারা আমরা লক্ষ করতে পারি। প্রতিটি সরকার ক্ষমতায় এসেই ঘোষণা করেন যে, 'আমদের সরকার উন্নয়নের রাজনীতিতে বিশ্বাসী, আমরা উন্নয়নের রাজনীতি করি, দেশকে উন্নয়ন করাই আমাদের লক্ষ্য।'
সর্বোপরি উন্নয়নমূলক প্রকাশের যত বিশেষণ রয়েছে তার সবকটিই তাঁরা ব্যবহার করেছেন, দেশের উন্নয়ন করেছেন, দেশকে উন্নতির দিকে নিয়ে গেছেন ... ইত্যাদি। কিন্তু বাস্তবতা হলো - বাংলার দুখী মানুষের ভাগ্য রয়েছে অপরিবর্তনীয়। সমাজব্যবস্থাও আজ মুখ থুবড়ে পড়েছে। অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে এক শ্রেণির স্বার্থান্বেষী মানুষ মাত্রই মেতে উঠেছে ক্ষমতাধর হওয়ার প্রতিযোগিতায়। কল্যাণমুখী রাজনীতি হয়ে পড়েছে কলুষিত। সমাজজীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনিয়ম ও দুর্নীতির থাবা বিস্তৃত হচ্ছে। সামাজিক স্বার্থ ভুলে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের জঘন্য প্রবণতার ফলে সমাজকে আজ গ্রাস করেছে চরম বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য। মূল্যবোধের অবক্ষয়, কুনীতি-দুর্নীতিভরা রাজনীতি ইত্যাদি বহু কারণে এখনো আমরা আমাদের স্বাধীনতাকে সঠিকভাবে অর্থবহ করে তুলতে পারিনি।
মহান স্বাধীনতা দিবসটি শুধু উৎসব-আনন্দে অতিবাহিত করবে দেশবাসী অন্যান্য স্বাধীন জাতির মতো এটা ছিল স্বাভাবিক প্রত্যাশা। জাতীয় অগ্রগতি ও সামাজিক শান্তির প্রসন্নতা আমাদের এই গৌরবের দিনটিকে আরও উজ্জ্বলতা দিবে, নির্ভাবনায় দিন যাপনের কলরবে মুখরিত হবে সকলের জীবন। এটাই ছিল স্বাভাবিক; কিন্তু তার পরিবর্তে অশুভ শক্তি শুধু নয়, ঘরের শত্রু বিভীষণে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘৃণ্য-উল্লাস ও দম্ভ বেড়েছে আকাশচুম্বী।
অবশ্যই আওয়ামী লীগের টানা তিনবারের শাসনামলে প্রভূত অগ্রগতি হয়েছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সেই সুফলগুলো অভিনন্দিতও হয়েছে। এই সাফল্যগুলোকে যদি তুলনা করা যায় হাইরাইজ ভবনের সঙ্গে; তবুও বাস্তব পরিস্থিতিটা দাঁড়িয়েছে দুর্বল ভিত্তির ওপর গড়ে ওঠা বহুতল সুরম্য ভবনের মতো।
ত্রিশ লাখ প্রাণের বিনিময়ে আর দু'লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির মূল্যে ছিনিয়ে আনা স্বাধীনতা গর্বকে শুধু মূলধন করে এগোনোই কেবল নয়, দরকার নৈতিক ভিত্তি।জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের স্বীকৃতির পুনরুদ্ধার একমাত্র জাতির ও দেশবাসীর নিরাপত্তার রক্ষাকবচ নয়; যে অসম্প্রদায়িক ভাবাদর্শ আমাদের রাষ্ট্রীয় আদর্শের অন্যতম মূল স্তম্ভ তার ওপর যদি ভেতর থেকে আঘাত আস, এক কথায় বঙ্গবন্ধুর লালিত স্বপ্নের আদর্শ যদি অন্তর্গত লোভ ও স্বার্থের দ্বন্দ্বে জর্জরিত হয়; তবে উচ্চ আদর্শের মহৎ বুলি নিরাশ্রয় শব্দের কঙ্কালে পরিণত হবে।
স্বাধীনতার উৎসব আনন্দের ওপর অশুভ শক্তির ছায়া দীর্ঘতর হবে। তারা তাদের তীক্ষ্ণ নখর বের করছে আর হিংস্র গর্জনে দিগ্বিদিক কাঁপিয়ে তুলছে। সেখানে আজকের মহান স্বাধীনতা দিবসে শুধু শত্রুদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার যথেষ্ট নয়। আপন ঘরের মধ্যে অধিষ্ঠিত তাদের ছায়ামূর্তি অনুচরদেরও চিনে নিতে হবে এবং তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথাটাও ভাবা প্রয়োজন। কেননা, সৎ ও দেশপ্রেমিকের শত্রু ঘরে-বাইরে। তাঁদের পাশে দাঁড়ানো রাষ্ট্ররেই দায়িত্ব। তা না হলে, 'সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতিতে জিরো টলারেন্স নীতি' মুখ থুবড়ে পড়বে।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম দীর্ঘ প্রস্তুতির ফসল। অতুলনীয় ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে আমাদের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। আর এখন সভা সভাবেশে ও বিবৃতিতে খুব উচ্চ আদর্শের কথা বলা হচ্ছে ঠিকই; কিন্তু বিরুদ্ধপক্ষের ষড়যন্ত্র কেবল অভিযোগ করেই নিজেদের ব্যর্থতা এবং দুর্বলতা এড়িয়ে যাবার নয়। কিভাবে কাজ করতে হয় সাহসের সাথে, সংকল্পে দৃঢ় থেকে তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ভূমিকা ১৯৬৪ সালে আওয়ামী পুনরুজ্জীবনের সময় তাঁর সাহস, সংকল্প এবং দলীয় নেতা ও কর্মীদের সংগঠিত করার জন্য প্রাণপাত পরিশ্রম এবং ৬-দফা কর্মসূচি দেশবাসীর মধ্যে জনপ্রিয় করার জন্য ভয়ের ভ্রুকুটি তিনি কতবার উপেক্ষা করেছেন, সহ্য করেছেন জেল ও জুলুম।
বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে জাগ্রত করার জন্য কী অসম সাহসে তিনি লড়াই করেছেন, সেই দৃষ্টান্ত অনুসরণ না করে তোতাপাখির মতো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা বলা হলেও চলছে নিজেদের মধ্যে অন্তঃকলহ ও অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা। এভাবে কার্যক্ষেত্রে কথিত শত্রুপক্ষের পদাঙ্ক অনুসরণ করার ঘটনাবলি চোখে পড়ে। এসব দেখেশুনে সেই গানের কলিটি মনে পড়ে: 'আর যদি কিছু থাকে বাকি শ্রবণ বধির কর।'
মহান স্বাধীনতা দিবস পালন আজকের পরিস্থিতিতে শুধু আনুষ্ঠানিকতার পুনরাবৃত্তি নয়, বরং অশুভ শক্তির আস্ফালনের মুখে সংকল্পবাণী ওঠে আসুক ছদ্মবেশী দ্বিতীয় মৃত্যুর বিরুদ্ধে জীবনের যুদ্ধযাত্রার প্রস্তুতির নির্দেশ নিয়ে; ঘোষণা করুক স্বাধীনতার আদর্শ ও লক্ষ্য পূরণ আমাদের প্রতিজ্ঞা।
স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তুলতে হলে সমাজে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে প্রতিষ্ঠিত করার বিকল্প নেই। গণতন্ত্রের বিকাশ সাধন, স্বাজাত্যবোধকে প্রতিটি বাঙালির মনে সুদৃঢ়ভাবে সঞ্চারিত করা, সব ধরনের কলুষতা থেকে মুক্ত হতে প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করা এবং সর্বোপরি সমাজের বৈষম্যের যে ধারা ক্রমশ স্ফীত হচ্ছে তার লাগাম টেনে ধরে কল্যাণকর একটি সমাজ গঠনের লক্ষ্যে অগ্রসর হওয়ায় হোক এবারের স্বাধীনতা দিবসের অঙ্গীকার।
আমরা যদি সমাজের কলুষতাকে দূর করার ব্যাপারে দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে ওঠে ঐক্যবদ্ধ হতে না পারি তাহলে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হতেই থাকবে। একথা তো ঠিক, জাতিগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে সেদিন আমরা সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কারণেই সাফল্য লাভ করেছিলাম। জাতীয় উন্নয়নকে সুনিশ্চিত করতে হলেও আজও একইভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে মশাল হিসেবে নিয়ে সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এর বিকল্প নেই।
অর্ধশতকেরও অধিক বছর আগে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ পথচলা শুরু করেছিল নড়বড়ে পায়ে। সে পা এখন একটি শক্ত ভিত্তি পেয়েছে। আমাদের তরুণ প্রজন্ম, যারা আজ বিভেদের রাজনীতির শিকার, তারা স্বাধীনতার অবিনাশী চেতনায় দেশপ্রেমের অগ্নিমন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে আসবেই আলোর পথে।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলামিস্ট। সহযোগী সম্পাদক, আজকের সূর্যোদয়, ঢাকা।
এইচআর/এএসএম