দেশজুড়ে

বন্ধের খবরে কমেছে চাষ, আখ সংকটে রাজশাহী চিনিকল

ক্রমাগত লোকসানের কারণে গত বছর রাজশাহী চিনিকল সাময়িক বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এতে মিলে চাষিদের সরবরাহের জন্য মজুত করা সার, বীজ, কীটনাশকসহ অন্যান্য কৃষিজাত উপকরণ অন্য চিনিকলে স্থানান্তরিত হয়।

Advertisement

ফলে স্থানীয় আখচাষিরা হতাশ হয়ে তাদের আখ চাষের জমি থেকে মুড়ি আখ (গোড়ার আখ গাছ) তুলে ফেলেন। অধিকাংশ কৃষকই জমিতে আখের বদলে অন্য ফসল চাষে মনোযোগী হন। এদের মধ্যে অনেকেই চাষযোগ্য জমিতে পুকুর খনন করেন। এতেই রাজশাহী চিনিকলে আখ সংকটের কারণে গত দুই বছরে চিনির উৎপাদন কমে আসে তিন-চতুর্থাংশ।

রাজশাহী চিনিকল সূত্র জানায়, সারাদেশের ১৫টি চিনিকলের মধ্যে গত বছর সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী রাজশাহীসহ ছয়টি চিনিকল সাময়িক বন্ধের নির্দেশ দেয় সরকার। জনস্বার্থে পরে এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে সরকার। কিন্তু ততক্ষণে চাষিরা মুখ ফিরিয়ে নেন আখচাষ থেকে। এতে রাজশাহী অঞ্চলে আখের উৎপাদন আগের তুলনায় তিন-চতুর্থাংশ কমে যায়।

গত পাঁচ বছরের উৎপাদন সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭-১৮ আখ মাড়াই মৌসুমে মাড়াই হয় ৯৩ হাজার ৯৪ মেট্রিক টন আখ। এতে চিনি উৎপাদন হয় ৫ হাজার ৪৪৮ মেট্রিক টন। ২০১৮-১৯ আখ মাড়াই মৌসুমে আখের উৎপাদন বাড়ে। এ সময় আখ মাড়াই হয় ১ লাখ ২ হাজার ৫২৫ মেট্রিক টন এবং তা থেকে উৎপাদন হয় ৬ হাজার ২১২ মেট্রিক টন চিনি। ২০১৯-২০ মৌসুমে আখ মাড়াই হয় ১ লাখ ২৯ হাজার ২৫২ মেট্রিক টন, যা আগের তুলনায় ২৬ হাজার ৭২৬ মেট্রিক টন বেশি। এ মৌসুমে চিনি উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় ৮ হাজার ১৯ মেট্রিক টন।

Advertisement

২০২০-২১ আখ মাড়াই মৌসুমে আখ মাড়াই হয় ৬৩ হাজার ৯৬৪ মেট্রিক টন এবং চিনি উৎপাদন হয় ৩ হাজার ৬৬৪ দশমিক ৬০ মেট্রিক টন। পরের মৌসুমে অর্থাৎ ২০২১-২২ মাড়াই মৌসুমে ২৪ হাজার ৩ মেট্রিক টন আখ মাড়াই হয় এবং তা থেকে চিনি উৎপাদন হয় মাত্র ১ হাজার ৩০৮ মেট্রিক টন। বর্তমানে চিনির মজুত রয়েছে ১ হাজার ১৯ মেট্রিক টন।

কারণ হিসেবে মিল কর্তৃপক্ষ জানায়, ২০২০ সালের প্রথমদিকে চাষিরা জানতে পারেন রাজশাহী চিনিকল বন্ধ হয়ে যাবে। এজন্য তারা তাদের জমিতে উৎপাদিত আখের প্রায় অর্ধেকেরও বেশি গুড় তৈরির জন্য দেন। এতে আখ সংকটে পড়তে হয় রাজশাহী চিনিকলকে

গত বছর চিনির মূল্য ছিল ৬৩ টাকা কেজি। তবে বর্তমানে খোলা চিনি ৭৪ টাকা ও প্যাকেট চিনি ৭৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। সুগার মিলসের চিনির চাহিদা প্রচুর। কিন্তু স্বল্পতার কারণে আপাতত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বিজিবি, র‌্যাব ও পুলিশ বাহিনীকে সরবরাহ করা হচ্ছে। তবে এসব বরাদ্দ করে শিল্প মন্ত্রণালয়। যার যার বরাদ্দ দেখে তাদের বরাদ্দকৃত চিনি দেওয়া হয়। তবে সবচেয়ে বেশি চিনি পায় সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনী।

মিলস সূত্রে আরও জানা গেছে, রাজশাহী সুগার মিলসে বর্তমানে ৮০৩ জন জনবল রয়েছে। এর মধ্যে ৩৮ জন কর্মকর্তা পর্যায়ের ও বাকি ৭৬৫ জন কর্মচারী ও লেবার (স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলে)। চিনিকলটি ২২৯ দশমিক ৫৭৫ একর জায়গাজুড়ে অবস্থিত। এর মধ্যে ১০০ একরের মধ্যে রয়েছে মিল ক্যাম্পাস অর্থাৎ আবাসিক কলোনি, স্কুল, স্কুল মাঠ, মসজিদ, মেডিকেল, কারখানা, গেস্ট হাউজ, গাড়ি পার্কিংয়ের গ্যারেজ, প্রশাসনিক ভবন, জৈব সার কারখানা, রাস্তাঘাট ও সাব জোন। ১১০ একরে রয়েছে পরীক্ষামূলক খামার এবং বাকি প্রায় ২০ একর জায়গাজুড়ে রয়েছে সাবজোন অফিস ও আখ ক্রয়কেন্দ্র।

Advertisement

রাজশাহী চিনিকলে চিনি উৎপাদনের প্রতিবন্ধকতা বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শাহজাহান কবির বলেন, আখের উৎপাদন বেশি হলে চিনির উৎপাদন অটোমেটিকভাবে বেড়ে যায়। যেমন- রাজশাহী চিনিকলে রয়েছে মোট ৯টি সাবজোন। এর মধ্যে পশ্চিমে কাশিয়াডাঙ্গা, নওদাপাড়া, মিলস গেট ‘ক’ ও মিলস গেট ‘খ’ জোনে উৎপাদন একেবারেই স্বল্প। এসব অঞ্চলে অতিরিক্ত নগরায়ন হওয়ায় আখের চাষযোগ্য জমি কমেছে। ফলে উৎপাদনও কম।

অন্যদিকে পুঠিয়া, নন্দনগাছী, সরদহ, চারঘাট ও আড়ানীতে উৎপাদন ভালো। সেক্ষেত্রে মিলের মোট চাহিদা এই ৫টি সাবজোন থেকেই পূরণ করা হয়।

তিনি বলেন, কৃষিজাত জমির পরিমাণ কমে আশপাশে ইটভাটা ও প্রচুর পরিমাণ পুকুর খনন, আখচাষের পরিবর্তে অন্যান্য ফসল চাষ, আখের মূল্যবৃদ্ধি, শহর বা নগরায়ন এবং সার ও কীটনাশকসহ অন্যান্য পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি হওয়ায় আখচাষ বহুলাংশে কমেছে। এ কারণে কমছে উৎপাদন।

তবে মিল বন্ধের ঘোষণার কারণে অনেকেই আখচাষ ছেড়ে জমি লিজ দেওয়া, পুকুর খনন কিংবা আম বাগান করায় বিপদ সবচেয়ে বেড়েছে বলেও মন্তব্য করেন এ কর্মকর্তা।

জানতে চাইলে কাটাখালী হাজরা পুকুর এলাকার আখচাষি মাসুদ রানা জাগো নিউজকে বলেন, আমার দুই বিঘা জমি আছে। সেখানে প্রতি বছরই আখ চাষ করি এবং সেই আখ রাজশাহী চিনিকলে বিক্রি করি। কিন্তু ইদানীং আখচাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি।

কারণ হিসেবে তিনি বলেন, দিন দিন সার, বীজ, কীটনাশকসহ লেবার খরচ বাড়ছে। আবার আখ জমি থেকে কেটে সুগার মিল পর্যন্ত পৌঁছে দিতেও গাড়িভাড়া লাগে, সেটিও বেড়েছে। খরচ বাড়লেও বাড়েনি আখের দাম। আমরা (চাষিরা) সুগারমিল কর্তৃপক্ষকে দীর্ঘদিন ধরে আখের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে বলছি, তবুও তারা এ বিষয়ে কর্ণপাত করছে না। আবার আখ তুলে মিলে দেওয়ার পর পাওনা পেতেও বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়।

মাসুদ বলেন, এ অবস্থায় আমাদের লাভ থাকে একেবারেই নগণ্য। এভাবে চললে আমরা আখ চাষ করতে পারবো না। আখ চাষ না করলে মিলও অচল হয়ে যাবে। তাই সরকারের উচিত আখের মূল্যবৃদ্ধি করা এবং আমাদের প্রয়োজনীয় কৃষি সহায়তা দেওয়া।

আখ সংকট নিরসনের ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, সরকার ইতোমধ্যে আখের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যা কৃষক ও সুগারমিল উভয়ের জন্যই শুভবার্তা।

এছাড়া আখ সংকট কাটিয়ে উঠতে কৃষকদের উন্নত প্রশিক্ষণ, আখের বীজ প্রদান করতে হবে। স্থানীয় সরকার ও জনপ্রশাসনকে চাষযোগ্য জমি রক্ষার ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। তাহলেই রাজশাহীর এ ঐতিহ্যবাহী শিল্প-কারখানাটি বন্ধের হাত থেকে বাঁচাতে সম্ভব বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এফএ/এএসএম