দেশজুড়ে

লোকসানে ডুবতে বসেছে ফরিদপুর চিনিকল

বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া একটি প্রতিষ্ঠান ফরিদপুর সুগার মিলস লিমিটেড। ১৯৭৪ সালে মিলটি প্রতিষ্ঠিত। মিলটির বয়স ৪৬ বছর। এটি ফরিদপুর জেলার একমাত্র ভারী কৃষিভিত্তিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান।

Advertisement

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মোট ৪৬টি মাড়াই মৌসুমের মধ্যে মাত্র ১৩টি মৌসুম লাভের মুখ দেখে চিনিকলটি। বাকি ৩৩টি মাড়াই মৌসুমে লোকসানে পড়তে হয়। জরাজীর্ণ মেশিন, আখের ভালো জাতের অভাব, শুধু চিনি উৎপাদনে নির্ভরশীলতা ও শ্রমিক-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় ডুবতে বসেছে মিলটি।

ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার গাজনা ইউনিয়নে ১২৯ দশমিক ৯৭ একর জমির ওপর কারখানাটি নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের আওতাধীন কারখানাটি ৩৫০ কোটি টাকার অধিক লোকসানে রয়েছে। মিলের অধিকাংশ মেশিনারিজের কার্যক্ষমতা কমেছে। ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে মিলের সব ধরনের মেশিন ও যন্ত্রপাতি। পুরোনো মেশিন ও যন্ত্রাংশ পরিবর্তন এবং প্রতিস্থাপন করে আধুনিকায়নের মাধ্যমে মিলের কার্যক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করে মিল কর্তৃপক্ষ।

জানা গেছে, নেদারল্যান্ডস থেকে আমদানি করা হয় চিনি উৎপাদনের যন্ত্রপাতি। এ কারখানাটি নির্মাণে ব্যয় হয় আট কোটি ২৮ লাখ টাকা। ১৯৭৪ সালে মিলটি প্রতিষ্ঠিত হলেও ১৯৭৬ সালে পরীক্ষামূলকভাবে চিনি উৎপাদন শুরু হয়। ১৯৭৭ সালে বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয় চিনি উৎপাদন। ১৯৭৭ সালের ২ মার্চ তৎকালীন প্রেসিডেন্টের শিল্পবিষয়ক উপদেষ্টা হাফিজউদ্দিন মিলটির উদ্বোধন করেন।

Advertisement

ফরিদপুর চিনি কল লিমিটেড বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায় অবস্থিত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একমাত্র ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান। এটি দেশের অন্যতম প্রধান চিনি কল। এখানে চিনি, জৈব সার, চিটাগুড়, মণ্ড উৎপাদন করা হয়। সুগার মিলটির মাড়াই ক্ষমতা প্রতিদিন এক হাজার ১৬ মেট্রিক টন। তবে আখের অভাবে মিলটি বছরের ১২ মাসের মধ্যে এক মাস ১০ দিন চালু থাকলেও বাকি সময় থাকে বন্ধ। এ পর্যন্ত ৪৫ মাড়াই মৌসুমের মধ্যে লাভের মুখ দেখে ১৩ মৌসুম। লোকসান হয় ৩৩ মৌসুমে।

সর্বশেষ ২০২১-২২ মৌসুমে আখ মাড়াই শুরু হয় ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর। এটি ৪৬তম মৌসুমের আখ মাড়াই। ৪০ কার্যদিবসে ৪১ হাজার মেট্রিক টন আখ মাড়াই লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে দুই হাজার ৯০০ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। চিনি আহরণের হার ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ।

চিনিকল সূত্রে জানা যায়, ২০১৮-১৯ আখমাড়াই মৌসুমে মিলটি ১০৩ কার্যদিবসে এক লাখ আট হাজার ৪২৩ টন আখ মাড়াই করে আট হাজার ১৩১ টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। চিনি আহরণের হার ধরা হয়েছিল শতকরা ৭ দশমিক ৫ ভাগ। সেই মৌসুমে মিলটি ৭০ কোটি ৩৯ লাখ ২৪ হাজার টাকা লোকসান গুনতে হয়।

২০১৯-২০ অর্থবছর ৪২৮ কোটি ৫৫ লাখ ৬০ হাজার টাকা লোকসানের বোঝা মাথায় ছিল মিলটির। ওই মৌসুমে ১০ হাজার একর জমিতে আখ রোপণ করা হয়। ৭৭ কার্যদিবসে মোট ৭৮ হাজার টন আখ মাড়াইয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। চিনি আহরণের হার ধরা হয় শতকরা ৭ দশমিক ৫ ভাগ।

Advertisement

২০২১-২২ অর্থবছরে সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত চিনিকলের প্রায় ৩৪৬ দশমিক ৬০ মেট্রিক টন চিনি অবিক্রীত অবস্থায় গুদামে পড়ে রয়েছে। চিনিকলটির নিজস্ব উৎপাদিত চিনির পাইকারি বিক্রয় মূল্য সর্বশেষ কেজিপ্রতি ৭৪ টাকা পুনর্নির্ধারণ করা হয়। চলতি বছর চার হাজার ৪৩৩ চাষির মাঝে তিন কোটি ৬৯ লাখ টাকা ঋণ বিতরণ করেছে মিল কর্তৃপক্ষ।

আখের অপর্যাপ্ত সরবরাহচিনিকলটি মাড়াই মৌসুমজুড়ে আখ থেকে চিনি উৎপাদনের পর্যাপ্ত আখ পায় না। তাই বছরের একটা বড় সময়জুড়ে উৎপাদন বন্ধ থাকে। যদিও বাজারজাতকরণ, বিতরণ, যন্ত্রাংশ মেরামত, লেনদেন ও ব্যবস্থাপনার কাজ পুরো বছরই চলে কিন্তু পণ্য বহুমুখীকরণ (অ্যালকোহল, স্যানিটাইজার, জীবাণুনাশক, বায়োগ্যাস, জৈবসার, বর্জ্য ছোবড়া থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন) না করায় সরাসরি উৎপাদনে জড়িত শ্রমিক, কর্মচারীরা পুরো বছর কাজের সুযোগ পান না। কিন্তু বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন খরচ বহন করতে হয় কর্তৃপক্ষকে।

মাড়াইয়ের জন্য পর্যাপ্ত আখ না পাওয়ার কারণখরচের তুলনায় আখের দাম পাওয়া যায় না, চিনিকলে সময়মতো আখ বিক্রি করা যায় না, বিক্রি করলেও সময়মতো অর্থ পাওয়া যায় না। ফলে কৃষকরা আখের বদলে ধান বা সবজি চাষ করছেন। যারা আখ চাষ করছেন তারা চিনিকলের বদলে গুড় উৎপাদকের কাছে বিক্রি করছেন। ভালো মানের আখ উৎপাদনের জন্য যথেষ্ট প্রণোদনা নেই। অর্থাৎ সব গ্রেডের আখের দাম একই। এতে মান বাড়ানো নিয়ে কৃষকদের মধ্যে যথেষ্ট উৎসাহ দেখা যায় না।

উপজেলার মেকচামী এলাকার কৃষক মো. নাজমুল ইসলাম মৃধা, নিখিল সরদার ও নিলু সরদার জাগো নিউজকে বলেন, আমরা আগে আখ চাষ করতাম। আখ চাষ করে লাভ হয় না। আখের জাত ভালো নয়। মানুষের অত্যাচার বেশি, তাই আখ চাষ বাদ দিয়েছি। এখন অন্য ফসল চাষ করি। তবে আখ চাষে লাভ হলে, সুযোগ সুবিধা পেলে আবার আখ চাষ করবো বলে জানান তিনি।

চিনিকলের সিনিয়র স্টাফ মো. মজিবুর রহমান বলেন, মেশিন খারাপ, আখের বীজ খারাপ। আখ চাষির সংখ্যা কমছে। আখের ভালো বীজ, চাষিদের সার ও ওষুধ সময়মতো দেওয়ার পাশাপাশি তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করলে অবশ্যই ফের আগ্রহী হবেন।

সুগার মিলের শ্রমজীবী ইউনিয়নের সাবেক সহ-সভাপতি ও জুনিয়র কার্বাইন অপারেটর (যান্ত্রিক বিভাগ) মেহেরাব হোসেন উজ্জ্বল জাগো নিউজকে বলেন, সুগার মিলটি বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান। এ এলাকার একটি ঐতিহ্য। এর সঙ্গে লাখ লাখ মানুষের জীবনমান, জীবিকা ও ভাগ্য জড়িয়ে আছে। মিলটি লোকসানের হাত থেকে রক্ষা করে বাঁচিয়ে রাখতে চিনি উৎপাদনের পাশাপাশি বায়োপ্রডাক্ট বাড়াতে হবে। সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ, কর্মসূচি ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার দাবি জানান তিনি।

মিলটি লাভজনক পর্যায়ে নিয়ে যেতে তাদের পক্ষ থেকে আন্তরিকতার ঘাটতি নেই বলে দাবি করেন শ্রমজীবী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক কাজল বসু। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ফরিদপুর সুগার মিলটি বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া একটি প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে মিলটিতে কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ৯০০ জন। মোট ৪ হাজার ৮৯২ জন আখচাষি রয়েছেন চিনিকলে। কারখানাটি পুনরায় লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার পাশাপাশি টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

তিনি আরও বলেন, মিলটি বাঁচিয়ে রাখতে হলে মেশিনপত্রের আধুনিকায়ন, বিকল্প উৎপাদন ব্যবস্থা, র-সুগার প্ল্যান, মিনারেল ওয়াটার উৎপাদনের ব্যবস্থা করা জরুরি।

ফরিদপুর সুগার মিলের (যান্ত্রিক বিভাগের দায়িত্বে) উপ-ব্যবস্থাপক (যন্ত্র কৌশল) মো. রাজু আহম্মেদ জাগো নিউজকে বলেন, ১৯৭৬ সালে মিলটিতে মাড়াই কার্যক্রম শুরু হয়। সে হিসেবে এর বয়স ৪৬ বছর। মেশিনপত্র পুরোনো। মেশিনের আধুনিকায়ন করে কারখানা নতুনভাবে সাজালে লোকসান পোষানো সম্ভব। মিলটি বর্তমানে লোকসানে।

লোকসানের তিনটি কারণ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, মেশিন, যন্ত্রপাতি ও কারখানা জরাজীর্ণ। ভালো জাতের আখের অভাব। এখানকার শ্রমিক-কর্মচারীদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা দরকার।

মিলের মহাব্যবস্থাপক (কৃষি) মোহাম্মদ আনিস উজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ফরিদপুর সুগার মিল একটি সম্ভাবনাময় মিল। এই মিল জোন এলাকায় ৩৬ হাজার ৫০০ একর জমি আছে। যেখানে আখ আবাদ করা যায়। বিগত বছরগুলোতে এখান থেকে ১৩ হাজার একর জমিতে আখ চাষ হতো। কিন্তু চাষিদের লোকসানের কারণে আখের আবাদ কমেছে। সবশেষ মৌসুমে মাত্র ৩ হাজার ১১৪ একর জমিতে আখ চাষ হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, আমরা আখ আবাদ বাড়াতে কাজ করছি। মিলটি লাভজনক করতে হলে একক প্রোডাক্ট চিনি দিয়ে সম্ভব নয়। অন্যান্য উপাদানের পাশাপাশি মেশিন ও যন্ত্রপাতির আধুনিকায়ন করতে হবে।

এ বিষয়ে ফরিদপুর সুগার মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ খবির উদ্দিন মোল্লা জাগো নিউজকে বলেন, ফরিদপুর চিনিকলটি ৪৬তম মাড়াই মৌসুমের মধ্যে ১৩টিতে লাভ করে, বাকিগুলোতে লোকসান হয়। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির ৩৫০ কোটি টাকার বেশি লোকসান রয়েছে। এর মধ্যে ২০২১-২২ মৌসুমে লোকসানের মূল কারণ ছিল ফরিদপুর চিনিকলসহ মোট ছয়টি চিনিকলে উৎপাদন বন্ধের কথা বলা হয়। এই খবর শুনে কৃষকদের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হয়। অনেক আখচাষি আখ ভেঙে ফেলেন। অনেক হতাশায় পড়েন। ফলে আখ সংকট দেখা দেয়।

তিনি আরও বলেন, এটি সম্ভাবনাময় একটি মিল। মেশিনের অবস্থা ভালো নয়। পরিবর্তন করা জরুরি। এছাড়া আর্থিক সংকটের কারণে অনেক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না।

এমআরআর/এএসএম