মতামত

হত্যার চেয়ে আত্মহত্যার সংখ্যা বেশি!

এইতো কিছুদিন আগে ময়মনসিংহের এক স্কুল ছাত্রী ফেসবুকে সুইসাইডাল নোট লিখে আত্মহত্যা করলো। সেখানে সে তার বাবা মা ও পরিবারের নিয়ম শাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে। এর আগে ফেসবুকের লাইভে এসে গুলি করে আত্মহত্যা করলো একজন ব্যবসায়ী। এ ঘটনাগুলো আমাদেরকে বিচলিত করছে।

Advertisement

আমি একজন মা, বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া দুটি সন্তানের মা আমি। এই বয়সের ছেলেমেয়েরা কী ভাবে বা কোন লাইনে ভাবতে পছন্দ করে তা নিয়ে নিজের মত কিছু পড়াশুনা করি আমি। বুঝার চেষ্টা করি। পরিসংখ্যান বলছে আমাদের দেশে হত্যার চেয়ে আত্মত্যার সংখ্যা বেড়েছে আশংকাজনক হারে।

সংবাদটি আমাকে ভীত করেছে। আমাদের কর্তা ব্যক্তিদের হৃদয়ে নাড়া দিয়েছে কিনা জানিনা তবে সমাজে বাড়তে থাকা এই প্রবণতা নিয়ে আমি অত্যন্ত চিন্তিত। অতীতে আমরা ভয়ে থাকতাম কখন রাস্তাঘাটে কে কাকে খুন করে ফেলছে এমন সংবাদ নিয়ে। অথচ পত্রিকায় প্রকাশ কেবল রাজধানীতেই ২০২০ সালে খুন হয়েছে ২১৯ টি আর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ৬১৭ টি। ২০২১ সালে ঢাকা মহানগরীতে খুন হয়েছে ১৬৬ জন আর আত্মহত্যা করেছে ৬৯৫ জন। তারমানে দাঁড়াচ্ছে, খুনের তুলনায় প্রায় চারগুন বেড়েছে আত্মখুনের সংখ্যা।

কেন মানুষ এমন খুনি হয়ে উঠছে যখন নিজেই নিজেকে শেষ করে দিচ্ছে? সমাজে এর প্রভাব কেমন পড়ছে? এর কারণ নিয়ে সমাজ বিজ্ঞানীরা বা মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞরা যে যার মত করে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন কিন্তু আমি ভাবছি এর প্রভাব কতটা নেতিবাচক হয়ে পড়ছে। এই যে ময়মনসিংহের দশম শ্রেণি পড়ুয়া মেয়েটি লিখেছে সে তিন বছর ধরেই প্রস্তুতি নিচ্ছিলো মরে যাবার এবং পরিবারের কোন কিছু তার পছন্দ অনুযায়ী হচ্ছে না বলে সে নিজের জীবনটাই দিয়ে দেয়ার মত সাহস করলো।

Advertisement

আমি মেয়েটির ফেসবুক স্ট্যাটাসের কমেন্টগুলো অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে পড়ছিলাম। সেখানে তার সমবয়সী অনেক কিশোর-কিশোরীরাই দেখলাম তাদের ভিতরে থাকা কষ্ট প্রকাশ করছে। কেউবা আবার বলেছে সাহস নেই তাই আত্মহত্যা করতে পারছে না কিন্তু মেনেও নিতে পারছে না। আবার কেউ কেউ লিখেছে তারাও হয়তো এমনটাই করবে কোন একদিন।

ইদানিং আবার পড়াশুনায় হতাশা থেকেও আত্মহত্যার ঘটনা দেখা যাচ্ছে। আছে পছন্দমত চাকরি না পেয়ে নিজেকে মেরে ফেলার ঘটনাও। করোনা আসার পর গোটা বিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আমাদের দেশে আলোচনা নাই বললেই চলে। করোনার আড়াই বছরে বাসায় বসে থেকে থেকে ছেলেমেয়েরা হতাশার রাস্তাতে এগিয়ে গেছে অনেক পথ। বন্ধুবান্ধবদের সাথে দূরত্ব, পিতামাতার শাসনে ২৪ ঘন্টা থাকা ইত্যাদি কারণ আমাদের সন্তানদেরকে আসলেই দিকশূন্য করে দিয়েছে।

অথচ এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের সচেতন সমাজে আলোচনা একদমই নেই। আমাদের রাষ্ট্র, সরকার বা মন্ত্রণালয়গুলো মানসিক চাপের বিষয়টিকে একপ্রকার উপেক্ষা করেই যাচ্ছে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলেছে। ছেলেমেয়রা পড়াশুনার চাপের মধ্যে পড়তে যাচ্ছে। গত দুই বছরে স্বাভাবিক পড়াশুনার স্তরে না থাকা সন্তানেরা এই চাপ কতটা নিতে পারবে বা নেয়ার মত মানসিক শক্তি তাদের আছে এই বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়া জরুরি।

Advertisement

নতুন প্রজন্মের একাংশের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। আমাদের সমাজ-রাষ্ট্র-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা পরিবারগুলো এ ধরনের অপ্রত্যাশিত মৃত্যু ঠেকাতে প্রস্তুতি নেয়ার এখনই সময়। এমন খুনের স্রোতকে ঠেকাতে গণমাধ্যমগুলোর ভূমিকাও সামনে আনা জরুরি।

ময়মনসিংহের ছাত্রীটির সুইসাইডাল নোটটি যে হারে শেয়ার করা হয়েছে সেটিও আমি মনে করি অনেক তরুণ তরুণীকে এমন ঘটনায় উস্কে দিবে। আত্মহত্যার সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে সংবাদ মাধ্যমকে আরও অনেক বেশি দায়িত্বশীল হওয়া জরুরি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন তরুণ প্রজন্মের কাছে হয়ে উঠেছে নিজেদেরকে প্রকাশের একটি সহজ মাধ্যম। গড়ে উঠেছে বিভিন্ন গ্রুপ যেখানে আলোচনা চলে, বিনিময় হয় নিজেদের হতাশার কথা। অনেক গোপন গ্রুপ আছে যেখানে অনেক নিষিদ্ধ আলাপও হয়। সেগুলো মনিটরিং এর নাই কোন ব্যবস্থা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে সংবেদনশীল করার ক্ষেত্রে আমাদের নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনেক বড় কিছু করার আছে।

আমাদের সমাজ একটা রুপান্তর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক সম্পর্কই এখন সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবারের শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকেই। আমরা এখন আটকে থাকি ঘর, অফিস, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দুনিয়ায়। বাইরের জগতে ব্যক্তির জনপরিসর সীমিত হয়েছে। এ কারণে নিঃসঙ্গতা ও বিচ্ছিন্নতাবোধ এখন নিত্যসঙ্গী।

মানুষের মাঝে থাকা আত্মিক সম্পর্ককে দখল করে নিচ্ছে ডিজিটাল মাধ্যমের সম্পর্ক। এর দ্বারা বেশি প্রভাবিত হচ্ছে আমাদের কিশোর ও তরুণরা। তারা এখন বাস্তবতাকে বুঝার আগেই বায়বীয় বা অবাস্তব ঘোরের জগৎ তৈরি করছে যেখানে সে নিজেকে রাজা মনে করছে। নিজের সিদ্ধান্তের মালিক নিজেকে করে ফেলছে। পরিবারের ভূমিকাকে একপ্রকার অস্বীকার করতে চাইছে ব্যক্তি স্বাধীনতার আড়ালে।

হতাশা, অবাস্তব প্রত্যাশা, অযৌক্তিক চাহিদার চাপ, একাকিত্ব, চাওয়ার সাথে পাওয়ার পার্থ্যক্যের জন্য নিজেকে দায়ী ভাবা, আশাহীনতা—এমন অনেক কারণেই মানুষ নিজেকে শেষ করে দিতে চাইছে। সময় এসেছে এখনি সর্বস্তরে প্রতিটা বয়সের প্রতিটা ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রাধান্য দিয়ে আলোচনা শুরু করা।

সমাজে একটি খোলামেলা পরিবেশ তৈরি করা যাতে ব্যক্তি নিজেকে একা না ভাবে। প্রয়োজনে যেন কাছের মানুষের কাছে সাহায্য চাইতে পারে এমন সম্পর্কের ভিত্তি রচনা করা। আত্মহত্যার এই স্রোত কোন আইন করে ঠেকানো যাবেনা। দরকার একটি মানবিক সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টি।

লেখক : অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, কলামিস্ট।

এইচআর/এএসএম