দেশজুড়ে

৮৪ বছরের ইতিহাসে সর্বনিম্ন উৎপাদন কেরু চিনিকলে

চুয়াডাঙ্গার ঐতিহ্যবাহী দর্শনা কেরু অ্যান্ড কোম্পানি চলতি মৌসুমে সর্বনিম্ন আখ মাড়াই করেছে। শুধু আখ মাড়াইয়ের ক্ষেত্রেই নয়, চিনি আহরণের হার ও উৎপাদন সব ক্ষেত্রেই ছিল সর্বনিম্ন রেকর্ড। গত ১২ ফেব্রুয়ারি রাত আড়াইটার দিকে চলতি মাড়াই মৌসুম শেষ হয়েছে।

Advertisement

১৯৩৮ সালে প্রতিষ্ঠিত চিনিকলটির ৮৪ বছরের ইতিহাসে ২০২১-২২ মাড়াই মৌসুমে উৎপাদন সর্বনিম্ন রেকর্ড। চলতি মৌসুমে জেলার মাত্র চার হাজার ৬২৭ একর জমিতে আখ চাষ হয়েছিল। এর মধ্যে চিনিকলের ১০টি কৃষি ও পরীক্ষামূলক খামারে ৯৮৯ একর জমিতে আখ চাষ হয়। বাকি মিলজোন এলাকার চাষিরা রোপণ করেছিলেন তিন হাজার ৬৩৮ একর।

এর আগে ২০২০-২১ মৌসুমে আট হাজার ৫৩২ একর জমিতে আখ রোপণ করেছিল চিনিকল কর্তৃপক্ষ ও মিলজোন এলাকার চাষিরা, যা চলতি মৌসুমের চেয়ে তিন হাজার ৯০৪ দশমিক ৫০ একর বেশি। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এবং কেরু কোম্পানির ৮৪ বছরের ইতিহাসে এবারই প্রথম আখচাষ কম হয়েছে। সময় মতো মিল থেকে চাষিদের সার বীজ সরবরাহ না করা, বর্তমান বাজারদরের চেয়ে আখের দাম কম, উন্নত জাতের আখ না দিয়ে পুরোনো একই জাতের আখ সরবরাহ, অন্যদিকে ধান, পাট, ভুট্টার ভালো দাম পাওয়ায় চাষিরা আখ চাষে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। ফলে চলতি মাড়াই মৌসুমে মিলটি চরম আখ সংকটে পড়ে।

২০২০-২১ অর্থবছরে আখ মাড়াই মৌসুমে মিলটির চিনি বিভাগে সাড়ে ৬৯ কোটি টাকা লোকসান হয়েছিল। তবে এবারের লোকসানের পরিমাণ ৭০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছে মিল কর্তৃপক্ষ।

Advertisement

আখ চাষিদের দাবি, চলতি মৌসুমের আগে আখ রোপণের সময় নিবন্ধিত আখচাষিদের সার, কীটনাশক ও সেচের জন্য ঋণ দেওয়া হয়নি। চিনিকলের সহায়তা না পাওয়া, ধান, পাট, সবজিসহ বিভিন্ন ফসল চাষে লাভ বেশি হওয়ায় আখ চাষে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন চাষিরা। সেই সঙ্গে চিনিকল থেকে আখ চাষের জন্য প্রয়োজনীয় সার, কীটনাশক, বীজ সংগ্রহ করতে হলে প্রায় ১১ শতাংশ সুদ দিতে হয়।

চিনিকলের দৈনিক মাড়াই ক্ষমতা নির্দিষ্ট হওয়ায় কোন চাষির কাছ থেকে কবে আখ কেনা হবে তার একটা পারমিট দেওয়া হয় চাষিকে। এ পারমিট সময়মতো পাওয়া নিয়ে ঝামেলায় পড়তে হয় কৃষককে। জমিতে আখ পরিপক্ব হওয়ার পরও সময়মতো পারমিট পাওয়া যায় না। পারমিট পাওয়ার পর ক্ষেত থেকে আখ চিনিকলে বা চিনিকলের ক্রয়কেন্দ্রে পরিবহন করতেও ভোগান্তিতে পড়তে হয়। সময়মতো ট্রাক বা ট্রাক্টর ভাড়া পাওয়া যায় না।

এসব কারণে আখচাষ কম হয়েছে। ফলে দর্শনা কেরু অ্যান্ড কোম্পানির আওতায় ৮৪ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন আখ চাষ হয়েছে চলতি মৌসুমে। বর্তমান পরিস্থিতি সমাধানের উদ্যোগ না নিলে একদিন আখের অভাবে বন্ধ হয়ে যেতে পারে চিনি কলটি।

সর্বনিম্ন আখ চাষের ব্যাপারে কেরু অ্যান্ড কোম্পানির দাবি, দেশের ছয়টি চিনি কারখানা বন্ধ হওয়ায় কেরু চিনিশিল্প নিয়ে চাষিদের মধ্যে নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল। এ কারণে অনেক চাষি আখ রোপণ করেননি। এছাড়া ধান, পাট, ডালসহ বিভিন্ন সবজির দাম ভালো পাওয়া, দীর্ঘমেয়াদি চাষ এবং বছর শেষে লভ্যাংশ কম হওয়ায় অনেক চাষি আখ চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।

Advertisement

১৯৩৮ সালে চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় চিনিশিল্প, ডিস্টিলারি ও বাণিজ্যিক খামারের সমন্বয়ে এ বৃহৎ শিল্প কারখানাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠানটি জাতীয়করণ করা হয়। তখন থেকে অদ্যাবধি এটি কেরু অ্যান্ড কোং (বাংলাদেশ) লিমিটেড নামে বাংলাদেশ সুগার অ্যান্ড ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের অধীনে পরিচালিত হয়ে আসছে। দর্শনা কেরু চিনিকলের সঙ্গে সরাসরি ১ হাজার ২০০ মানুষের কর্মসংস্থান জড়িত। এছাড়া প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে প্রায় ১৫ হাজার লোক জড়িত।

সেই সঙ্গে কৃষিভিত্তিক চিনিশিল্পকে কেন্দ্র করে এলাকায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এ প্রতিষ্ঠানে কৃষি খামারের আওতায় জমি রয়েছে তিন হাজার ৩৩৫ দশমিক ৫৬ একর। যার মধ্যে চাষযোগ্য বাণিজ্যিক খামারের জমির পরিমাণ তিন হাজার ৫৫ দশমিক ৮৪ একর। প্রতি মৌসুমে চিনিকল কর্তৃপক্ষ গড়ে প্রায় এক হাজার পাঁচশ একর জমিতে আখ রোপণ করে।

কেরু চিনিকল সূত্রে জানা গেছে, ২০২০-২১ মৌসুমে চিনিকলের আওতায় আখ চাষ ছিল আট হাজার ৫৩২ একর। চলতি (২০২১-২২) রোপণ মৌসুমে আখ চাষ হয়েছে মাত্র চার হাজার ৬২৭ একর জমিতে, যা গত বছরের তুলনায় অর্ধেক। এ আখ দিয়ে চলতি মৌসুমে মাত্র ৫১ দিন মিলটি চালু রাখা সম্ভব হয়েছে। চলতি মৌসুমে ৪৬২৭ একর জমির ৫৩ হাজার ৬৯৩ মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে ৩ হাজার ২৩ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদন হয়েছে। চিনি আহরণের গড় হার ছিল ৫ দশমিক ৬২ ভাগ।

চলতি মৌসুমে কত টাকা লোকসান হয়েছে মিল কর্তপক্ষ সেটা এখনও জানাতে পারেনি। এর আগে ২০২০-২১ মৌসুমে মিলটি ৮৫৩২ একর জমির ১ লাখ ১১ হাজার ৮৬০ দশমিক ৭৮০ মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে ৫৮৮৩ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদন করে। চিনি আহরণের গড় হার ছিল ৫ দশমিক ২৫ ভাগ। ওই মৌসুমে মিলটির চিনি শিল্পে লোকসান হয় ৬৯ কোটি ৫০ লাখ ৬২ হাজার টাকা। ২০১৯-২০ মৌসুমে মিলটি ৭৩৭৫ একর জমির ১ লাখ ৩০৩৮ দশমিক ১৩ মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে ৫১৪২ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদন করে। ওই মৌসুমে মিলটির চিনি শিল্পে লোকসান হয় ৭০ কোটি ৭৭ লাখ ৪৪ হাজার টাকা।

কৃষকদের দাবি, ১০-১২ বছর আগে চিনিকলের অব্যবস্থাপনার কারণেই কৃষকরা আখ চাষে আগ্রহ হারিয়েছেন।

বেগমপুর গ্রামের আখতার হোসেন নামে এক আখচাষি বলেন, আগে তিন-চার বিঘা জমিতে আখ চাষ করতাম। এক সময় ধান আর আখ ছিল আয়ের প্রধান উৎস। এখন আখ চাষ করি না। ২০১১-১২ সালে সর্বশেষ দুই বিঘা জমিতে আখ চাষ করেছিলাম। ওই সময় মিলের অব্যবস্থাপনার জন্য ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। এজন্যই মূলত আখ চাষে আগ্রহ হারিয়েছি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মনোহরপুর গ্রামের এক আখ চাষি জানান, ভালো আখ উৎপাদন করায় দর্শনা চিনিকল থেকে পুরস্কার পেয়েছি। তখন আখ চাষে আগ্রহ ছিল মানুষের। এরপর সুগারমিল সঠিক সময়ে আখ কিনতো না। আখ দিলে মিল নিতো না। একশ্রেণির দালালের সঙ্গে কর্মকর্তারা জড়িত ছিল। কৃষকের আখ ওজনে কম দেখানো হতো। এরপর কৃষকরা আখ চাষে মুখ ফিরিয়ে নেন।

সর্বোচ্চ পরিমাণ আখ লাগিয়ে মিল থেকে পুস্কারপ্রাপ্ত কৃষক উথলী গ্রামের আবজালুর রহমান ধীরু জানান, যেখানে বছরের পর বছর দেশে চিনির ব্যবহার বাড়ছে, সেখানে চিনিকলের আধুনিকায়নের কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। লোকসান কমাতে উন্নত জাতের আখ, নতুন যন্ত্রপাতি নিয়ে যেখানে ভাবার কথা, সেখানে প্রাচীন ব্যবস্থাকেই আঁকড়ে ধরে রাখা হয়েছে। মিলের আধুনিকায়ন এবং চিনিকলের দুর্বলতা চিহ্নিত করা জরুরি। এর মাধ্যমে সবার আগে উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনা দরকার। আখচাষি আব্দুল মান্নান পিল্টু বলেন, এখানে আখ থেকে তৈরি চিনির প্রক্রিয়ায় তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। প্রাচীন পদ্ধতিতে ক্ষেত থেকে আখ সংগ্রহ করা এবং মাড়াইয়ে এখনো প্রায় শতভাগ ক্ষেত্রেই শারীরিক শ্রমের ওপর নির্ভর করছে মিলটি। এতে সময় এবং জনবল লাগে বেশি। সে তুলনায় উৎপাদন কম। ফলে প্রতিনিয়ত কেজিপ্রতি বাড়ছে চিনির উৎপাদন খরচ।

আখচাষি কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল বারী জানান, আখ দেড় বছরের ফসল। সে হিসেবে দেড় বছরে দুবার পাট, তিনবার ধান ও ভুট্টাসহ অন্যান্য সবজি চাষ করে চাষিরা বেশি লাভবান হচ্ছেন। এজন্য আখ চাষ থেকে চাষিরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। আখচাষ কমে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে কেরু চিনিকল আখচাষি কল্যাণ সমিতির সভাপতি আব্দুল হান্নান জানান, বর্তমানে আখের মূল্য কেরুজ মিলগেটে প্রতি মণ ১৪০ টাকা ও আখ ক্রয় কেন্দ্রে ১৩৬ টাকা ৩৭ পয়সা। প্রতি মণ আখের মূল্য ৩০০ টাকা না করলে আখচাষ সম্ভব নয়। তাছাড়া গত রোপণ মৌসুমে চাষিরা সময় মতো সার না পাওয়ায় আখ রোপণ অর্ধেকে নেমেছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর কেরুতে এবারই প্রথম আখচাষ কম হয়েছে।

চিনিকলের মহাব্যবস্থাপক (কৃষি) গিয়াস উদ্দিন বলেন, ছয়টি চিনিকল বন্ধের কারণে এলাকার আখচাষিরা দ্বিধায় পড়েছেন। সেই সঙ্গে আখচাষিদের ঋণ হিসেবে প্রণোদনা দেওয়াও সম্ভব হয়নি। তবে চাষিদের সুযোগ সুবিধা দেওয়ার ব্যাপারে করপোরেশন উদ্যোগ নিয়েছে। আশা করছি চাষিরা চিনিকলকে ভালোবেসে আবার আখচাষে ফিরবেন। প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে চাষিরা যেন আবার আখ চাষে ফিরে আসেন সেজন্য সম্মিলিত উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কেরু চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোশারফ হোসেন জানান, মিলের আধুনিকায়ন কাজ শুরু হয়েছে। চিনিকলসহ যে ইউনিটে লোকসান আছে তা কাটিয়ে উঠতে নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ চলছে। আগামী মৌসুমে চিনি কারখানাকে লাভজনক অবস্থায় নেওয়া সম্ভব না হলেও বড় ধরনের লোকসান কমাতে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। আখচাষিদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, কৃষকদের সঙ্গে সভা-সমাবেশ ও উঠান বৈঠক চলমান। এলাকার আখচাষিদের বেশি বেশি আখ চাষ করে অধিক মুনাফা অর্জনের পাশাপাশি মূল্যবান সম্পদ কেরু চিনিকলটি রক্ষার আহ্বান জানান তিনি।

এফএ/এএসএম