আমরা তো সব কিছুতেই ফার্স্ট হতে চাই। এই সত্যটা আমরা অনেকেই মানি না, বা বলি না। কিন্তু এই সত্যটা মানুষের অন্তরে অন্তরে লালিত হয় এমনভাবে যে তার উপস্থিতি টের পাই না। টের পাই যখন আমাদের ক্রিকেটাররা বিদেশের মাটিতে তিন ম্যাচের ওয়ানডে’র সিরিজ জেতে, তখন বুঝতে পারি ফার্স্ট হওয়ার স্বপ্ন।
Advertisement
আমাদের মেগা উন্নয়নের মেগাপ্রকল্পগুলো যতোই মুখ থুবড়ে পড়ে থাকুক না কেন, চাই ওইগুলো যেন দ্রুতই সম্পন্ন হয়। সেখানে ফার্স্ট হতে চাইলেও সেটা সম্ভব নয়। তবে আমরা ভিন্নভাবেও বলতে পারি, এর আগে বাংলাদেশে এমন মেগা প্রকল্প নেয়া হয়নি আর এমন মেগা অপচয়ও হয়নি। এদিক থেকে আমরা এখানে ফার্স্ট হয়েই আছি। নির্মাণখাতের ব্যয়েও বাংলাদেশ এক নম্বরে বেশ কিছুকাল ধরেই।
আমরা এখন সবক্ষেত্রে ফার্স্ট হওয়ার তরিকায় আছি। এই তরিকার হাইওয়ে থেকে আমাদের ডি-রেইল্ড করার ক্ষমতা কারো নেই। কারো বলতে আমরা ক্ষমতার বাইরের রাজনৈতিক শক্তির কথাই বলছি। তারা কোনোভাবেই ক্ষমতাসীনদের উন্নয়নের তরিকা থেকে নামাতে পারবেন না। এমন কি তাদের ক্ষমতা থেকেও সরাতে পারবে না। কারণ, সেখানেও সরকার মেগা ক্ষমতায়নের কলকব্জা বেশ পোক্ত করেই বেঁধেছেন। প্রকাশ্যে তারা বলেন ২০৪১ সালের আগে তারা ক্ষমতাচ্যুত হবেন না।
চলতি সপ্তাহে আমরা শব্দ দূষণে ফার্স্ট হয়েছি। গত সপ্তাহে আমরা সেকেন্ড হয়েছি বায়ুদূষণে, দিল্লিকে পরাজিত কতে পারিনি। ঢাকা মহানগরের বায়ুতে কি পরিমাণ বস্তুকণা যে আছে, সেই হিসাবই দিয়েছিলো আবিষ্কারক গবেষকরা। আমাদের নিঃশ্বাসের সঙ্গে যে পরিমাণ বস্তুকণা আমরা টেনে নিয়ে নিজেদের ফুসফুসকে সিল করে দেবার জন্য বা বলতে পারি সেই আয়োজনে ব্যস্ত আছি, তার নমুনা দিতে পারছি না। কারণ বায়ুতে বস্তুকণা খালি চোখে দেখা যায় না। শুধু ধুলাবালি নয়,কেমিক্যালসের উপাদান, কলকারখানার পরমাণুর সাইজ কণা, মোটরগাড়ির কালো ধুয়া ছাড়াও এমন অনেক বস্তুকণা আমরা নিঃশ্বাস ভরে নিচ্ছি যে আমরা তার খোঁজ-খবরও রাখি না।
Advertisement
উন্নয়নের মহাপ্রকল্প থেকে জাত বস্তুকণাও যে আমাদের ফুসফুসে জ্যাম সৃষ্টি করছে, সেটা কি আমরা একবারও ভেবে দেখেছি? আমরা বহু বিষয়েই কেবল অস্বচ্ছ ধারণা নিয়ে বাঁচি, গায়ে মাখি না সেই সব কিছু, এই অমানবিক বিষয়ে আমাদের প্রজ্ঞার প্রচন্ড অভাব। আমরা কেবল দৃশ্যমান উন্নয়নের রুপ দেখেই করতালিতে মুখর করে তুলি চৌপাশ। সেই সঙ্গে তৈরি করি শব্দদূষণ। রাস্তা বন্ধ করে, সেখানে স্টেজ করে মাইক সেক করে গলার রগ ফুলিয়ে যে সব বাক্য-বাণী আমরা ছুঁড়ে মারি, তা যে মহাশব্দদূষণের মধ্যে পড়ে তাও আমরা মানি না বা কল্পনা করি না।
রাজনৈতিক গলাবাজিতে বা বলা যাক, রাজনৈতিক তর্কাতর্কিতে আমাদের জুড়ি নেই পৃথিবীতে। তথ্য-বিকৃতিতে জুড়ি নেই, ইতিহাস বিকৃতিতে জুড়ি নেই, মিথা কথা বলায় জুড়ি নেই এবং রাজনৈতিক দমন ও হানাহানিতে তো আমরা সবকালেই ফার্স্ট হয়ে আছি। এই সব গৌরবময় অবস্থান কারা আমাদের দিয়েছে রাজতিলকের মতো করে চিরস্থায়ীভাবে, সেই তথ্যউপাত্ত জানা থাকা জরুরি। কিন্তু সেই সব আমি বলবো না। আমি সামান্য কিছু শব্দদূষণের তথ্য জানাই, তাতে পাঠকের মনে যদি ভয় ঢোকে, সচেতন হয় তারা।
‘এর আগে একাধিকবার বায়ুদূষণে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় শহরের তালিকায় ১ নম্বরে নাম ওঠে রাজধানী ঢাকার। সর্বশেষ গত সপ্তাহে বায়ুদূষণের দিক থেকে ঢাকা বিশ্বের দ্বিতীয় দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় উঠে আসে। শব্দদূষণ নিয়ে ‘ফ্রন্টিয়ার্স ২০২২: নয়েজ, ব্লেজেস অ্যান্ড মিসম্যাচেস’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে শব্দদূষণ কীভাবে মানুষের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা প্রভাবিত করছে, সে বিষয়ও তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, শব্দদূষণে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় পাঁচ শহরের তিনটির অবস্থানই দক্ষিণ এশিয়ায়।’ [প্রথম আলো,২৭ মার্চ, ২২]
বেশি শব্দে আমাদের কানে তালা লাগে, এটা আমরা সেই শিশুকাল থেকেই জেনে আসছি। কানে তালা লাগলে সেটা খুলেও যায়, সেটাও আমরা জানি। কিন্তু আমাদের কানের শোনার ক্ষমতা যে কমে যায়, তা আমরা বুঝতে পারি না। বুঝতে পারি তখনই যখন কানে কিছু শুনতে পাই না। ছেলেমেয়েরা কথা বলছে পাশে দাঁড়িয়েই, তবু মনে হয় ওরা যেন কতো দূর থেকে কথা বলছে। স্ত্রীর কথাও অস্পষ্ট শোনা যায়।
Advertisement
মনে হয় , কানে ময়লা জমেছে, তাই শুনছেন না। কান পরিষ্কার করেও যখন শোনা যায় না, তখন মনে পড়ে শব্দদূষণের গ্যাড়াকলে পড়েছে। এগুলো হচ্ছে অভিজ্ঞতার কথা বা বিষয়। সেই অভিজ্ঞতাকে কেন্দ্র করেই ফন্টিয়ার্স ২০২২ : নয়েজ, ব্লেজেস অ্যান্ড মিচম্যাচেস’ শীর্ষক জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি ইউএনইপির প্রকাশ করা এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি ইউএনইপি যতোই আমাদের জ্ঞান দান করুক না কেন, আমরা শব্দদূষিত করার তরিকা থেকে বিচ্যুত হবো না। আমরা বাস-ট্রাকের হাইড্রোলিক হর্ন বাজিয়ে নিজেদের গতির প্রগতি সৃষ্টি করছি। যারা ওই হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহারের পারমিশন দিয়েছেন, তারা এক মহাজ্ঞানী সরকারি কর্মকর্তা। সরকারি কর্মকর্তাদের কান নেই, তাদের নিঃশ্বাস নিতে হয় না, তারা কেবল দুই হাতে ঘুস পেলেই খুশি।
মূলত গাড়িওয়ালাদের চেয়ে পারমিশন দেনেওয়ালারাই যে মূল অপরাধী শব্দদূষণের জন্য, সেটা সাদা মনের মানুষও বুঝতে পারে। আমাদের গাড়িচালকেরা অধিকাংশই নিরক্ষর বা স্বল্প শিক্ষিত। তারা শব্দদূষণ কী/ জানে না। কালো ধোঁয়া বেরুলে কি ক্ষতি মানুষের, তাও জানে না। গাড়ির নিচে চাপা দিয়ে মেরে ফেললে কি ক্ষতি, তাও তাদের কাছে নগণ্য অপরাধ।
যারা কেমিক্যাল ব্যবহারকারী, পরিবেশ দূষণের ফলে কি পরিমাণ ক্ষতি ও অপরাধ হতে পারে, তারা তা জানেন, কিন্তু অর্থবিত্তের লোভের কাছে তারা পরাজিত। যারা নির্মাণের সঙ্গে জড়িত তারাও ওই একই পথের পথিক। চারপাশে যে সব মানুষ বাস করে, তারাও সজাগ-সচেতন নয় বায়ু-দূষণ,শব্দদূষণ সম্পর্কে।
এই অবস্থায় আমরা কি সরকারকে দায়ী করতে পারি? না, পারি না। কারণ আমরা উন্নয়ন চাই, সরকার সেই কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নকে মেগা উন্নয়নে নিয়ে গেছেন। সে জন্য সরকার ধন্যবাদার্হ। দেশের উন্নতি হবে, হচ্ছে এতে তো বাদ-সাধার কারণ নেই। বরং আমরা বাহবা দেবো সরকারকে। কিন্তু বায়ুদূষণের ফলে যে ক্ষতি হচ্ছে সরকারি লোকেরও, তাদের ফুসফুসেও যে ঢুকে পড়ছে বস্তুকণার পরমাণু, উন্নয়নের রুপে মুগ্ধ তারা ভুলে বসে আছেন সেই মহাক্ষতি। কারণ বায়ুদূষণ সাদা চোখে দেখা যায় না।
শব্দদূষণ তাদের বিরক্ত করলেও তারা সেই শব্দকে বেশি মারাত্মক মনে করেন না। যারা হাইড্রোলিক হর্নের দাতা তাদের সেই জ্ঞানও নেই যে তারাও এর শিকার হবেন। আর সরকার যে কাঠামো যোগে দেশ চালায়, তার তো কান নেই যে হাইড্রোলিক শব্দের শিকার হবে। তাই সরকারের কর্ণওয়ালারা বিদেশ থেকে এমন তুলো এনে কানে ঢুকিয়ে রাখেন যে, তারা কিছুই শুনতে/জানতে পান না। তবে নিঃশ্বাস তাদের নিতে হয় ঢাকার দূষিত বাতাসেই। তাদের ফুসফুস তারা বছরে বোধহয় কয়েকবার ওয়াশ করে নিয়ে আসেন ইউকে বা আমেরিকা থেকে। ফলে তাদের আমাদের মতো গরিব-গোবরোদের মতো বেহাল দশায় পড়তে হয় না।
অবশ্য, অথর্ব হবার পর সরকারি বেসরকারি, ক্ষমতাবান ও ক্ষমতাহীন সবাই বোঝে কি কারণে এমনটা হলো।
লেখক : কবি, সিনিয়র সাংবাদিক।
এইচআর/জেআইএম