মাটির বুক চিরে সবুজের স্বপ্ন বোনেন কৃষক। সার, সেচ ও কৃষকের পরিচর্যায় মাঠে ফলে ফসল। সেই কষ্টের ফসল কেটে হাট-বাজারে আনেন বিক্রির জন্য। কিন্তু লাভতো দূরের কথা মেলে না নায্যদামও। মধ্যস্বত্বভোগীরাই লুটে নেন মুনাফার বড় অংশ। কৃষকরা পান নামমাত্র মূল্য।
Advertisement
রাজশাহীর অন্যতম পাইকারি সবজির মোকাম হিসেবে পরিচিত খড়খড়ি বাইপাস। কাকডাকা ভোরেই শুরু হয় এ মোকামের কর্মযজ্ঞ। এখানে জেলার পবা, মোহনপুর, তানোর, গোদাগাড়ী, চারঘাট ও বাঘা থেকে কৃষকরা তাদের কাঁচামাল নিয়ে আসেন বিক্রির জন্য।
একদিন আগেই ক্ষেত থেকে সবজি তুলে রাতভর ট্রাক কিংবা ট্রলি ভর্তি করে রওনা দেন রাজশাহীর এ মোকামে। পরে এখান থেকেই ভোরবেলা রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরগুলোতে ট্রাকভর্তি কাঁচামাল পাঠানো হয়।
মূলত এ মোকামে কৃষকের কাছ থেকে সবজি কিনে ঢাকায় পাঠান সেখানকার বাজার সমিতির বড় বড় ব্যবসায়ীরা। এ মোকাম থেকেই নগরীর বিভিন্ন ছোট-বড় বাজারগুলোতে যায় কাঁচাসবজি। খড়খড়ি থেকে নগরীর বাজারগুলোতে যাওয়ার পরই সবজির দাম বাড়ে ৫ থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত। যা প্রায় দ্বিগুণ। সবমিলিয়ে কৃষকরা নায্যদাম থেকে থাকছেন বঞ্চিত।
Advertisement
হাটটি ঘুরে দেখা গেছে, আলু প্রতিকেজি পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ১৩ থেকে ১৪ টাকায় আবার ওই আলুই স্থানীয় বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ টাকা কেজি, বেগুন ৫ থেকে ১০ টাকায় বিক্রি হলেও স্থানীয় বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২৫ থেকে ৩৫ টাকা, পেঁয়াজ পাইকারি ১৮ থেকে ২০ টাকা, খুচরা বিক্রি হচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ টাকা, কাঁচামরিচ ৩০ থেকে ৪০ টাকা হলেও খুচরা বাজারে গিয়ে এর দাম হচ্ছে ৮০ থেকে ১০০ টাকা কেজি, পাইকারি শশা ২০ টাকায় মিললেও খুচরা বাজারে তা ৩৫ থেকে ৪৫ টাকা কেজি, পটল ৫০ থেকে ৫২ টাকা তবে খুচরা বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৮০ টাকায়, করলা ৩৫ থেকে ৪০ হলেও খুচরা বাজারে দাম ৬০ থেকে ৮০ টাকা ও লাউ প্রতি পিচ ২০ থেকে ২৫ টাকা হলেও তা খুচরা বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকায় ।
এদিকে নতুন সবজি হিসেবে সজনে ডাটা পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ টাকায় কিন্তু স্থানীয় বাজারে একই জিনিস বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা কেজি, বাজারে ফুলকপির সহজলভ্যতা থাকলেও তা পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ টাকায় এবং খুচরা বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ টাকায়।
আবার নতুন সবজি ঢেঁড়সের কেজি ৪০ থেকে ৫০ টাকা হলেও খুচরা বাজারে তা ১০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। দামে সস্তা প্রতিকেজি মূলা পাইকারি ৪ থেকে ৫ টাকা কেজি হলেও তার খুচরা মূল্য ১০ থেকে ১৫ টাকা। আদার পাইকারি দর ৪০ থেকে ৪৫ টাকা হলেও স্থানীয় বাজারে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে এবং রসুন ২৮ থেকে ৩০ টাকা পাইকারি রেটে বিক্রি হলেও স্থানীয় বাজারগুলোতে তা ৪০ থেকে ৫০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে।
অর্থাৎ প্রায় প্রতিটি সবজির ক্ষেত্রেই ১৫ থেকে ২০ টাকা বেশি দামে স্থানীয় খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে।
Advertisement
খড়খড়ি হাটের সবজি বিক্রেতা মো. শরিফুল ইসলাম বলেন, গত দু’তিন সপ্তাহ ধরে সবজির আমদানি কম। কারণ শীতের মৌসুম শেষ। এসময় শীতকালীন সবজি সেভাবে আর মেলে না। যার কারণে বাজারেও সবজি কম উঠছে। মার্চ, এপ্রিল ও মে মাস পর্যন্ত শাক-সবজির আরও আকাল দেখা দেবে। তখন দামটাও অনেক বাড়বে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, গ্রীষ্মের আগেই কিছু সবজি বাজারে এসেছে। তবে সেটা খুব কম। এ ছাড়া কিছু শীতকালীন সবজিও রয়েছে বাজারে। শীতকালীন সবজিগুলোর দাম তুলনামূলক কম হলেও গ্রীষ্মকালীন আগাম সবজির দাম চড়া। মাস তিনেক বাজার এমনই চলবে।
সবজির বাজার খারাপ বলে জানালেন আরেক পাইকারি সবজি বিক্রেতা তরিকুল ইসলাম।
তিনি বলেন, জয়পুরহাট থেকে বাজারে প্রচুর মিষ্টিকুমড়া আসছে। তারা পাইকারি কিনছেন ১৬ থেকে ১৭ টাকা কেজি করে। সেইসঙ্গে পরিবহন ও শ্রমিক খরচা যুক্ত হচ্ছে। কিন্তু এখনকার বাজারে মিষ্টিকুমড়া ১৬ থেকে ১৭ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এক সপ্তাহ আগেও কেজিতে ২ থেকে ৩ টাকা লাভ হয়েছে তাদের।
খড়খড়ি বাজার থেকে ১৫০ মণ পেঁয়াজ কিনেছেন ব্যবসায়ী মোহাম্মদ তুহিন। তিনি বলেন, গ্রাম থেকে গৃহস্তরা এখানে পেঁয়াজ বিক্রি করতে আসেন। আমি ২০ থেকে ২২ টাকা দরে পেঁয়াজ কিনেছি। নগরীর মাস্টার পাড়া বাজারে নিয়ে বিক্রি করবো। কেজিতে ৫০ পয়সা থেকে ১ টাকা লাভে বিক্রি করব। তারা আবার ওই পেঁয়াজ বেঁচবে কেজি প্রতি ৫ থেকে ১০ টাকা লাভে।
খড়খড়ি বাজারের পাইকারি পেঁয়াজ ব্যবসায়ী রফিজ উদ্দিন। পেঁয়াজ কিনে ঢাকায় পাঠান। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, রাজশাহীর পবা, গোদাগাড়ী ও নাটোর থেকে আসা পেঁয়াজ তিনি কিনেছেন ২০ টাকা কেজি দরে। এই পেঁয়াজ ঢাকায় বিক্রি করবেন ২৫ টাকায়। এতে পরবিহন খরচ বাদ দিয়ে কিছুটা লাভ থাকবে বলে তার ভাষ্য।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয়ের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও অতিরিক্ত কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. আব্দুল্লাহ হিল কাফি বলেন, আগের তুলনায় রাজশাহীতে আবাদি জমির পরিমাণ কমলেও রাজশাহীতে সবজির আবাদ বেশ ভালো হয়েছে। ২০২০-২১ রবি মৌসুমে সবজির আবাদ হয়েছিল মোট ১৮ হাজার ১১৪ মেট্রিক টন। এবারো প্রায় সম পরিমাণ উৎপাদন এসেছে। সে হিসাবে বাজারে সবজির ঘাটতি থাকার কথা না। বরং বাজারে পর্যাপ্ত কাঁচামাল থাকার পরও কিছু মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরা এর সুবিধা লাভ করেন। মাঝখান থেকে কৃষকরা উপেক্ষিত হন।
সমাধান স্বরূপ তিনি বলেন, যদি রাজশাহী নগরীরসহ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে উন্মুক্ত কৃষি হাব করা হয় তাহলে এ সংকট থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব হবে। যেখানে কৃষকরাই সরাসরি তাদের কাঁচামাল রাখার জায়গা করে সরাসরি ঢাকা ও রাজশাহীর অন্যান্য পাইকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তাদের পণ্য বেঁচাকেনা করবেন। কেবল এর মাধ্যমেই কৃষকের ভাগ্য ফেরানো সম্ভব, অন্যথায় নয়।
এফএ/জেআইএম