ভূমধ্যসাগরের বিপজ্জনক পথে ইউরোপে ঢুকতে চেষ্টা করেন বহু অভিবাসী। তাদের আশা থাকে, কোনোমতে ভূমধ্যসাগর হয়ে ইউরোপীয় পানিতে ঢুকে পড়লে কোনো উদ্ধারকারী দল তাদের নিয়ে ইতালি বা অন্য কোনো ইউরোপীয় দেশে ছেড়ে দেবে।
Advertisement
যদিও মাল্টা, সাইপ্রাস ও স্পেনে এই পন্থায় অনেকে এসে পৌঁছায়, ইতালিতেই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক উদ্ধারকারী জাহাজ এসে নোঙর ফেলে। ২০২০ সালে ৩৪ হাজারেরও বেশি অভিবাসী সাগরপথে ইতালিতে পৌঁছায়। এর মধ্যে বেশিরভাগই যায় লাম্পেদুসা, সিসিলি ও কালাব্রিয়া অঞ্চলে।
কিন্তু এই জায়গাগুলোতে পৌঁছানোর পর কী হয়? জাহাজ তটে ভেড়ার পর যখন অভিবাসীরা ইতালির মাটিতে নামেন, এরপর তাদের নানা ধরনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এই প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করেছে চলমান করোনা পরিস্থিতি।
প্রথম ধাপ: ‘হটস্পট’
Advertisement
ইতালির সীমান্তবর্তী এলাকাজুড়ে রয়েছে অসংখ্য অভিবাসী নিবন্ধনকেন্দ্র, যাদের স্থানীয়রা ‘হটস্পট’ বলে থাকে। উদ্ধারকারী জাহাজ থেকে নামার পর এই হটস্পটেই অভিবাসীদের প্রাথমিক নিবন্ধন করতে হয়, এখানেই তাদের ‘পরিচয় নিশ্চিত’ করা হয়। এই প্রক্রিয়া গত কয়েক বছরে অপরিবর্তিত রয়েছে।
অ্যাডেলেড মাসিমি ইতালির অভিবাসন বিষয়ক সংস্থা এএসজিআইতে আইনি পরামর্শদাতার কাজ করেন। তিনি বলেন, ‘সাধারণত এই প্রক্রিয়াটা লাম্পেদুসায় সেরে নেওয়া হয়।’ এছাড়া পোজালো, সিসিলি ও পুলিয়া অঞ্চলের তারান্তোতে রয়েছে এমন হটস্পট।
এই প্রক্রিয়ায় অভিবাসীদের সাক্ষাৎকার নেয় পুলিশকর্মীরা। মাসিমি বোঝান, ‘পুলিশ তাদের নাম, দেশ, ইতালিতে প্রবেশের পথ ও রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার কারণ সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করেন।’
মাসিমির মতে, এই সাক্ষাৎকারটি একজন অভিবাসীর জীবনের ভবিষ্যৎ প্রশাসনিক অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। তিনি বলেন, ‘পুলিশ একজন অভিবাসীর কাছে জানতে চায় যে তারা রাজনৈতিক কারণে আশ্রয় চান, নাকি অর্থনৈতিক কারণে। যদি শুধু অর্থনৈতিক কারণেই অভিবাসন হয়ে থাকে, তার মানে অভিবাসনটি অবৈধ। কিন্তু যদি অভিবাসী রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থনা করে থাকেন, সেক্ষেত্রে আশ্রয়ের আবেদনের কোনো সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত তিনি ইতালিতে থাকতে পারেন।’
Advertisement
এই সাক্ষাৎকারের পর, একজন অভিবাসীর আঙুলের ছাপ নেওয়া হয়। এর ফলে, অভিবাসীরা আপনা থেকেই ডাবলিন পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান, যার মাধ্যমে প্রতিটি রাজনৈতিক আশ্রয় আবেদনের দায় কোনো দেশের ওপর বর্তায়, তা ঠিক করা হয়। এখানে নিবন্ধিত অভিবাসীদের জন্য সেই রাষ্ট্র হবে ‘ইতালি’, যার ফলে এই অভিবাসীরা আর অন্য কোনো দেশে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করতে পারবেন না।
দ্বিতীয় ধাপ: বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইন
করোনা অতিমারির জন্য অভিবাসীদের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইন করতে হচ্ছে। এই কোয়ারেন্টাইনের সময়টি অভিবাসীরা কাটাচ্ছেন ইতালির বিভিন্ন তটবর্তী অঞ্চলে নানা জাহাজের ভেতরে। জাহাজের ভেতর কোয়ারেন্টাইনকালীন দেখভালের দায়িত্বে রয়েছে ইন্টারন্যাশনাল রেডক্রস।
ভূমধ্যসাগর থেকে উদ্ধার হওয়া অভিবাসীরাই যে এই জাহাজে থাকবে, এমনটা নয়। স্লোভেনিয়া থেকে অবৈধভাবে স্থলপথে যে সমস্ত অভিবাসীরা ইাতালিতে প্রবেশ করেছেন, তাদেরও কোয়ারেন্টাইনকাল কাটাতে হয় এই জাহাজগুলোতে।
অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা, যেখানে তাদের কোয়ারেন্টাইনকাল কাটাতে হয় ইতালির মাটিতে তাদের জন্য আলাদা কোয়ারেন্টাইন পরিষেবার ঘরে।
মাসিমি জানান, বর্তমানে চালু স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী, এই কোয়ারেন্টাইনকাল হয় দশ দিন। যদিও সংক্রামিত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসলে আরও দীর্ঘ হতে পারে কোয়ারেন্টিনকাল। তিনি বলেন, ‘কেউ কেউ কোয়ারেন্টাইনে দুই বা তিন সপ্তাহ বা আরও বেশি সময় কাটাতে বাধ্য হন।’
সংক্রমণ নিশ্চিত হলে জাহাজের একটি নির্দিষ্ট এলাকায় আলাদা থাকতে হয় তাদের। প্রয়োজনে তাদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হতে পারে।
কিন্তু জাহাজে পর্যাপ্ত চিকিৎসা পরিষেবা না থাকার অভিযোগ তুলেছে এএসজিআই। কোয়ারেন্টাইনে থাকছেন এমন ৮৬ জন অভিবাসীর সাক্ষাৎকার নেন মাসিমি। সেই সাক্ষাৎকারে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মাসিমি বলেন, ‘অভিবাসীদের অধিকার রয়েছে প্রয়োজনীয় শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসা পাওয়ার। কিন্তু বাস্তবে, এমনটা হচ্ছে না।’ ২০২০ সালের মে থেকে নভেম্বর মাসের মধ্যে এই সাক্ষাৎকারগুলি নেন মাসিমি। কোনো অভিবাসীকেই কোনো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়নি সেই সময়ে।
শেষ ধাপ: অভ্যর্থনা বা প্রত্যর্পণ
ব্যক্তিগত পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে এই ধাপের পর, অভিবাসীদের পাঠানো হয় যে কোনো দুটি গন্তব্যের একটিতে। রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের পাঠানো হয় অভ্যর্থনা কেন্দ্রে, যেখানে তারা শরণার্থী মর্যাদা পেতে এরপরের ধাপ সম্বন্ধে তথ্য পাবেন।
কিন্তু, এই রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের উদ্দেশ্য যদি অন্য কিছু হয় বা তাকে নিরাপত্তা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, সেক্ষেত্রে সেই অভিবাসীদের পাঠানো হয় আটক কেন্দ্রে। সেখান থেকে তাদের পাঠানো হয় ডিপোর্টেশন সেন্টারে, নিজদেশে প্রত্যর্পণের জন্য।
মাসিমি জানান, আটককেন্দ্রে অভিবাসীদের পাঠানোর প্রক্রিয়াটি অনিয়মিত, কারণ যথেষ্ট স্থানের অভাব রয়েছে সেখানে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে, অভিবাসীদের সাতদিনের সময় দেওয়া হয় নিজে থেকেই ইতালি ছেড়ে চলে যেতে।
করোনা অতিমারি ও সীমান্তে বিধিনিষেধের কারণে পারাপার বন্ধ থাকায় গত কয়েক মাসে প্রত্যর্পণের কাজে দেরি হচ্ছে। তবুও, ইতালি তিউনিশিয়ান নাগরিকদের দেশে ফেরত পাঠাতে সক্ষম হয়েছে। এএসজিআই পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০ সালের আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত, মোট দেড় হাজার তিউনিশিয়ান নাগরিককে দেশে ফেরত পাঠিয়েছে ইটালি কর্তৃপক্ষ।
সূত্র: ইনফোমাইগ্রেন্টস
এমআরএম/জেআইএম