২৫ মার্চের গণহত্যার রাত ও ২৬ মার্চকে সামনে রেখে ইউক্রেন প্রশ্নে সঠিক পথে হাঁটলো বাংলাদেশ। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ইউক্রেন ২৪ মার্চ একটি প্রস্তাব আনে। ওই প্রস্তাবে বলা হয়, ইউক্রেনে মানবিক সাহায্য, এবং সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। এবং একমাস আগে ইউক্রেনে রাশিয়া আগ্রাসন চালিয়ে সেখানে যে চরম মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে, তার সমালোচনা করা হয় ওই প্রস্তাবে। ইউক্রেনের এই প্রস্তাবের পক্ষে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ১৯১টি দেশের মধ্যে ১৪০টি দেশ ভোট দিয়েছে। আর এই পক্ষে ভোট দাতা দেশগুলোর ভেতর রয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশসহ এই ১৪০টি দেশ যে সময়ে রাশিয়াকে তার আগ্রাসনের জন্যে কঠোর সমালোচনা করেছে এবং জাসিংঘের মহাসচিব গুতরেজ রাশিয়ার এই যুদ্ধকে তীব্র ভাষায় নিন্দা করে বলেছেন, এ যুদ্ধ সম্পূর্ণ অযৌক্তিক, এবং রাশিয়া সেখানে হাজার হাজার বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করছে। গুতরেসের এই কঠোর অবস্থান ও বাংলাদেশের ইউক্রেনের পক্ষে দাঁড়ানো সত্যিই একবার হলেও বাংলাদেশের যে কোন নাগরিককে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে ১৯৭১। মনে করিয়ে দেবে, সেই দুর্দিনকে। আর সঙ্গে সঙ্গে এটাও মনে করিয়ে দেবে বাংলাদেশ এখনও বঙ্গবন্ধু ও ৭১ নেতাদের সেই ধারায় চলছে। পাকিস্তানপন্থী ব্যবসায়ীরা যতই রাজনীতির ধারে কাছে থাকুক না কেন, বাংলাদেশ তার মৌল আদর্শে আছে।
Advertisement
বাস্তবে বাংলাদেশ ২৪ মার্চ জাতিসংঘে রাশিয়ার এই অন্যায় যুদ্ধও সিভিলিয়ান হত্যার প্রস্তাব সমালোচনা করে সেখানে মানবিক সাহায্য দেবার দাবীর পক্ষে দাঁড়িয়ে শুধু ইউক্রেনের গণহত্যার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়নি। বাংলাদেশ সম্মান জানিয়েছে তার ২৫ মার্চের গণহত্যায় নিহত লাখ লাখ শহীদকেও। বাংলাদেশ প্রমান করেছে শহীদের রক্তে কেনা, গণহত্যায় মায়ের বুকের ওপর পড়ে থাকা শিশুর লাশের দেশ বাংলাদেশ- আর যাই হোক কোন মতেই কোন দেশের গণহত্যাকে সমর্থন করতে পারে না।
দেশ হিসেবে, সামরিক শক্তি হিসেবে সে যতই ছোট হোক, তার নৈতিক অবস্থান অনেক বড়, গণহত্যার ক্ষেত্রে। কারণ, দেশটি এই গণহত্যার রক্তের সাগর পার হয়ে এসেছে। আর ২৫ মার্চের একদিন পরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। পাকিস্তানী আগ্রাসনবাদ বা কলোনি থেকে বের হয়ে এসে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিলো এই ২৬ মার্চ। তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভেতর দিয়ে সোভিয়েত আগ্রাসনের ফলে যে ইউক্রেন স্বাধীনতা হারিয়েছিলো তারা আবার সোভিয়েত পতনের পরে তাদের যে নিজের স্বাধীনতা অর্জন করেছে, সে স্বাধীনতার মর্ম বাংলাদেশ বোঝে। এটা বাংলাদেশের মানুষের মনের অনেক গভীরের বিষয়। তাই পঁচিশ মার্চ ও ২৬ মার্চ সামনে রেখে ২৪ মার্চে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ইউক্রেনের পক্ষে ভোট দিয়ে বাংলাদেশ শুধু ইউক্রেনের স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামকে সম্মানিত ও সমর্থন করেনি। সে তার নিজ দেশের সংগ্রামকেও উর্ধে তুলে ধরেছে।
বাংলাদেশের এই কাজের সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি ধন্যবাদ বাংলাদেশের মানুষ জানাবে বর্তমান জাতিসংঘের মহাসচিবকে। ১৯৭১ সালের স্মৃতি বাংলাদেশের যে সব নাগরিকের মনে আছে, তারা সবাই একযোগে বলবেন, ১৯৭১ এ যদি গুতরেসের মত যদি একজন মহাসচিব থাকতেন জাতিসংঘে, তাহলে বাঙালি অন্তত মানসিক সমর্থনটা শুরু থেকে পেতো।
Advertisement
বাংলাদেশের নির্মম গনহত্যায় সেদিন জাতিসংঘের মহাসচিব- প্রতিবেশী রাষ্ট্র বার্মার নাগরিক, বিশিষ্ট জ্ঞানী ব্যক্তি উথান্ট যেন বধির ছিলেন। বাংলাদেশের মানুষের বুকে তখন উথান্ট নামটি একটি পাথরের শেলের মতো মনে হতো। মনে হতো, এই মানুষটির কি কোন হৃদয় নেই। তিনি কি জাতিসংঘের মহাসচিব হিসেবে কোন নিন্দা করতে পারেন না বাংলাদেশের এ্ই গণহত্যা ও পাকিস্তানী আগ্রাসনকে। বাস্তবে যার হৃদয়ে কষ্টের দাগ থাকে, সেই তো অন্যের কষ্ট বোঝে। তাই ইউক্রেনের জেলনেস্কি’র মানুষগুলোর কষ্ট নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের সিনিয়র সিটিজেন আর যারা ইতিহাস চর্চা করেন তাদেরকে অনেক বেশি আবেগ প্রবণ করে। তাদেরও মনে হয়, যদি বয়স থাকতো, তাহলে তারাও আঁদ্রে মারলো’র অনুকরণে বলতো, আমার বয়স থাকলে আমি ইউক্রেনের মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করতাম। যেমনটি বলেছিলেন মারলো, তাঁর বয়স থাকলে তিনি বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে যুদ্ধ করতেন।
বাস্তবে বিশ্ব রাজনীতির যে পরিবর্তন আসুক না কেন, বাংলাদেশের মত একটি দেশ যে শুধু নিজে তার দেশের মানুষকে রক্ত দিয়ে, আব্রু দিয়ে মুক্ত করেনি, তার সংবিধানের মৌলনীতিতে স্থান দিয়েছে সারা পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে সে থাকবে। এই দেশ কোন মতেই কখনই কোন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নিরব থাকতে পারে না।
১৯৭১ এ ভারত আমাদের বন্ধু ছিল। সে সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জাতিসংঘে ভেটো না দিলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভ কঠিন হয়ে উঠতো। তারপরেও এ সত্য মানতে হবে, সে সোভিয়েত ইউনিয়ন আর বর্তমানের পুতিনের মাফিয়া স্টেট রাশিয়া এক নয়। আর ভারত ১৯৭১ এ যেমন আমাদের বন্ধু তেমনি এখনও বন্ধু, তবে তারপরেও ভারতের মৌলনীতির সঙ্গে আমাদের অনেক পার্থক্য রয়েছে। সর্বোপরি ভারত ধর্মের নামে ভাগ হয়ে স্বাধীনতা পেয়েছে। আর আমাদের স্বাধীনতা রক্তে কেনা। তাই আমাদের ব্যক্তিত্ব, আমাদের অবস্থান, বোধ যতটা সারা পৃথিবীর সাধারণ মানুষের পক্ষে যাবে, ভারতের তা যাবে না।
অন্যদিকে চায়না আমাদের উন্নয়ন সহযোগী। তার মানে এই নয় তাদেরকে আমাদের অনুসরণ করতে হবে। কারণ, তারা বেনিয়া। তারা বেশি সুদে আমাদের সঙ্গে ব্যবসা করে। সারা পৃথিবীতে তাদের এই নীতি। রাশিয়ার এই যুদ্ধ যত দীর্ঘ হবে, রাশিয়ার তেল সহ অনেক সম্পদ চায়না লুটতে পারবে।
Advertisement
তাই চায়না, ভারত কোথায় গেলো এটা বাংলাদেশের বিষয় নয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি সব সময়ই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর ভর করে জাতির পিতা ও ফাউন্ডিং ফার্দাসদের করা কাজকে অনুসরণ করেই করতে হবে। বাংলাদেশ এবার সে পথেই হেঁটেছে। যে কাজে প্রতিটি বাঙালির বুকের ছাতি গর্বে উঁচু হয়ে উঠেছে।
এই ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে পৃথিবীর রাজনীতিতে ভবিষ্যতে, এমনকি নিকট ভবিষ্যতে অর্থাৎ আগামী এক বছরে অনেক পরিবর্তন হবে। প্রতিটি পদক্ষেপেই বাংলাদেশ তার নিজস্ব চরিত্রের ওপর, তার সংবিধানের ওপর সর্বোপরি তার স্বাধীনতা সংগ্রামের মৌল চেতনার ওপর ভর করেই সিদ্ধান্ত নেবে- সকলে এটাই মনে করে। অন্য কোন পথ বাংলাদেশের জন্যে নয়। গত ২ মার্চ রাশিয়ার আগ্রাসনের বিপক্ষে ভোট না দিয়ে, ভোট দেয়ায় বিরত থেকে মূলত বাংলাদেশ ভুল করেছিল। এবারের এই সমর্থন তাকে সেই ভুলের ফাঁদ থেকে বের করে আনলো।
লেখক. সাংবাদিক ও লেখক, সাংবাদিকতায় অবদানের জন্যে একুশে পদক প্রাপ্ত।
এইচআর/এমএস