আন্তর্জাতিক

সাপের প্যাঁচে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি, পর্যটন খাতেও ধস

সাপের প্যাঁচ, বলা বাহুল্য শোনালেও এই রকম জটিলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি। ফলে বড় ধরনের ধাক্কা খাচ্ছে দেশটির পর্যটন খাতও।

Advertisement

৩ বছর আগে, ২০১৯ সালের এপ্রিলে ইস্টার সানডের দিন বোমা হামলার পর শ্রীলঙ্কায় পর্যটকদের সংখ্যা ১৮ শতাংশ কমে গিয়েছিল। ২০২০ সালে এসে আবার করোনার থাবা গ্রাস করে ফেলে পর্যটন খাতকে। ২০২১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত দেশটির পর্যটন খাত ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো লক্ষণই ছিল না। সম্প্রতি দেশটির সরকার কোয়ারেন্টাইনের সব শর্ত তুলে নেওয়া ও দ্বীপ রাষ্ট্রটিতে ভ্যাকসিন নেওয়া পর্যটকদের আকৃষ্ট করার কার্যক্রম শুরু হয়।

দেশটির পর্যটন খাত হলো বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের তৃতীয় বৃহত্তম উৎস। এই খাত সংশ্লিষ্ট কর্মীদের আয় ও পোশাক শিল্পে বড় বিনিয়োগ বৈদেশিক আয়ের অন্যতম উৎস যা সরকারকে দেশ চালাতে সহায়তা করে।

কিন্তু শ্রীলঙ্কা এখন দেশের সবচেয়ে খারাপ আর্থিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। যেখানে লোডশেডিং চরম আকার ধারণ করেছে। জ্বালানি ও রান্নার গ্যাস কেনার জন্য কয়েক কিলোমিটার দূর পর্যন্ত দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছে সাধারণ মানুষ।

Advertisement

চলতি বছর ফেব্রুয়ারিতে দেশটির বাজারে মূল্যস্ফীতি ছিল সাড়ে ১৭ শতাংশ এবং সরকার ঘাটতি বাড়িয়ে আমদানির ওপর তার বিধিনিষেধ আরও কঠোর করেছে। ফলে এসব কারণে কমেছে পর্যটক সংখ্যা। অথচ এই সময় শ্রীলঙ্কা সরকার বিদেশি ঋণ পরিশোধের উপায় খুঁজছে।

ফেব্রুয়ারিতে শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে দেশটির স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেন, আমাদের দ্রুত সমস্যার সমাধান খুঁবে বের করতে হবে। স্বাস্থ্যখাতের পর পর্যটন খাতকেও ঢেলে সাজানোর কথা বলেন তিনি।

বলা চলে বর্তমান পরিস্থিতিতে টাল খাচ্ছে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি। দেশটির দক্ষিণের একটি জনপ্রিয় উপকূলীয় শহর ওয়েলিগামায় একটি রেস্টুরেন্টের মালিক এবং বিদেশি নাগরিক কেট হপকিনসন বলেন, গত কয়েক মাস ধরে ব্যবসা চমৎকারভাবে চলছিল। তবে বিদ্যমান অর্থনৈতিক দুরঅবস্থায় তার ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তিনি বলেন, গ্যাসের তীব্র সংকটের কারণে কালোবাজার থেকে গ্যাস কিনতে হচ্ছে। তা ছাড়া খাদ্যদ্রব্যের দাম আকাশছোঁয়া। খাদ্যপণ্যের কাঁচামাল আমদানি কঠিন হয়ে পড়েছে। আমদানিতে কঠোর বিধিনিষেধের কারণে স্থানীয় বাজারে দাম আরও বেড়ে গেছে।

Advertisement

শুধু হপকিনসনই ভুক্তভোগী নন। রেস্তোরাঁর মালিক রসিকা লাকমল ও লাইফস্টাইল এবং ট্রাভেল অ্যাম্বাসেডর পালোমা মোন্নাপ্পা যিনি জনপ্রিয় উপকূলীয় শহর গালে এবং উনাওয়াতুনাতে পর্যটন ব্যবসা পরিচালনা করেন। তাদের মতো আরও অনেকেই ভুক্তভোগী।

মোনাপ্পা বলেন, তারা প্রতিদিন চার থেকে সাত ঘণ্টার মতো লোডশেডিংয়ের কবলে পড়েন। জ্বালানি সংকটের কারণে মাছ সরবরাহও বন্ধ। অর্থের অভাবে শিপিং কনন্টেইনারও খালাস করা যাচ্ছে না।

তিনি আরও বলেন, প্রতি মূর্হুত তারা সমাধান খোঁজার চেষ্টা করতে গিয়ে আরও সমস্যায় জড়িয়ে পড়ছেন। ডিজেলের অভাবে জেনারেটরও চালাতে পারছেন না। তিনি বলেন, পর্যটকদের জন্য তারা মুখিয়ে আছেন, কিন্তু তারা কিভাবে সার্ভিস দেবেন? মোনাপ্পা বলেন, তার বন্ধুদের অনেকেই বলেন, স্বাধীনতার পর এমন অর্থনৈতিক দুর্যোগের মধ্যে পড়েনি তার দেশ।

ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাবও পড়েছে দেশটির ওপর। শ্রীলঙ্কার পর্যটনের সম্ভাব্য বাজার হলো বাংলাদেশ, ভারত, চীন, যুক্তরাজ্য ও জার্মানি। কিন্তু পর্যটন পুনরায় চালু হওয়ার পর থেকে বহু দর্শনার্থী পূর্বাঞ্চল থেকেও যায় দেশটিতে। রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত পর্যটক সংখ্যা ২৫ শতাংশ ছিল।

পর্যটকদের ভাড়া দেওয়ার জন্য ভিলা সরবরাহের পরিচালক দিমিত্রা ফার্নান্দো বলেন, রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা যেমন সুইফট থেকে লেনদেনে বাদ পড়ার প্রভাবও পড়েছে। যারা ওই অঞ্চল থেকে শ্রীলঙ্কায় গেছেন অনেকেই তাদের কার্ড ডলারে ব্যবহার করতে পারছেন না।

তবে মূল সমস্যাটি শ্রীলঙ্কার নিজস্ব অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে তৈরি হয়েছে। তিনি আরও বলেন, উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাজ্য সরকার শ্রীলঙ্কার জন্য তার ভ্রমণ পরামর্শ আপডেট করেছে এবং যাত্রীদের খাদ্য সংকট ও বিদ্যুৎ বিভ্রাটের বিষয়ে সতর্ক করেছে। ফার্নান্দো আরও বলেছেন, আমরা আটটি ভিলা পরিচালনা করি, কিন্তু এখন আমাদের একটিতেও বুকিং নেই।

শ্রীলঙ্কার পর্যটন খাতে কর্মী সংকটও প্রকট আকার ধারণ করেছে। করোনার কারণে এমনিতেই কর্মী সংখ্যা কমে গেছে। পর্যটন খাতের দক্ষতাবিষয়ক কমিটির প্রধান মালিক ফার্নান্দো বলেন, আগামী তিন বছরের মধ্যে দেশে আরও এক লাখ কর্মী প্রয়োজন। যেখানে প্রতিবছর এখন ১০ হাজার কর্মীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।

সূত্র: আল-জাজিরা

এসএনআর/জিকেএস