নওগাঁর আত্রাই উপজেলার ভোঁপাড়া ইউনিয়নে ভড়মাধাইমুড়ি গ্রাম। দুইবছর আগেও বন্যা ও শুষ্ক মৌসুমে গ্রামটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো মনে হতো। ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় গ্রামের মানুষের দুর্ভোগের যেন শেষ ছিল না। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বিয়ে দিতে বা আত্মীয়তা করতে চাইতেন না অন্য গ্রামের লোকজন। কাদাপানি মাড়িয়ে ও রেল লাইনের পাশ দিয়ে হেঁটে চলাচল করতে হতো গ্রামবাসীদের। উৎপাদিত পণ্য হাট-বাজারে ঠিক সময়ে নিয়ে যেতে না পারায় ন্যায্য দাম পাওয়া থেকেও বঞ্চিত হতে হতো। তবে নওগাঁ-নাটোর আঞ্চলিক মহাসড়ক নির্মাণ হওয়ায় বর্তমানে গ্রামটির চিত্র পাল্টে গেছে।
Advertisement
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি বছরের জুনের মধ্যে এই আঞ্চলিক মহাসড়কটির নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। কাজ সম্পন্ন হলে নওগাঁ, নাটোর ও পাবনা জেলার ছয় উপজেলার মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থার যেমন উন্নয়ন ঘটবে পাশাপাশি আর্থসামাজিক উন্নয়ন তরান্বিত হবে। রাজধানী ঢাকার সঙ্গে নওগাঁর দূরত্ব প্রায় ৪৮ কিলোমিটার কমবে। সেইসঙ্গে সময় বাঁচবে প্রায় দেড় ঘণ্টা। তবে নির্ধারিত সময়ে নওগাঁর অংশের কাজ শেষ হলেও নাটোর জেলার অংশের কাজ শেষ হবে কি না তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। দ্রুত সড়কটির কাজ শেষ করে চলাচলের উপযোগী করার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
ভড়মাধাইমুড়ি গ্রামের ৭০ বছরের বৃদ্ধ আব্দুস সাত্তার বলেন, এ গ্রামে ৩৫০ পরিবার বসবাস করে। যেখানে জনসংখ্যা প্রায় ৩ হাজার। এর মধ্যে ভোটার সংখ্যা ৬০০ জন। এক সময় কাদাপানি ভেঙে কাঁধে করে ফসল হাটে-বাজারে নিয়ে যেতে হতো। এছাড়া কেউ অসুস্থ হলে দরজার পাল্লা বা বাঁশের চাটায়ে তুলে কাঁধে করে নিয়ে যেতে হতো প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে আত্রাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। এখন আল্লাহর রহমতে আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হয়েছে। গ্রামের পাশ দিয়ে নওগাঁ-নাটোর সড়ক হয়েছে।
একই গ্রামের আব্দুস সালাম বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমাদের আশপাশের গ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থার অনেক উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু আমাদের গ্রামটি ছিল অবহেলিত এবং বিচ্ছিন্ন। ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য হাটে-বাজারে যাওয়া এবং আত্মীয়তার ক্ষেত্রেও কষ্টকর ছিল। গ্রাম থেকে বেরিয়ে গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া রেললাইনের ওপর দিয়ে হেঁটে এবং বন্যার সময় নৌকায় করে চলাচল করতে হতো। যে ভোগান্তি আমাদের পোহাতে হয়েছে তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। এখন নওগাঁ-নাটোর সড়কটির কাজ শেষ হলে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হবে।
Advertisement
নওগাঁ সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ সূত্রে জানা যায়, নওগাঁ-আত্রাই-নাটোর মহাসড়কের জন্য ২০০৫ সালে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ৯৮ কোটি টাকার প্রকল্প উন্নয়ন প্রস্তাব (ডিপিপি) অনুমোদন দেয়। কিন্তু পরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) প্রকল্পটি সীমিত করে ৫০ কোটি টাকার অনুমোদন দেয়। ওই বছরের ২৮ ডিসেম্বর সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া নাটোরের নলডাঙ্গায় নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করেন। এই অর্থায়নে ২০০৭ সালের জুন পর্যন্ত নওগাঁ-সান্তাহার রোডের ঢাকার মোড় থেকে নাটোরের নলডাঙ্গা পর্যন্ত সাড়ে ৪৮ কিলোমিটার রাস্তার মাটি ভরাটের কাজ শেষ হয়। মহাসড়কের নওগাঁ অংশের ২৬ কিলোমিটারের মধ্যে মাত্র সাড়ে সাত কিলোমিটার রাস্তা পাকা হয়। আর নাটোর অংশের সাড়ে ২২ কিলোমিটার রাস্তার মধ্যে ১৬ কিলোমিটার রাস্তা পাকা হয়। নতুন করে অর্থায়ন না হওয়ায় মোট ২৩ কিলোমিটার রাস্তা পাকা হওয়ার পর হাইড্রোলজি সমীক্ষার নামে বন্ধ হয়ে যায় সড়কটির নির্মাণ কাজ। সড়কটি পাকাকরণ না হওয়ায় বাকি সাড়ে ২৫ কিলোমিটার রাস্তা গোচারণভূমিতে পরিণত হয়েছিল। নওগাঁবাসীকে নাটোর যেতে হলে রাজশাহী অথবা বগুড়া দিয়ে ঘুরে যেতে হতো।
এরপর ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে নওগাঁ-আত্রাই-নাটোর আঞ্চলিক মহাসড়কের নির্মাণ কাজ একনেকে অনুমোদনের পর আটটি ব্রিজ ও ১৫টি ছোট-বড় কার্লভার্টসহ সাড়ে ২৫ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২০১ কোটি ২৯ লাখ টাকা। সড়ক ও জনপথ বিভাগ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে রাস্তাটির অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে চলেছে।
সড়কটির নির্মাণ কাজ শেষ হলে বগুড়া জেলার আদমদিঘী, নওগাঁ জেলার নওগাঁ সদর, রানীনগর ও আত্রাই এবং নাটোর জেলার নলডাঙ্গা ও সদর উপজেলার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপিত হবে। যার ফলে বদল যাবে এই এলাকার সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান। এলাকায় উৎপাদিত প্রধান ফসল ধানের তেমন মূল্য পান না কৃষকরা। এই সড়কের নির্মাণ কাজ শেষ হলে এখানকার উৎপাদিত ফসলাদি কৃষকরা ন্যায্য মূল্য পাবেন।
এলাকাবাসী জানিয়েছেন, আগে প্রায় ৫১ কিলোমিটার বেশি পথ ঘুরে সড়ক পথে নওগাঁ থেকে রাজশাহী অথবা বগুড়া হয়ে নাটোর যেতে হতো। সড়কটির নির্মাণ কাজ শেষ হলে রেলপথ ছাড়াও নওগাঁ থেকে সহজেই রানীনগর, আত্রাই হয়ে মাত্র এক ঘণ্টা সময়ের মধ্যে নাটোর যাওয়া সম্ভব হবে। এছাড়া নাটোর-বনপাড়া-হাটিকুমরুল মোড় হয়ে সোজা ঢাকা যাওয়া সম্ভব হবে। এতে নওগাঁর সঙ্গে ঢাকার দূরত্ব প্রায় ৪৮ কিলোমিটার কমে যাবে।
Advertisement
আত্রাই উপজেলার মহাদিঘী গ্রামের কৃষক সাইদুর রহমান বলেন, ২৫ বছর হেঁটে চলাচল করতে হয়েছে। বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আধাঘণ্টা হাঁটার পর রাস্তায় উঠে উপজেলা সদরে যেতে হতো। হাট-বাজারে ধানের দাম ৮০০-৯০০ টাকা হলে আমরা বাড়ি থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি করতাম। ব্যবসায়ীরা গ্রামে আসতে না চাওয়ায় কম দামে বিক্রি করতে হতো।
তিনি আরও বলেন, এখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে ৩০০ ফুট দূরে রাস্তায় দাঁড়ালেই যানবাহন পাওয়া যায়। ফসলের দামও ঠিকমতো পাওয়া যাচ্ছে।
শিমুলিয়া গ্রামের ব্যাটারিচালিত ভ্যানচালক হেলাল উদ্দিন বলেন, কিছুদিন আগেও ভ্যান নিয়ে আত্রাই যাওয়া যেত না। এলাকার আশপাশে ভ্যান চালাতাম। এতে দিনে ২০০-২৫০ টাকা ভাড়া পেতাম। বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার দূরে নওগাঁ-নাটোর সড়ক হয়েছে। এখন ভাড়া নিয়ে আত্রাই যাওয়া সহজ হয়। এতে ভাড়া হয় ৪৫০-৫০০ টাকা। চলাচল অনেক সহজ হয়েছে।
নওগাঁ সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাজেদুর রহমান বলেন, রাস্তার নির্মাণ কাজের প্রায় ৮৫ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। চলতি বছরের জুন মাসের মধ্যে নওগাঁর সীমানার মধ্যে প্রকল্পটির কাজ সম্পন্ন হওয়ার কথা। তবে নাটোর জেলার নলডাঙ্গা থানার বীরকুটশা থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার রাস্তার কাজ পিছিয়ে থাকায় কিছু সমস্যা হচ্ছে। রানীনগর থেকে শুরু করে আত্রাই উপজেলার পাঁচুপুর ইউনিয়নে থাঔপাড়া পর্যন্ত কাজ প্রায় শেষ। তারপরের অংশে সমস্যা।
নাটোর সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবদুর রহিম বলেন, নওগাঁর আত্রাইয়ের পর নাটোর জেলা যেখান থেকে শুরু হয়েছে সেখান থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার জমি রেলওয়ের মধ্যে পড়েছে। যা সড়ক ও জনপথের জমি না। এটা নিয়ে কিছু সমস্যা চিহ্নিত করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
তিনি বলেন, বর্তমানে রাস্তার কাজ চলমান আছে। মাটির রাস্তার সংযোগের কাজ অনেক আগেই শেষ হয়েছে। এছাড়া খোয়ার কাজ শেষ হয়েছে। শুধু রাস্তার কার্পেটিং বা পাকাকরণের কাজ বাকি আছে। তবে আশা করা যায়, নির্ধারিত সময় জুনের মধ্যে কাজ শেষ হবে। যদি শেষ না হয় সেটা পরে দেখা যাবে।
নওগাঁ-৬ (আত্রাই-রানীনগর) আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ার হোসেন হেলাল বলেন, কোনো এলাকার আর্থসামাজিক উন্নয়নের মূল বিষয় হচ্ছে সেখানকার রাস্তাঘাট বা যোগাযোগমাধ্যম। এই রাস্তাটি সম্পন্ন হলে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানাবিধ উন্নয়নের প্রসার ঘটবে। কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্য স্বল্পসময়ে বাজারজাত করাসহ লাভবান হতে পারবেন। এছাড়া রানীনগর-আত্রাইয়ের মানুষ অল্প খরচে এবং কম সময়ে নাটোর হয়ে ঢাকায় যেতে পারবেন।
তিনি আরও বলেন, তবে রাস্তার কিছু কাজ বাকি থাকায় হয়তো নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ হবে না। দ্রুত সমস্যা সমাধান করে সড়কটি চলাচলের উপযোগী করতে কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।
এমআরআর/জেআইএম