ওরে হল্লার রাজার সেনা তোরা যুদ্ধ করে করবি কী তা বলমিথ্যে অস্ত্র শস্ত্র ধরে প্রাণটা গেল যায় বেঘরেরাজ্যে রাজ্যে পরস্পরে দ্বন্দ্বে অমঙ্গলতোরা যুদ্ধ করে করবি তা বল।
Advertisement
সত্যজিৎ রায়ের ‘গুপী গাইন ও বাঘা বাইন’ সিনেমার এই গানে যে প্রশ্ন ছোড়া হয়েছে; তা সব সময়ই সমকালীন। সাংবাদিকরা যুদ্ধের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে সংবাদ তৈরি করেন। বিশ্লেষণ করেন সার্বিক পরিস্থিতি। কিন্তু গুপী ও বাঘার মতো ভূতের রাজার বর তাদের নেই। যুদ্ধকালীন তাদের প্রশ্ন শোনারও কেউ নেই। বরং যুদ্ধে নিহতের সংখ্যায় তাদেরও নাম ওঠে বারবার।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৯ সালে জেনেভা কনভেনশনে যুদ্ধবন্দি, আহতদের সেবা পাওয়ার অধিকার ও বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষার সবিস্তারে বলা হয়। যুদ্ধকালীন বেসামরিক নাগরিকদের যে সুরক্ষা সেটির আইনি ভিত্তি পেতে সংবাদকর্মীদের অপেক্ষা করতে হয় আরও ১৮ বছর।
১৯৭৭ সালে জেনেভা কনভেনশনের প্রথম প্রটোকলে ৭৯ নম্বর ধারায় এই আইনি সুরক্ষা পান সংবাদকর্মীরা। যাতে বলা হয়েছে, যে রাষ্ট্র বা অঞ্চলে সংবাদকর্মী থাকেন সেখানকার কর্তৃপক্ষের বা যে প্রতিষ্ঠানের অধীনে কাজ করেন, সেই কর্তৃপক্ষের স্বাক্ষরিত পরিচয়পত্র বহন করতে হবে তাকে।
Advertisement
তবে জেনেভা কনভেনশনের প্রথম প্রটোকলের এই আইনি সুরক্ষা কি সংবাদকর্মীর জীবন বাঁচাতে পারছে। মার্কিন নারী সাংবাদিক ম্যারি ক্যাথরিন কলভিনের কথাই বলি। চেচনিয়া, সার্বিয়া, সিয়েরা লিওন, জিম্বাবুয়ে, শ্রীলঙ্কা ও পূর্ব তীমুরে গৃহযুদ্ধের খবর বিশ্ববাসীকে জানিয়েছেন তিনি। কিন্তু ২০১২ সালে সিরিয়ার হোমসে গোলার আঘাতে নিহত কলভিন। রিপোর্টার্স উইথাউট বর্ডার্সের তথ্য মতে, ২০১১ সাল থেকে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ায় ৩শ’র বেশি সংবাদকর্মী নিহত হয়েছেন।
২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে প্রাণ হারান ১৫ জন সংবাদকর্মী। কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টের তথ্য বলছে, তিন দশকে আফগান যুদ্ধের খবর সংগ্রহে ৫৫ সংবাদকর্মী মারা গেছেন। পেশাগত দায়িত্বপালনে অনেকেই নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এসব যুদ্ধের খবর সংগ্রহে গিয়ে কেউ কেউ গুমের পর হত্যার শিকার হয়েছেন।
জীবনের এত ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধকালীন যে সব খবর সংগ্রহ করছেন সাংবাদিকরা, তা নিয়েও ব্যাপক সমালোচনা আছে। এর কিছু তাত্ত্বিক আর কিছু ব্যবহারিক। প্রথমেই আসি তাত্ত্বিক আলোচনায়। যুদ্ধকালীন সাংবাদিকতায় লড়াইয়ের তথ্য, হতাহতের সংখ্যা, ঘটনার নানা বর্ণনা সবিস্তারে দেওয়ার চেষ্টা করেন সাংবাদিকরা। কিন্তু, তাত্ত্বিকরা বলছেন এটি যুদ্ধের প্রতি এক ধরনের পক্ষপাত। এর বিপরীতে শান্তি সাংবাদিকতার কথা বলেন তারা।
এ তত্ত্বের জনক নরওয়েজিয়ান সমাজতাত্ত্বিক জোহান ভিনসেন্ট গ্যালটাং। তিনি শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়নেরও পথিকৃৎ। তার মতে, যুদ্ধের বর্ণনার চেয়ে এর কারণ খুঁজে বের করার দিকে জোর দিতে হবে। জোর দিতে হবে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কারণের দিকে। দুপক্ষ কেন লড়াইয়ে সেটি প্রকাশের চেষ্টা করবেন সাংবাদিক। যুদ্ধের পরিবর্তে কী কী অহিংস পদ্ধতিতে দ্বন্দ্বের সমাধান হতে পারে, সেদিকে মনোযোগ দেওয়া এবং সে সম্পর্কে প্রতিবেদন তৈরি করা। তাত্ত্বিক এই বিশ্লেষণ সুন্দর ও অনুপম। তবে বাস্তবায়ন খুবই কঠিন।
Advertisement
এবার আসি ব্যবহারিক বিষয়ে। প্রতি যুদ্ধেই থাকে নানা স্বার্থবাদী শক্তি। যে সব গণমাধ্যম ওই স্বার্থবাদীদের হাতে থাকে, তাদের মতো করেই যুদ্ধের বর্ণনা ও শব্দ চয়ন হয়। যেমন- বর্তমান ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে রুশ আগ্রাসন। বিবেক ও তথ্যউপাত্ত এই তথ্যকেই প্রশ্রয় দেয়। কিন্তু রুশ ও তাদের মিত্র গণমাধ্যমে একে বলা হচ্ছে, ইউক্রেনে অস্ত্রের ঝনঝনানি বন্ধে রাশিয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টা। যেখানে যুদ্ধের সব দায় পশ্চিমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে পুতিন সাধু-সন্ন্যাসীদের তালিকায় স্থান দিতে মরিয়া তারা। আমরা যদি কিছু বছর পেছনে ফিরে যাই, তাহলে রুশ গণমাধ্যমের মতোই মুখোশ পরা দেখতে পাবো পশ্চিমাদের।
লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সাংবাদিকতা অধ্যয়নের নেতা এবং বিবিসির সাবেক লেবানন সংবাদদাতা জাহেরা হার্ব বলছেন, ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর হামলাকে আগ্রাসন ও ইউক্রেনীয়দের পাল্টা জবাবকে প্রতিরোধ আখ্যা দিয়েছে পশ্চিমা গণমাধ্যম। অথচ লেবানে ইসরায়েলের আক্রমণের সময় এই বিবেকের তাড়না ছিল না পশ্চিমা গণমাধ্যমের। বরং তখন বস্তুনিষ্ঠতা ও ফ্যাক্টের দোহাই দিয়ে এ শব্দকে এড়িয়ে গেছে তারা। ইরাক এবং আফগানিস্তান যুদ্ধেও একই ভূমিকা ছিল তাদের। নিজেদের প্রয়োজনের সময়ই কেবল তারা বিবেকপ্রসূত সাংবাদিকতার চর্চার পক্ষে। বাকি সময় বিপক্ষে। তখন স্বার্থবাদীদের পক্ষেই সরব থাকে পশ্চিমা গণমাধ্যম।
লেখক: বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল ২৪।
এইচআর/এএসএম