আন্তর্জাতিক অঙ্গনের চলমান সংঘাত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শরণার্থী পরিস্থিতির উপর ক্রমাগত চাপ বাড়িয়েই চলছে। রোহিঙ্গা সমস্যা চলমান থাকতেই এর সাথে আফগান ও সাম্প্রতিক ইউক্রেন সংকট যুক্ত হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ইউরোপের শান্ত পরিস্থিতিকে অশান্ত করে তুলেছে। তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এরই মধ্য একের পর এক ইউক্রেনীয় শহর দখলের জন্য আক্রমণ পরিচালনা করছে রাশিয়া। ফলে দেশ ছেড়ে ইউক্রেনীয়রা পালিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে।
Advertisement
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) ভাষ্য অনুসারে ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা শুরুর পর এ পর্যন্ত ২৫ লাখের বেশি মানুষ ইউক্রেন ছেড়েছে। মার্চের প্রথম সপ্তাহে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি জানিয়েছিলেন যে তখন পর্যন্ত ২০ লাখ মানুষ ইউক্রেন ছেড়েছিল।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর জানিয়েছে, ১৫ মার্চ ২০২১ পর্যন্ত ২৯ লাখ ৭০ হাজার মানুষ প্রাণ বাঁচাতে বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। যাদের অর্ধেকের বেশি প্রায় ১৮ লাখ, পোল্যান্ডে আশ্রয় নিয়েছেন। ইউএনএইচসিআর আশঙ্কা করছে, রাশিয়া যদি বেসামরিক লোকজনের ওপর হামলা অব্যাহত রাখে, তাহলে এ সংখ্যা ৪০ লাখে পৌঁছাবে। তারা আরও জানিয়েছে যে অন্তত ১৪ লাখ শিশু ইউরোপের দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে। অর্থাৎ এই সময়ের মধ্যে প্রতি সেকেন্ডে ইউক্রেনের একটি শিশু শরণার্থী হয়েছে।
বর্তমানে ইউক্রেন থেকে পালিয়ে আসা ২৫ মিলিয়ন শরণার্থী পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে। তারা ইউরোপীয়, তাই প্রতিবেশী দেশগুলো তাদের সাদরে নিজেদের দেশে স্বাগত জানিয়েছে। দেশগুলো তাদের অভ্যর্থনার জন্য পূর্বপ্রস্তুতির পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে আগতদের জন্য প্রস্তুত ছিল। অন্যান্য যুদ্ধ পীড়িত দেশের উদ্বাস্তুদের মতো ইউক্রেনীয়রাও আক্রমণের মুখে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে এবং প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে।
Advertisement
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পশ্চিমা বিশ্বের শান্তি ও গণতন্ত্র স্থাপনের জন্য চালানো অভিযানগুলোর ফলে যেসব দেশ প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, সে সব দেশ থেকে যারা প্রাণ নিয়ে পালাতে পেরেছে তারা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় চেয়েছে। অনেক দেশ ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া ইত্যাদি দেশের শরণার্থীদের জন্য তাদের দেশের সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে এবং অনেক দেশে শরণার্থীরা মানবেতর জীবন যাপন করছে। ইউক্রেনের শরণার্থীরা এই ক্ষেত্রে সৌভাগ্যবান, তারা ইউরোপের দেশগুলোতে সম্মানের সাথে থাকার সুযোগ পেয়েছে।
ইইউ জানিয়েছে, বর্তমানে ২.৫ মিলিয়নেরও বেশি শরণার্থী ইউক্রেন থেকে পালিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছে। এর মধ্যে পোল্যান্ডে ১.৪ মিলিয়ন, হাঙ্গেরী ০.২ মিলিয়ন, স্লোভাকিয়া ০.১৬৫ মিলিয়ন, রাশিয়া ৯৭ হাজার, রোমানিয়া ৮৫ হাজার, মলদোভা ৮৩ হাজার, বেলারুশে ৭৬৫ জন আশ্রয় নিয়েছে। ইইউ এসব দেশগুলোকে অর্থ সাহায্য দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ৩ মার্চ ইউরোপীয় ইউনিয়ন সর্বসম্মতভাবে সাময়িক একটি নির্দেশনা দিয়েছে। এতে ইইউভুক্ত দেশগুলোতে ইউক্রেনীয়দের জন্য কাজের অনুমতি, আবাসন ও চিকিৎসা–সুবিধার কথা বলা হয়েছে। আগামী এক থেকে তিন বছর পর্যন্ত ইউক্রেনের নাগরিকরা এসব সুবিধা পাবেন।
পোল্যান্ড জানিয়েছে, ইইউ তাদের যে অর্থ প্রদানের কথা বলেছে তার চেয়ে বেশি অর্থ তাদের লাগবে কারণ বর্তমানে এক মিলিয়নের বেষি শরণার্থী তাদের দেশে আশ্রয় নিয়েছে। চেক রিপাবলিক ইউক্রেনীয়দের বিশেষ ভিসা দেওয়ার কথা বলেছে, গ্রিস ও জার্মানি তাদের জন্য তাঁবু ও কম্বল পাঠাচ্ছে, স্লোভাকিয়া এবং ফ্রান্স ওষুধ ও মেডিকেল সামগ্রী পাঠাচ্ছে পোল্যান্ডে। ইউকে তাদের নাগরিকদের ইউক্রেনীয়দের আশ্রয় দেওয়ার জন্য দেশবাসীকে অনুরোধ জানিয়েছে। এক কথায় সমগ্র ইউরোপ এগিয়ে এসেছে তাদের সাহায্যের জন্য।
এর আগে আফগানিস্তানে গণতন্ত্র ও শান্তি ফিরিয়ে আনার কার্যক্রম শেষ করে গত বছর (২০২১) আগস্ট মাসে আমেরিকা আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যায় এবং এর পরপরই সে দেশে মানবিক সংকটের সৃষ্টি হয়। এর কিছু আগে থেকে অর্থাৎ মে ২০২১ থেকে প্রায় ২,৪০,০০০ আফগান তাদের নিজ দেশের ভেতর বাস্তুচ্যুত অবস্থায় রয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, প্রায় ২.৬ মিলিয়ন রেজিস্টার্ড আফগান শরণার্থী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়ে আছে এবং এটা বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম শরণার্থী সংকট।
Advertisement
এ সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার চার বছর আগে ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে প্রাণভয়ে ৭ লাখ ৫০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করে। বর্তমানে বাংলাদেশে ১.১ মিলিয়ন রোহিঙ্গা গত চার বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থান করছে। এর মধ্যে ভাসানচরে কিছু রোহিঙ্গা পরিবারকে স্থানান্তর করা হয়েছে এবং এই প্রক্রিয়া চলমান।
এই সংকট মোকাবিলায় ২০২১ সালের রেসপন্স প্লান অনুসারে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলার জন্য মোট চাহিদা ছিল ৯৪৩.১ মিলিয়ন ইউএস ডলার, এর মধ্যে পরিকল্পনা অনুযায়ী ৭১.৫ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ পাওয়া গেছে এবং বাকি ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের জন্য মোট ৭৪৬.২ মিলিয়ন ডলার এসেছে, যার মধ্যে ৬৭৪.৫ মিলিয়ন এসেছে উপরের প্লান থেকে এবং ৭১.৭ মিলিয়ন অন্যান্য উৎস থেকে।
বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের সহায়তা প্রদানে প্রথমদিকে আছে আমেরিকা, ইউকে এবং ইইউ। ইউক্রেন যুদ্ধে আমেরিকা সরাসরি সাহায্য না করলেও ন্যাটোর মাধ্যমে সামরিক সরঞ্জাম পাঠাচ্ছে, ইইউ শরণার্থীদের জন্য অর্থ সাহায্য দিচ্ছে। এই যুদ্ধ যদি দীর্ঘ মেয়াদি হয় তাহলে অন্যান্য দেশ থেকে এখাতে প্রাপ্ত সাহায্যের পরিমাণ কমে আসতে বাধ্য।
এর প্রভাব যেন বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের চলমান কার্যক্রমের ওপর প্রভাব না ফেলে সেজন্য আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। ২০২২ সালের ইউরোপের এই সংকটে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান এবং রোহিঙ্গাদের এদেশে অবস্থানকালীন আর্থিক এবং মানবিক সহায়তা যেন কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় তার জন্য জোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
রোহিঙ্গা সংকট বর্তমানে স্বল্প মেয়াদি সংকট থেকে মধ্য মেয়াদি সংকটে উত্তরণের পথে রয়েছে। এ সংকট মোকাবিলায় আপতকালীন তৎপরতা ও সক্ষমতা অর্জন এবং সেজন্য সমন্বয়পূর্বক জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। সংকট সমাধানের পূর্ব পর্যন্ত খাদ্য, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, দুর্যোগ মোকাবিলা ও অন্যান্য খাত চলমান রাখতে হলে এখন থেকেই টেকসই পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়নে সচেষ্ট হতে হবে।
মিয়ানমার সরকার, সেনাবাহিনী, বৌদ্ধ ভিক্ষু সংগঠন, আরাকানের রাজনৈতিক দল সুশীল সমাজের সাথে ব্যবধান ঘুচিয়ে আন্তরিক পরিবেশ ও আস্থার জায়গা তৈরি করতে হবে। মিয়ানমারের সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান নে উইনের বাংলাদেশ সফরের সময় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে সুন্দর সম্পর্কের সূচনা করেছিলেন তার ধারাবাহিকতা ফিরিয়ে আনার দরকার এখনই।
নিয়মিত যোগাযোগ স্থাপন, ইন্টারনেট ও অন্যান্য প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে এ যোগাযোগ স্থাপন করার জন্য সরকারি, বেসরকারি, স্থানীয় এবং ব্যবসায়িক পর্যায়ে উদ্যোগ নিতে হবে। আরাকানের স্থানীয় পণ্য বিপণন, চিকিৎসা খাত ও অন্যান্য বিষয়াদি খুব সহজেই নাফ নদীর এপারে বাংলাদেশের সাথে সমন্বয় সম্ভব এবং এতে তারা উপকৃত হবে এবং এই অঞ্চলের জীবন মানের উন্নয়ন ঘটবে। এসব বিষয়াদির প্রচার খুব কমই হয়েছে বা আদৌ হয়নি, তা করার জন্য সরকারি ও সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে এসব বিষয়ে ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।
বর্তমানে মিয়ানমারে চলমান গৃহযুদ্ধের প্রভাব আরাকানে নেই বললেই চলে, তাই এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থা ও আরাকানের রাজনৈতিক দলগুলোকে সাথে নিয়ে সবার সদিচ্ছা কাজে লাগিয়ে নিয়মিত আলোচনা ও যোগাযোগের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য উপযুক্ত ক্ষেত্র প্রস্তুত করা যেতে পারে। পশ্চিমা দেশগুলোর পাশাপাশি ওআইসিভুক্ত এবং অন্যান্য দেশ নিয়মিত যোগাযোগের মাধ্যমে চলমান সমস্যা সমাধানের জন্য তাদের মানবিক, আর্থিক ও নৈতিক সমর্থন জোরদারের অনুরোধ করতে হবে।
আসিয়ান দেশগুলো এবং জাপানের সহযোগিতা আরও বাড়ানোর বিষয়ে চেষ্টা নেয়া যেতে পারে। দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো এ বিষয়ে কিছুটা অবগত, (আর্জেন্টিনা থেকে একটা মামলা দায়ের করা হয়েছিল), অন্যান্য লাতিন আমেরিকান দেশে ও এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। বিদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা নেতারা এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে পারেন।
বিভিন্ন দেশের প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সেসব দেশের ভাষায় রোহিঙ্গা সমস্যা সংক্রান্ত আপডেট নিয়মিত প্রকাশ করে এই সংকট মোকাবিলায় নেওয়া চলমান পদক্ষেপগুলো বহাল রেখে দ্রুত সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় নিয়মিত বিরতিতে রোহিঙ্গা সংকট ও প্রত্যাবাসনের বিষয়ে বিভিন্ন ভাষায় প্রচারণার ব্যবস্থা করতে হবে। বর্তমানে চলমান সংকট দ্রুত সমাধান হয়ে পৃথিবী সবার জন্য বাসযোগ্য শান্তির আবাস হোক এটাই সবার কাম্য।
লেখক: এনডিসি, এএফডব্লিউসি, পিএসসি, এমফিল, মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক।
এইচআর/ফারুক/এমএস