দেশজুড়ে

জমে উঠেছে ৫০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী একমাত্র ঘোড়ার মেলা

জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম গোপীনাথপুর। দোল পূর্ণিমা থেকে প্রায় মাসব্যাপী চলে ঐতিহ্যবাহী গোপীনাথপুর মেলা। করোনার কারণে গত দুই বছর মেলা বন্ধ থাকলেও এ বছর উৎসবমুখর পরিবেশে মেলা বসেছে। এরইমধ্যে সেখানে জমে উঠেছে ঘোড়ার মেলা।

Advertisement

দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ঘোড়া কেনা-বেচা হয় এ মেলায়। ঘোড়ার দৌড় দেখার জন্য ভিড় জমায় উৎসুক জনতা। মাসব্যাপী মেলা চললেও ঘোড়া ও পশুর মেলা চলে ১০-১৫ দিন অথবা ক্রেতা-বিক্রেতার চাহিদা অনুপাতে।

মেলায় মেলে বাহাদুর, তাজিয়া, বিজলি, কিরণমালা, রাজা, রানি, সুইটি ছাড়াও দেশি-বিদেশি বাহারি নামের ঘোড়ার দেখা মেলে। ক্ষিপ্রতা আর বুদ্ধিমত্তায় মেলে ওদের নামের স্বার্থকতা। ঘোড়াগুলোর চলনে বিদ্যুৎ গতি, চোখের পলকে মাইল পার হওয়ায় জুড়ি নেই। প্রাচীনকালের অভিজাত শ্রেণির মানুষদের কাছে ঘোড়ার প্রচণ্ড কদর থাকলেও আজও যেন কমতি নেই সৌখিন ঘোড় সওয়ারীদের কাছে।

এবারের মেলায় ঘোড়ার হাটে প্রতিদিন উঠছে প্রায় দুই হাজারেরও বেশি ঘোড়া। প্রতিদিন বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন জাতের শতাধিক ঘোড়া।

Advertisement

প্রায় সাড়ে ৫শ’ বছরের পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী এ মেলায় আসেন আশপাশসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লাখ লাখ দর্শনার্থী। বিনোদনের সব আয়োজন ছাড়াও ঘোড়াসহ গরু-মহিষের বিরাট বাজার, শিশুদের খেলনা, মৃত্যুকূপ মোটরযান খেলা, হরেক রকমের মিঠাই-মণ্ডা আর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর পসরা সাজিয়ে রাখেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা দোকানি ও ব্যবসায়ীরা। মানুষের উপচেপড়া ভিড় থাকে দিন-রাত সব সময়।

জনশ্রুতি ও ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রায় সাড়ে ৫শ বছর আগে ১৪৯২ থেকে ১৫৩৫ খ্রিষ্টাব্দের শাসক নবাব আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্ গোপীনাথপুরে বেড়াতে আসেন। তখন এখানে নন্দিনী প্রিয়া নামে এক সাধকের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে নবাব ওই সাধককে প্রায় ৬০৪ একর জমি লাখেরাজ দান করে দিয়ে যান, যার উৎস থেকে প্রতি বছর দোলযাত্রা ও মেলা উৎসব চলে আসছে।

এটিই দেশের একমাত্র ঘোড়া কেনা-বেচার হাট বলে দাবি আয়োজকদের। এ কারণে সারাদেশ থেকে আনা কয়েক হাজার ঘোড়া জড়ো করা হয় এখানে। এটিকে ঘোড়ার মিলনমেলাও বলা যেতে পারে। বাহারি নাম ও দামের দেশি-বিদেশি ঘোড়া এ হাটে বেচা-কেনা চলছে ধুমধামের সঙ্গে।

এবারের মেলায় ঘোড়ার আমদানি কিছুটা বেশি হওয়ায় চাহিদামতো দাম না পেলেও অল্প লাভে বেশ সন্তুষ্ট ঘোড়া পালনকারী ও মালিকরা। তবে আগের তুলনায় ঘোড়া বাজারের স্থান সংকুচিত হওয়ায় ও সৌখিন ঘোড়া ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে ঘোড় দৌড়ের মাঠ না থাকায় খানিকটা অসুবিধায় পড়েছেন বিক্রেতারা।

Advertisement

ক্রেতা-বিক্রেতা ও দর্শনার্থীদের পদচারণায় এখন মুখর ঐতিহ্যবাহী গোপীনাথ মেলার ঘোড়ার হাট। একটি খেলার মাঠে ঘোড়া নিয়ে ক্রেতাকে দেখানো হয় ঘোড়ার দৌড়। তারপরই হয় দরদাম ঠিকঠাকের ব্যাপার।

দোল পূর্ণিমা মেলা কমিটির আয়োজকরা জানান, ৫০০ বছরের পুরনো এ মেলা শুরু থেকেই ঘোড়ার জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। স্বাধীনতার পরও মেলায় নেপাল, ভুটান, ভারত, পাকিস্তানসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে উন্নত জাতের ঘোড়া আসত। সেসব এখন স্মৃতির পাতায় হলেও বর্তমানে ময়মনসিংহ, জামালপুর, টাঙ্গাইল, বগুড়া, নওগাঁ, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, পাবনা, রাজশাহী, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ঘোড় সওয়ারি ও ঘোড়া মালিকরা এ মেলায় ঘোড়া নিয়ে আসেন। দোল শুরুর আগে থেকেই মেলায় বিভিন্ন দোকান-পাট আসতে শুরু করে। সারাদেশের ঘোড়া বেচা-কেনার একমাত্র মেলা এটি। মেলাটি প্রায় মাসব্যাপী চলে। তবে এবার মেলায় বিনোদনমূলক যাত্রা ও সার্কাসের অনুমোদন দেয়নি প্রশাসন।

মেলায় ঘোড়া কিনতে আসা ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার আব্দুল মজিদ জাগো নিউজকে বলেন, প্রতি বছর এ মেলার অপেক্ষায় থাকি। আমি মেলায় ঘোড়া কিনতে এসেছি। একটি ঘোড়ার দাম দুই লাখ টাকা হাঁকানোর পরও কিনতে পারিনি। তবে এবার ঘোড়া কিনেই বাড়ি ফিরবো।

রংপুর থেকে আসা এক ঘোড়া বিক্রেতা বলেন, আমি মেলায় ঘোড়া বেচার জন্য প্রায় প্রতি বছরই আসি। এবার চারটি ঘোড়া নিয়ে এসেছি, দুটি তিন লাখ টাকায় বিক্রি করেছি। বাকিগুলোও বিক্রি হবে আশা করছি।

মেলায় এবার একটি ঘোড়ার সর্বোচ্চ দাম হাঁকানো হয়েছে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা। ঘোড়াটির মালিক মজিবর রহমান বলেন, ঘোড়াটি ভারতীয় তাজি জাতের। এর বয়স সাড়ে চার বছর। এটি দ্রুত দৌড়াতে পারে। লাল-সাদা ডোরাকাটা ঘোড়াটির যত্ন নিজেই নিই।

গোপীনাথপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান বলেন, গোপীনাথপুর মেলাটি বিগত ৫১৩ বছর ধরে চলে আসছে। এটি ঐতিহ্যবাহী প্রাচীনতম মেলা। মেলায় কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা যেন না ঘটে সেজন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় রেখে আমরা কাজ করছি। মেলায় স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনের জন্য নিয়মিত প্রচার এবং মাইকিং করা হচ্ছে।

আক্কেলপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইদুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, মেলায় দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যবসায়ীরা আসেন। সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সার্বক্ষণিক পুলিশি টহল চলমান আছে। 

আক্কেলপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস.এম হাবিবুল হাসান বলেন, গোপীনাথপুরের মেলাটি প্রাচীন মেলা। এ মেলায় উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বক্ষণিক টিম কাজ করছে। নিরাপত্তার জন্য বিনোদনমূলক যাত্রা ও সার্কাসের অনুমোদন দেওয়া হয়নি। মেলাটি আমরা নজরদারির মধ্যে রেখেছি।

রাশেদুজ্জামান/এফএ/জেআইএম