দেশজুড়ে

দিনাজপুরের ১৯ নদী এখন নালা

নদীমাতৃক বাংলাদেশের উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা দিনাজপুর। তবে জেলার বেশিরভাগ নদীতে এখন পানি নেই। বালুর চর জমেছে। বালুচরের কারণে নদীতে কমেছে পানির পরিমাণ। পানি কমে যাওয়ায় কমেছে মাছও। মাছ কমে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন মৎস্যজীবীরা।

Advertisement

অন্যদিকে নদীতে পানি না থাকায় কৃষকরা সেচ সংকটে পড়েছেন। শুধু তাই নয়, নদীতে পানি না থাকায় কমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। ফলে গভীর নলকূপের মাধ্যমে সেচ দিচ্ছেন কৃষকরা। এতে ফসলের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ কৃষকরা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নদীর গভীরতা কমে যাওয়ায় এবং খনন না হওয়ার কারণে নদীর পানি ভূগর্ভে প্রবেশ করছে না। ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। যদিও পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, এরই মধ্যে নদীগুলোর খনন কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

দিনাজপুরের পুনর্ভবা, আত্রাই, গর্ভেশ্বরী, কাঁকড়াসহ ১৯টি নদী ঘুরে দেখা গেছে, নদীগুলোতে পানি নেই বললেই চলে। খড়স্রোতা নদীগুলো এখন পরিণত হয়েছে সরু নালায়। নদীর বড় অংশ জুড়েই পলি জমে ভরাট হয়েছে। অনেকেই সেই পলিতে চাষাবাদ করছেন। অনেক চরই ব্যবহৃত হচ্ছে খেলার মাঠ হিসেবে। শুধু বর্ষাকাল ছাড়া সবসময়ই এমন চিত্র দেখা যায়।

Advertisement

দীর্ঘ দুই যুগেও কোনো নদীর খনন কার্যক্রম শুরু করা হয়নি। ফলে বছরের পর বছর ধরে এসব নদী মরা খালে রূপ নিয়েছে। এ অবস্থায় বর্ষাকালে সামান্য বৃষ্টিতেই নদীর পানি উপচে পড়ে আশপাশের এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।

দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার তেরমাইল গড়েয়া এলাকার আব্বাস আলী জাগো নিউজকে বলেন, ‘আগে আমাদের বাবা-দাদারা নদীতে মাছ ধরতেন। কত মাছ! আর এখন নদীতে মাছও নাই, জলও নাই।’

এলাকার দ্বিজেন দাস বলেন, ‘আমরা মাছ ধরেই সংসার চালাই। আগে বাপ-দাদারা নদীতে অনেক মাছ পেতেন। এখন নদীতে মাছ পাই না। আমাদের কথা চিন্তা করে নদী খননের পাশাপাশি সরকার যেন এই নদীতে একটু মাছের ব্যবস্থা করে দেয়। তা নাহলে আমাদের অভাব ফুরাবে না।’

জেলার সদর উপজেলার গাবুড়া নদীর (গর্ভেশ্বরী নদী) পানিতে ফসল আবাদ করেন শেখপুরা ইউনিয়নের গোপালপুর এলাকার মজিবর রহমান।

Advertisement

তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘নদীতে চারদিকে চর জমে গেছে। এখন পানির আর দেখা পাই না। নদীতে আগে স্রোত দেখা যেতো। ২০০১ বা ২০০২ সালের দিকে এই নদীতে আগের ব্যবহৃত নৌকা পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু এখন নৌকাতো দূরের কথা, সেচের জন্য পানিও পাই না। বাধ্য হয়ে নদীতেই শ্যালো মেশিন বসিয়ে সেচ দিতে হয়।’

একই দাবি দিঘন এলাকার ইকবাল হোসেনের। তিনি বলেন, ‘ইরি আবাদেতো আকাশের পানি পাওয়া যায় না। পাতালের পানি নইলে নদীর পানি। কিন্তু পাতালে পানি নিবা গেলে খরচ বেশি। লেয়ার থাকে না। নদীতে ভাসা পানি সহজে পানি পাওয়া যায়। পাতালের পানিতে খরচ বেশি।’

কৃষক বেনু রাম সরকার জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ মুহূর্তে বড় সমস্যা হলো ভূগর্ভস্থ পানিও ধীরে ধীরে নিচে নেমে যাচ্ছে। আর এ কারণে ফসল উৎপাদনে বেশি খরচ হচ্ছে।’

দিনাজপুর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, প্রতি বছরই খরা মৌসুমে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ৩ থেকে ৬ ফুট পর্যন্ত নিচে নেমে যাচ্ছে। শুধু খরা মৌসুমেই নয়, বর্ষা মৌসুমেও পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে ফসলের মাঠে। এখন শুধু বোরো মৌসুমেই নয়, আমন মৌসুমেও যন্ত্রের মাধ্যমে পানি সেচ দিতে হচ্ছে কৃষকদের।

দপ্তরটির তথ্যমতে, গত ১০ বছরে দিনাজপুর জেলায় স্থানভেদে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ২ থেকে ৪ ফুট পর্যন্ত নিচে নেমে গেছে। পানির এই স্তর যতই নিম্নগামী হবে, ততই বাড়বে সেচ খরচ। এখন আগের তুলনায় পানি সেচের খরচ বেড়েছে স্থানভেদে ৬ থেকে ৮ শতাংশ পর্যন্ত। ফলে কৃষি উৎপাদনে উভয় সংকটে পড়েছেন উত্তরের জেলা দিনাজপুরের কৃষকরা।

জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে নদীর সংখ্যা রয়েছে ১৯টি। সাম্প্রতিক সময়ে নদীর খনন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। পুনর্ভবা, আত্রাই, ঢেপা, গর্ভেশ্বরী, ছোট যমুনা, ইছামতি নদীর খনন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এর মধ্যে আত্রাই ও পুনর্ভবা নদীর খনন কার্যক্রম করছে বাংলাদেশ নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়।

জেলা মৎস্য কার্যালয় সূত্র বলছে, গত পাঁচ বছরে জেলায় যেমন মাছের চাহিদা বেড়েছে, তেমনি মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে। তবে সেভাবে বাড়েনি মৎস্যজীবীর সংখ্যা। ২০১৬ সালে জেলায় নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ছিল ১১ হাজার ৫৭ জন, সেখানে ২০২১ সালে হয়েছে ১১ হাজার ৯১২ জন। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মাছের উৎপাদন ছিল ৪২ হাজার ৫৫১ মেট্রিক টন, সেখানে গত অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে ৫৬ হাজার ৯৬৫ মেট্রিক টন। যদিও জেলায় মাছের চাহিদা ৬২ হাজার মেট্রিক টনেরও বেশি।

দিনাজপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার (দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়) ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ১৯টি নদীর মোট দৈর্ঘ্য ৭২৮ কিলোমিটার। নদীগুলোর উৎসস্থল হিমালয় পর্বত। কালের বিবর্তনে ও নদী সংস্কারের অভাবে পুনর্ভবা, করতোয়া, আত্রাই, ঢেপা, গর্ভেশ্বরী, তুলাই, কাঁকড়া, ইছামতি, ছোট যমুনা, তুলসী গঙ্গা, টাঙ্গন নদীগুলো এখন পরিণত হয়েছে ধু ধু বালুচরে।

এসব নদ-নদী এখন পানির অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে। বর্তমানে অনেক স্থানেই এসব নদীর কোনো অস্তিত্বই দেখা যায় না। বর্ষাকালে এসব নদীতে সামান্য পানি থাকলেও শীত মৌসুমে এসব নদীতে পানি থাকে না। তখন নদীতীরের মানুষ চাষাবাদ করে এসব নদীতে।

দিনাজপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মুক্তাদির খান বলেন, ‘গত কয়েক বছরে জেলায় মাছের উৎপাদন বেড়েছে, জেলের সংখ্যাও বেড়েছে। অভয়াশ্রম ও রাবার ড্যামের ফলে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক জেলেই তাদের পেশা পরিবর্তন করছেন। ফলে জেলের সংখ্যা সেভাবে বাড়ছে না। তবে নদীগুলো যদি খনন করা হয় তাহলে অবশ্যই মাছের পরিমাণ বাড়বে।’

এ বিষয়ে দিনাজপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিবুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘অনেক নদীরই খনন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এগুলোর খনন মূলত করছে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়। কিছু খনন হচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধানে। নদীগুলো খনন হলে খরা মৌসুমেও পানি পাওয়া যাবে এবং কৃষি ও মৎস্যের উপকার হবে।’

দিনাজপুর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সদ্যবিদায়ী নির্বাহী প্রকৌশলী মুরাদ হাসান বলেন, ‘ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার অন্যতম কারণ নদী থেকে পানি ভূগর্ভে রিচার্জ হচ্ছে না। নদীতে পানি থাকলে সেই পানিই ভূগর্ভে প্রবেশ করে। আমাদের প্রয়োজন যে কীভাবে নদী থেকে ভূগর্ভে পানি রিচার্জ হতে পারে সেই ব্যবস্থা করা।’

এসআর/এমএস