পাহাড়ি কন্যা হিসেবে পরিচিত বান্দরবান। এখানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ পর্যটকরা। তারা মুগ্ধ হলেও, বান্দরবানের পাহাড়ে বসবাস করা মানুষগুলো ভালো নেই। পানি সংকটে কঠিন হয়ে পড়েছে তাদের জীবন। দিন দিন বেড়েই চলেছে এই সংকট। পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশু থেকে বৃদ্ধরা।
Advertisement
শুধু তাই নয়, এসব রোগে মৃত্যুর খবরও আসে প্রায় প্রতিবছর। পানি সংকটের কারণে পাড়া ছেড়ে চলে যাওয়ার চিন্তা করছেন দুর্গম পাহাড়ে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অনেকেই। পরিবেশগত কারণে বছরের প্রায় ছয় মাসই পানি সংকট থাকে পাহাড়ে।
আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত ২০ বছরে বান্দরবান জেলার ভূপৃষ্ঠ থেকে ২ মিটার উচ্চতায় বায়ুর গড় তাপমাত্রা শূন্য দশমিক ৫ থেকে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়েছে। বিশেষ করে গত সাত বছরে তাপমাত্রা বেড়েছে দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। বায়ুর তাপমাত্রা বাড়ার কারণে মাটির তাপমাত্রাও বেড়েছে। ফলে মাটির উপরিভাগের পানি বাষ্প হয়ে যাচ্ছে শুকিয়ে। শুষ্ক মৌসুমে নদী ও ছড়াগুলোতে পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে।
স্থানীয়রা জানান, জেলার দুর্গম পাহাড়ে বসবাসরত সবাই ঝিরির (অগভীর প্রাকৃতিক জলপ্রবাহ) পানি ও ঝরনার ওপর নির্ভরশীল। বর্তমানে অধিকাংশ ঝিরি শুকিয়ে যাওয়ায় দেখা দিয়েছে তীব্র পানি সংকট। এ সংকট নিরসনে বিভিন্ন সময় সরকারি-বেসরকারিভাবে অথবা এনজিও থেকে রিং ওয়েল ও টিউবওয়েল বসানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়। কিন্তু সুদূর প্রসারী পরিকল্পনার অভাবে বেশীরভাগই ভেস্তে যায়। গ্রীষ্ম মৌসুমে অধিকাংশই রিং ওয়েল অকেজো হয়ে থাকে। এতে পানির দুর্ভোগ কাটে না পাহাড়ে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর।
Advertisement
পাহাড়ে বসবাসকারীরা ঝিরির পানির ওপর নির্ভরশীল, কিন্তু এসব ঝিরি শুকিয়ে যাচ্ছে
সদর উপজেলার আমতলি পাড়া, মারমা পাড়া, মাঝের পাড়া, বতি পাড়াসহ বেশ কয়েকটি পাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কোনো কোনো ঝিরিতে বইছে সামান্য পানি। আবার কোনো ঝিরি শুকিয়ে গেছে পুরোটাই। খাবার পানির সংকট মেটাতে ঝিরির পাশে ছোট ছোট কুপ করে সেখান থেকে কলসি ভরেন স্থানীয়রা। এই পানি পান করে পাড়াবাসীর অনেকেই ডাইরিয়া, টাইফয়েডসহ নানা রোগে আক্রান্ত হন। আবার যেখানে সামান্য পানি পাওয়া যায়, সেই পানি দিয়েই কোনোমতে চলে গোসল, ধোয়া-মোছাসহ দৈনন্দিন কাজ।
তঞ্চগ্যা পাড়ার রতন ও মাকিং তঞ্চগ্যা বলেন, এই পাড়ায় ১২০ পরিবারের বসবাস। এখানে সবার পানির চাহিদা মিটতো ‘সুয়ালক’ ঝিরি থেকে। এখন ঝিরিতে কুপ করেও পানি পেতে কষ্ট হচ্ছে। এছাড়া রিং টিউবওয়েল বসানো হলেও পানি না পাওয়ায় এটি কাজে আসছে না।
মারমা পাড়ার হ্লা সিং ওয়াং বলেন, পাড়ায় একটি টিউবওয়েল রয়েছে। তবে এর পানিতে অতিরিক্ত আয়রন থাকায় খাওয়া বা ব্যবহার করা যায় না। এ জন্য ঝিরির পানি ব্যবহার করতে হয়।
Advertisement
পার্বত্য চট্টগ্রাম ‘বন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলনে’র বান্দরবান শাখার সভাপতি জুয়ামলিয়ান আমলাই জাগো নিউজকে বলেন, এক সময় ঘন জঙ্গল ও পাথরে ভরা ছিল এই বান্দরবান। উন্নয়নের জন্য অবাদে পাথর উত্তোলন, ব্যবসায়িক স্বার্থে জোত পারমিটের নামে নির্বিচারে গাছকাটা, বান্দরবানের পরিবেশকে ক্ষতবিক্ষত করে তুলছে। ফলে পরিবেশ উষ্ণ হয়ে কমছে পানির প্রবাহ।
বান্দরবানের সুয়ালক ইউনিয়নের চেয়ারম্যান উক্যানু মারমা জানান, ইউনিয়নের আমতলী পাড়া, চাকমা পাড়া, হেডম্যান পাড়া, মাঝের পাড়া, গনেশ পাড়া ও লম্বা রাস্তাসহ প্রায় সব পাড়াতেই তীব্র পানি সংকট। ইউনিয়নে বেশ কয়েকটি টিউবওয়েল থাকলেও ছয়টি ছাড়া বাকিগুলো অকেজো।
তিনি আরও বলেন, বর্ষা মৌসুমে রিং টিউবওয়েলগুলো স্থাপন করা হয়। তখন বৃষ্টির পানিতে পাহাড় ভেজা থাকায় কম গভীরতায় পানি পাওয়া যায়। কিন্তু গ্রীষ্মকাল শুরু হলেই নিচে নেমে যায় পানির স্তর। ফলে রিং টিউবওয়েলগুলো অকেজো হয়ে পড়ে। পাবলিক হেলথকে (বান্দরবান জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর) গ্রীষ্মের সময় রিং টিউবওয়েল বসানোর জন্য অনুরোধ করা হলেও এতে তারা কর্ণপাত করে না।
বান্দরবান সদর উপজেলার সুয়ালক ইউনিয়ন ছাড়াও জেলার রোয়াংছড়ি, রুমা, আলীকদম, লামা, থানচি উপজেলার দুর্গম পাহাড়ে বসবাসকারীদের অধিকাংশই সুপেয় পানির তীব্র সংকটে ভুগছে।
এবিষয়ে রোয়াংছড়ি উপজেলার তারাছা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান উনুমং মারমা জানান, ইউনিয়নের সাকিং খুমি পাড়া, ল্যাংখং পাড়া, মেউফ পাড়ায় খুবই পানি সংকট। সামনে এই পাড়াগুলো পানি শূন্য হয়ে যেতে পারে।
রুমা উপজেলা চেয়ারম্যান উহ্লা চিং মারমা বলেন, যতিরাং পাড়া, প্রংখম পাড়া, রামথুই পাড়াসহ কয়েকটি পাড়া পাহাড়ের চুড়ায় ও ঢালুতে অবস্থিত। ফলে সেখানে রয়েছে পানি সংকট। তারা নিকটতম ঝিরি থেকে পানি সংগ্রহ করে। তবে ঝিরি শুকিয়ে যাওয়ায় পাড়াবাসীরা পড়েছেন বিপাকে। সংকট নিরসনে উপজেলায় ৭২টি রিং ওয়েল অনুমোদন হয়েছে বলে শুনেছি।
থানচি উপজেলা চেয়ারম্যান থোয়াইহ্লামং বলেন, গ্রীষ্ম মৌসুমে ভরত পাড়া, বাগান পাড়াসহ কয়েকটি পাড়ায় পানি সংকট দেখা দিয়েছে। তবে সমাধানের চেষ্টা চলছে এই সংকট।
রুমা-থানচি উপজেলার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মুজিবুর রহমান বলেন, রুমা ও থানচি এই দুই উপজেলায় ৭০টি করে ১৪০টি রিং ওয়েল নির্মাণের কাজ চলছে। এসব কাজ করছেন টিকাদার কালু। তাকে দ্রুত কাজ শেষ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কাজ শেষ হলে এই দুই উপজেলায় পানি সংকট অনেকটাই কমে আসবে।
বান্দরবান জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী শর্মিষ্ঠা আচার্যি জাগো নিউজকে বলেন, বান্দরবানের ঝিরিগুলোর অধিকাংশই শুকিয়ে যাওয়ায় পাহাড়ে পানি সঙ্কট দেখা দিচ্ছে। সংকট নিরসনে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় পাড়া-মহল্লায় রিং ওয়েল স্থাপন করা হয়।
এসব রিং ওয়েলের অধিকাংশই অকেজো বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এবিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগে রিং ওয়েলগুলো বর্ষা মৌসুমে ৪০ ফিট গভীরতায় স্থাপন করা হতো। ফলে অল্প লেয়ারে পাওয়া যেতো পানি। কিন্তু গ্রীষ্ম মৌসুমে পানির লেয়ার নিচে নেমে যাওয়ায় এগুলো অকেজো হয়ে পড়ে।
এসময় তিনি জানান, বান্দরবান জেলায় পানি সংকট নিরসনে নতুন করে ৮৪টি রিং ওয়েল নির্মাণ কাজ চলছে। এগুলো ৫০ ফিট গভীর এবং শুষ্ক মৌসুমে করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
নয়ন চক্রবর্তী/জেডএইচ/জিকেএস