অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশে মোরাল মোড়লরা সক্রিয়। কোথাও কিছু ঘটলেই তারা লাফিয়ে সামনে চলে আসেন- এটা করা ঠিক হয়নি, এটা বলা উচিত হয়নি, এভাবে বললে ভালো হতো, এ কারণেই সমাজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। মোড়লিপনা আর উপদেশ বৃষ্টিতে সয়লাব চারপাশ।
Advertisement
কদিন আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪২তম ব্যাচের র্যাগ ডে পালিত হয়েছে উৎসবমুখর ও আনন্দঘন পরিবেশে। ব্যাচের শিক্ষার্থীরা নেচে-গেয়ে পালন করে দিবসটি। এটি কোনো প্রকাশ্য অনুষ্ঠান ছিল না। তবে দেশের বাইরে থাকা ব্যাচের শিক্ষার্থীদের জন্য ফেসবুকে লাইভ করা হয়।
সেখান থেকেই অনুষ্ঠানের একটি অংশ ভাইরাল হয়েছে। আর তা নিয়েই মোড়লদের ঘুম হারাম। ভাইরাল হওয়া অংশে এক যুগলকে নাচতে দেখা যাচ্ছে। অনুষ্ঠানে যারা পারফর্ম করেছেন, তারা কেউই পেশাদার শিল্পী নন। তারপরও সেই যুগল নৃত্যের কোরিওগ্রাফি আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমি অন্তত তাদের আনন্দে, উৎসবে কোনো অশ্লীলত খুঁজে পাইনি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অশ্লীলতা বিতর্ক চলতে চলতেই ঝড় তোলেন ভারতের অভিনেত্রী সানি লিওন। প্রথমে একটি ছবিতে অভিনয়ের জন্য বাংলাদেশে আসতে চেয়েছিলেন সানি লিওন। কিন্তু সরকার ওয়ার্ক পারমিট বাতিল করে সানি লিওনের বাংলাদেশে আসা আটকে দেয়। কিন্তু ওয়ার্ক পারমিট বাতিলের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ট্যুরিস্ট ভিসায় বাংলাদেশে আসেন সানি লিওন। একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশ নিতে বাংলাদেশে এসেছিলেন সানি লিওন।
Advertisement
অবশ্য তিনি একা নন, মুম্বাই ও কলকাতার বেশ কয়েকজন তারকা অভিনেতা, অভিনেত্রী, গায়ক সে বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন। তারা নেচে গেয়ে আনন্দ করেছেন। বিশেষ করে সানি লিওনের নাচের অংশ ভাইরাল হয়েছে ফেসবুকে। অন্যদেরটা যেমন তেমন, সানি লিওনের বাংলাদেশে আসা নিয়ে মোরাল মোড়লদের উত্তেজনা চরমে।
পত্র-পত্রিকার সুবাদে সানি লিওনের নাম শুনেছি। কিন্তু তার অভিনীত কোনো ছবি দেখিনি। তিনি কেমন অভিনয় করেন, তাও জানি না। মূলধারায় অভিনয় শুরুর আগে সানি লিওন নীল ছবিতে অভিনয় করতেন। এখানেই মোড়লদের আপত্তি। আমার একটা নির্দোষ কৌতূহল, যারা সানি লিওন বাংলাদেশে আসায় গেল গেল রব তুলছেন; তারা তাকে চেনেন কীভাবে?
তারা কি সানি লিওনের ছবি বা নীল ছবি দেখেছেন? নিশ্চয়ই তারা ইউটিউবে সানি লিওনের ছবি বা নীল ছবি দেখেছেন। সানি লিওনের বাংলাদেশ সফর যুব সমাজের চরিত্র নষ্ট করবে বলে যারা উৎকণ্ঠিত, তাদের জন্য বলছি, যুব সমাজকে ধ্বংস করার জন্য সানি লিওনকে বাংলাদেশে আসতে হয় না। গোটা বিশ্বই এখন একটা গ্রাম। সবকিছুই এখন উন্মুক্ত।
আপনি ইউটিউবে ঢুকলেই শত সানি লিওন পাবেন। সদর দরজা খোলা রেখে জানালা বন্ধের চেষ্টা অর্থহীন। সানি লিওনের বর্তমান পেশা বা অতীত পেশা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। যে কোনো মানুষের যে কোনো পেশা বেছে নেওয়ার অধিকার আছে। যিনি যে দেশে থাকেন, সে দেশের আইন মেনে যা ইচ্ছা করার স্বাধীনতা তার আছে।
Advertisement
প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশে এসে সানি লিওন কোনো আইন ভঙ্গ করেছেন কি না। তিনি বৈধ ট্যুরিস্ট ভিসায় বাংলাদেশে এসেছেন। তিনি একটি পারিবারিক বিয়ের অনুষ্ঠানে নেচেছেন। তার সেই নাচেও অশ্লীল কিছু ছিল না।
অশ্লীলতা আসলে নাচে গানে বা পোশাকে নয়; নির্ভর করে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। আপনার ভাবনা-চিন্তা জুড়েই যদি অশ্লীলতা থাকে, আপনি সবকিছুতে অশ্লীলতাই দেখবেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কাপল ড্যান্স বা সানি লিওনের নাচ দেখেই যদি আপনার যুব সমাজ ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে বুঝতে হবে যুব সমাজের শিক্ষায় বড় রকমের গলদ আছে। আপনার সন্তানকে নৈতিক শিক্ষা দিন। কোনটা ভালো-কোনটা মন্দ চিনিয়ে তিনি। সে নিজেই নিজেকে বাঁচানোর জন্য যথেষ্ট হবে। গোড়া কেটে আগায় পানি ঢাললে সেই গাছ বাঁচবে না।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কাপল ড্যান্স বা বিয়ের অনুষ্ঠানে সানি লিওনের নাচ আমার কাছে অশ্লীল মনে হয় না। বাংলাদেশে ঘুস ছাড়া কোনো কাজ হয় না, এটা আমার কাছে অশ্লীল মনে হয়। তদবির ছাড়া চাকরি বা পোস্টিং হয় না, এটা আমার কাছে অশ্লীল মনে হয়। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়া দুর্নীতি, অসততা আমার কাছে অশ্লীল মনে হয়। ব্যাংক-বীমা-আর্থিক প্রতিষ্ঠানের হাজার কোটি টাকা পাচার করে কানাডার বেগমপাড়ায় বাড়ি কেনাকে আমার কাছে অশ্লীল মনে হয়।
সবচেয়ে বেশি অশ্লীল লাগে ক্ষুধা, দারিদ্র্য আর পাহাড় সমান বৈষম্যকে। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি, ভোজ্যতেল নিয়ে ব্যবসায়ীদের কারসাজির চেয়ে অশ্লীল কিছু আমার চোখে পড়ে না। মেয়ের বিয়েতে দল বেঁধে ভারতের তারকা শিল্পীদের নাচানোর পাশে যখন দেখি টিসিবির ট্রাকের পেছনে ঝুলে থাকা নারীর ছবি; তখন অশ্লীলতার সংজ্ঞা আমি নতুন করে শিখি।
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ অভাবিত উন্নতি করেছে সন্দেহ নেই। অর্থনীতির সব সূচকেই বাংলাদেশের দৃঢ় অবস্থান। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল আমাদের নতুন যুগে নিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশ।
বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় এখন প্রায় ২৬০০ ডলার। কিন্তু এই উন্নয়নের সুফল আমরা সমানভাবে সবার ঘরে পৌঁছে দিতে পারিনি। কারও মাথাপিছু আয় হাজার কোটি টাকা, কারও হাজার টাকা। গড় করলে ২৬০০ ডলার হয় বটে। কিন্তু তাতে হাজার টাকা আয়ওয়ালা দিন আনি দিন খাই মানুষের কিছু যায় আসে না। টিসিবির ট্রাকের পেছনে ৫ ঘণ্টা দৌড়ে খালি হাতে ফিরে আসা মানুষের কাছে জাহাঙ্গীরনগরের কাপল ড্যান্স বা সানি লিওনের ১৭ ঘণ্টার সফরের কোনো মানে নেই।
২০ মার্চ, ২০২২লেখক : বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।
এইচআর/ফারুক/জিকেএস