মতামত

মিডিয়া নিয়ে রাশিয়ার অভিযোগ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা

বাংলাদেশে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত অভিযোগ করেছেন, বাংলাদেশে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে মিডিয়া যা রিপোর্ট করছে তা পশ্চিমা মিডিয়া প্রভাবিত রিপোর্ট, সত্য রিপোর্ট নয়। শুধু যে বাংলাদেশে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত এ অভিযোগ করেছেন তা নয়-গত কয়েকদিনে বেশ কয়েকজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন সাংবাদিকের লেখায়ও একই কথা পড়েছি। চায়নার গ্লোবাল টাইমসের কয়েকটি লেখার মধ্যেও একই ধরনের সুর পাওয়া যায়।

Advertisement

এটা সত্য, মিডিয়া এখনও ইউরোপ ও আমেরিকা নিয়ন্ত্রণ করে। যারা বর্ণবাদী মানসিকতার তারা অবশ্য এটাকে আরও একটু বাড়িয়ে বলেন, মিডিয়া হোয়াইটদের দখলে। যেমন প্রশ্ন উঠেছে ইয়েমেনের যুদ্ধের নিউজ মিডিয়া যেভাবে প্রচার করে তার থেকে শতগুণ বেশি গুরুত্ব দিয়ে করছে বর্তমানের ইউক্রেনের যুদ্ধের নিউজ। এর মূল কারণ হিসেবে অনেকে বলেন, ইয়েমেনের যুদ্ধটাকে পশ্চিমারা অশিক্ষিত মুসলিমদের নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বা দুই দেশের মারামারি হিসেবে দেখায়।

ওই সব প্রশ্নের উত্তরে না গিয়ে এটা বলা যায়, বাস্তবে ইউক্রেনের যুদ্ধের গুরুত্ব ইউরোপ ও আমেরিকার কাছে বেশি হবে। কারণ, এখানে তাদের স্বার্থ, তাদের ভবিষ্যত পৃথিবীর শক্তির গতি প্রকৃতি ধরে রাখার বিষয়ে -এই যুদ্ধ অনেকখানি নির্ভর করছে। এই যুদ্ধের জয় পরাজয়ের মধ্য দিয়ে নিউ ওয়ার্ল্ড পাওয়ার সেন্টার ঠিক হবে। এটাও শতভাগ সঠিক না হলেও ফেলে দেবার কোনো সুযোগ নেই।

তবে এই ভূরাজনৈতিক ও বর্ণবাদী বিষয়ের ভেতর না ঢুকেই দেখা যেতে পারে, কেন শুধু বাংলাদেশ নয় সারা পৃথিবীই পশ্চিমা মিডিয়ার ওপর অনেকখানি নির্ভর করছে এই ইউক্রেন যুদ্ধের সংবাদ নিয়ে। এর মূল কারণটি কিন্তু কোনো মতেই ইউক্রেন যুদ্ধের পরেই শুরু হয়নি। এটা দীর্ঘদিনের সমস্যা। এবং এই সমস্যা সৃষ্টি করেছে রাশিয়ার সরকারের চরিত্র।

Advertisement

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে পৃথিবী দুইভাগে ভাগ হয়েছিল। দুই পরাশক্তির সৃষ্টি হয়েছিল। একটি সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রসমূহ অপরটি আমেরিকা নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রসমূহ। সেখানে সামরিক শক্তিতে দুই পরাশক্তি হলেও মিডিয়ার ক্ষেত্রে কিন্তু পশ্চিমাবিশ্ব ও তাদের নিয়ন্ত্রিত অংশ অনেকখানি এগিয়ে ছিল। এর কারণ, তুলনামূলক পশ্চিমাদের মিডিয়ার স্বাধীনতা। বৃটিশকে মিডিয়ার স্বাধীনতা নিয়ে যতটা গ্লোরিফাই করা হয় অতটার প্রাপ্য কিন্তু তারা নয়। কারণ, ব্রিটিশ তার কলোনিগুলোতে মিডিয়া কালচার গড়লেও কিন্তু মিডিয়ার শতভাগ স্বাধীনতা দেয়নি। অমর্ত্য সেন তার আত্মজীবনীতে বলেছেন, বৃটিশ আমলে একের পর এক দুর্ভিক্ষ হয়েছে ভারত বর্ষের বিভিন্ন এলাকায়, ভারত স্বাধীন হবার পরে হয়নি -তার কারণ, ব্রিটিশ আমলে মিডিয়ার অতটা স্বাধীনতা ছিল না। যে কারণে তথ্য পৌঁছাত না সকলের কাছে। অমর্ত্য সেনের এ বক্তব্যের পরেও বলা যায়- এ সত্ত্বেও ব্রিটিশ মিডিয়া এক ধরনের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেছে বিভিন্ন সময়ে সংবাদ প্রকাশের ভেতর দিয়ে। যেমন আমাদের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ মিডিয়া বা সারা পশ্চিমা মিডিয়া কিন্তু সঠিক সংবাদ শতভাগ না হলেও যতটা সম্ভব প্রকাশ করেছিল। আমেরিকার মিডিয়াও একই কাজ করে।

ইরাক যুদ্ধের সময় এমবেডেড সাংবাদিকতা শুরু হলেও কিন্তু পশ্চিমা মিডিয়া শতভাগ বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়নি। কারণ, সেখানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা রাজনৈতিকভাবে ও মিডিয়ায় প্রকাশের ক্ষেত্রে ছিল। তাই বৃটিশ লেবার পার্টির সরকার যুদ্ধের সঙ্গে থাকলেও তাদের দলীয় এমপি গার্ডিয়ানে অপিনিয়ন লিখেছিলেন তথ্য উপাত্ত দিয়ে যে -এই যুদ্ধ মূলত ইরাকের তেল নেবার একটা কৌশল মাত্র। ঠিক তেমনি নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট তাদের নিজস্ব রিপোর্টগুলোতে অনেক সত্য তুলে ধরেছিল।

অন্যদিকে, সোভিয়েত ইউনিয়ন যতদিন ছিল, তার মিডিয়া কিন্তু ছিল মূলত সরকারের ভয়েস অর্থাৎ সেই গ্রামোফোন কোম্পানির নামটি এখানে সব থেকে সঠিক উপমা-হিজ মার্স্টাস ভয়েস। তাদের নিয়ন্ত্রিত কোনো দেশেই কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন মিডিয়া বিকাশ হতে দেয়নি। এরপরে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে। রাশিয়া সৃষ্টি হয়েছে বা আবার ফিরে এসেছে। পুতিন দীর্ঘদিন এই সাম্রাজ্যের অধিকারী আইনের নানান কৌশলে- কিন্তু তিনি কখনই মিডিয়ার স্বাধীনতা দেননি। এমনকি যারা ঝুঁকি নিয়ে স্বাধীন মিডিয়া করতে গেছে তারা অনেকেই জেলে গেছেন, অনেকেই দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। এমনকি এই ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হবার পরে সেখানে একটি টেলিভিশন সেন্টার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে, সরকারের কারণেই এটা বন্ধ হয়েছে। এখন পশ্চিমা মিডিয়া যা বলছে সেটাই বিশ্বাস করা ছাড়া উপায় নেই। কারণ, রাশিয়ার মিডিয়া থেকে সব খবর সরকারের ভয়েস মাত্র।

আর মিডিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতার জন্য সরকারের একটা উদার চরিত্র সব সময়ই প্রকাশ করতে হয়। কোনো দেশে যদি সরকারের চরিত্র উদার না হয়; সরকার যদি কেবল তাদের কথাই প্রকাশ করতে দেয় বা সেটাকে উৎসাহিত করে নানান কৌশলে- তাহলে ওই দেশের মিডিয়াকে সেদেশের মানুষও বিশ্বাস করে না। শুধু তাই নয়, সরকারের অনেক কিছুকে বিশ্বাস করে না। যেমন রাশিয়া করোনার টিকা অনেক আগেই তৈরি করেছিল। কিন্তু সে দেশে করোনা দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে। এবং প্রচুর মানুষ মারা গেছে। তারপরেও অনেকেই দেশি টিকা নেয়নি। কারণ, তারা তাদের সরকারকে বিশ্বাস করে না।

Advertisement

সরকারের নিজস্ব বিশ্বাস অর্জন ও মিডিয়া বিষয়ক কালাকানুন মুক্ত দেশ না হলে ওই দেশের মিডিয়াকে আসলে কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। পশ্চিমা দেশগুলোতে মিডিয়ার ওপর কালাকানুন কম বলেই বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে নেই বলেই কিন্তু মানুষ ওই দেশের মিডিয়াকে বিশ্বাস করে।

এমনকি কোনো দেশে যখন কোনো উদার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের বদলে রক্ষণশীলরা ক্ষমতায় আসে তখনই কিন্তু সে দেশের মত প্রকাশের স্বাধীনতা বা মিডিয়ার স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। গত সপ্তাহে অত্যন্ত সুন্দর ও প্রতিযোগিতা পূর্ণ নির্বাচনের ভেতর দিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার ডানপন্থী দলের নেতা ইয়োন শক ইয়োল সেদেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। তার নির্বাচিত হওয়া নিয়ে গণতান্ত্রিক বিশ্বের বা সেদেশের গণতান্ত্রিক শক্তির কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু তাকে প্রথমেই যে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে, তিনি দেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সঠিকখাতে চলতে দেবেন কি না? কারণ, এর আগে যখন তার দল ক্ষমতায় ছিল ওই সময়ে সে দেশে ‘ন্যাশনাল সিকিউরিটি ল’ ও ‘ক্রিমিনাল ডিফামেশন ল’ নামক দুটি আইন করা হয়।আর এই আইনের মাধ্যমে গবেষক থেকে শুরু করে সাংবাদিকতা ও প্রকাশনা জগতের অনেককেই শাস্তি পেতে হয়। যে কারণে প্রথমেই প্রশ্ন উঠেছে, তিনি আবার তার দেশে এই আইন ব্যবহার করবেন কি না? তার অর্থ, তাদের দলের ওপর দেশের মানুষের ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন আছে।

বাস্তবে স্বৈরতান্ত্রিক সরকার, কর্তৃত্ববাদী সরকার এমনকি রক্ষণশীল সরকার ক্ষমতায় থাকলে মানুষ সে দেশের মিডিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলে। দেশের আইন ঠিক রেখেও যদি সরকারের মূল ব্যক্তি স্বৈরতন্ত্রী বা এককক্ষমতা ব্যবহারকারীর চরিত্রের হন, তাহলেও এই একই প্রশ্ন ওঠে। যে প্রশ্নের মুখে ট্রাম্পের আমলে আমেরিকাকেও পড়তে হয়েছিল।

তাই বাস্তবে রাশিয়ার পক্ষ থেকে বাংলাদেশের মিডিয়ার দোষ দিয়ে বা পশ্চিমা মিডিয়া নির্ভর বলে কোনো লাভ নেই। মূলত তাদের দেশের সরকারের চরিত্র আর মিডিয়ার চরিত্র যতদিন না বদলাবে, ততদিন তাদের খবর এভাবেই প্রকাশিত হবে। সমস্যাটি তাদের নিজেদের। বাংলাদেশের মিডিয়ার নয়।

লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক।

এইচআর/জেআইএম