অর্থনীতি

বাড়তি এলপিজি নিয়ে বিপাকে ইস্টার্ন রিফাইনারি!

#এলপিজি নিয়ে বিপাকে এলপিজিএল#এলপিজির উৎপাদন বাড়লেও বোটলিং সক্ষমতা বাড়েনি#বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে এলপিজি বিক্রির প্রস্তাব

Advertisement

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলে চলছে অস্থিরতা। এরই মধ্যে দেশের একমাত্র পেট্রোলিয়াম জ্বালানি উৎপাদনকারী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডে দেখা দিয়েছে (ইআরএল) উৎপাদন বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা। প্রতিষ্ঠানটির এলজিপির উৎপাদন সক্ষমতা বেড়েছে। তবে বাড়েনি বোতলজাত করা সরকারি আরেক প্রতিষ্ঠান এলপি গ্যাস লিমিটেডের (এলপিজিএল) বোটলিং সক্ষমতা। ইস্টার্ন রিফাইনারির উৎপাদিত এলপিজি বাজারজাত করা না গেলে উৎপাদন স্বাভাবিক রাখার জন্য স্টোরেজ পূর্ণ হওয়ার পর উৎপাদিত এলজিপি পুড়িয়ে ফেলা হয়। এরই মধ্যে বোটলিং (বোতলজাত) করার অতিরিক্ত এলপিজি বাল্কে বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে এলপিজিএল। নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) অনুমোদন পাওয়া গেলে বাল্কে বিক্রি শুরু করা হবে বলে জানিয়েছে এলপি গ্যাস কর্তৃপক্ষ। এসব সংকট নিরসন না হলে ইস্টার্ন রিফাইনারি উৎপাদন বন্ধ রাখতে অনেকটা বাধ্য হবে।

এ বিষয়ে ইস্টার্ন রিফাইনারির উপ-মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) মোস্তাফিজুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের এলপিজি উৎপাদন বেড়েছে। নিয়মিত এলপি গ্যাসকে এসব এলপিজি সরবরাহ করতে দেই। কখনো এলপি গ্যাস কর্তৃপক্ষ এলপিজি নিতে না পারলে আমাদের সমস্যা হয়। স্টোরেজ পূর্ণ হয়ে গেলে আর এলপিজি ধরে রাখার সুযোগ নেই। এরকম হলে পুরো প্ল্যান্টটি বন্ধ করে রাখতে হবে। অথবা প্ল্যান্ট চালু রেখে এলপিজি সরবরাহ দেওয়া না গেলে এসব এলপিজি পুড়িয়ে ফেলতে হবে।

তিনি বলেন, আমাদের দায়িত্বকালে এলপিজি পোড়াতে হয়নি। তবে আগে যখন বাজারে চাহিদা কম ছিল, তখন অনেক সময় এলপিজি পুড়িয়ে ফেলার ঘটনাও ঘটেছে।

Advertisement

জানা যায়, ইআরএলে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল (ক্রুড অয়েল) প্রক্রিয়াজাত করার সময় উপজাত হিসেবে এলপিজি উৎপাদিত হয়। ১৯৭৮ সালে যমুনা অয়েল কোম্পানি এসব গ্যাস স্টোরেজ ও বোটলিং প্ল্যান্ট তৈরি করে। পরে ওই প্ল্যান্টটি এলপি গ্যাস লিমিটেড হিসেবে আলাদা কোম্পানির নামে নিবন্ধিত হয়। এরপর থেকে দৈনিক কম-বেশি ৫০ মেট্রিক টন এলপিজি বোতলজাত করে পদ্মা অয়েল কোম্পানি, যমুনা অয়েল কোম্পানি, মেঘনা পেট্রোলিয়াম ও স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানির (এসএওসিএল) মাধ্যমে বিপণন করে আসছে।

মূলত কোম্পানিগুলো তাদের নিজস্ব ডিলারদের মাধ্যমে এলপিজি সিলিন্ডারগুলো বিপণন করে। বাজারে প্রাইভেট কোম্পানিগুলোর সিলিন্ডার ১২ কেজির হলেও এলপিজিএলের সিলিন্ডারগুলো সাড়ে ১২ কেজির। বর্তমানে সাড়ে ১২ কেজির এলপিজি সিলিন্ডারের ভোক্তা পর্যায়ে দাম ৫৯১ টাকা হলেও বিপণন কোম্পানিগুলো থেকে ৫১১ টাকা করে পায় এলপিজিএল।

এদিকে, ইস্টার্ন রিফাইনারি সূত্রে জানা যায়, ১৫ লাখ টন ক্রুড পরিশোধন সক্ষমতার ইস্টার্ন রিফাইনারিতে বছরে প্রায় ১২ হাজার টন এলপিজি উৎপাদন হতো। এসব এলপিজি নিয়মিত এলপিজিএলকে দিয়ে দেয় ইস্টার্ন রিফাইনারি। সম্প্রতি দেশে চাহিদা অধিক বেড়ে যাওয়ায় এলপিজি উৎপাদন বাড়ানোর পদক্ষেপ নেয় ইআরএল।

ইস্টার্ন রিফাইনারির কর্মকর্তারা জানান, দ্বিতীয় ইউনিট করতে যাচ্ছে ইস্টার্ন রিফাইনারি। এতে এলপিজির উৎপাদন আগের চেয়ে ৪০ শতাংশ বেড়ে যাবে।

Advertisement

এ ব্যাপারে ইস্টার্ন রিফাইনারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী লোকমান হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, দেশে দিন দিন এলপিজির চাহিদা বাড়ছে। এজন্য আমরা ইস্টার্ন রিফাইনারির বিদ্যমান কাঠামোর মধ্যেই এলপিজি উৎপাদন বাড়ানোর পদক্ষেপ নিয়েছি। আগে আমাদের বছরে ১২ হাজার টন এলপিজি উৎপাদন হতো। এখন উৎপাদন ৪০ শতাংশ বেড়ে প্রায় ১৭ হাজার টনের কাছাকাছি পৌঁছে যাবে। আমাদের উৎপাদিত এলপিজি বিপিসির আরেক অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এলপি গ্যাস লিমিটেডকে সরবরাহ করা হয়। এলপি গ্যাস বোতলজাত করে বিপণন কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে বাজারে ছাড়ে।

তিনি বলেন, এলপি গ্যাস বোতলজাত করার পর অবশিষ্ট গ্যাস বাল্কে বিক্রির একটি পদক্ষেপ নিয়েছে। এরই মধ্যে তারা বিষয়টি অনুমোদনের বিপিসিকে চিঠিও দিয়েছে। আশা করি বাল্কে বিক্রির অনুমোদন সহসা পেয়ে গেলে সমস্যা কেটে যাবে।

উৎপাদিত এলপিজি নিয়মিত সরবরাহ দিতে না পারলে বাধ্য হয়েই পুরো প্ল্যান্ট বন্ধ রাখতে হতে পারে বলে জানান তিনি।

অন্যদিকে, ইআরএলে এলপিজির উৎপাদন বেড়ে যাওয়া বিপাকে পড়েছে এলপিজিএল। পরিস্থিতি সামাল দিতে গত জানুয়ারি থেকে অতিরিক্ত কাজ করে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত বোতলজাত কার্যক্রম বাড়িয়ে দেয়। এতেও পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটিকে। বর্তমানে সক্ষমতার অতিরিক্ত এলপিজি বাল্কে বেসরকারি প্ল্যান্ট মালিকদের কাছে বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এরই মধ্যে বাল্কে এলপিজি বিক্রির জন্য দরপত্র বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে এলপি গ্যাস কর্তৃপক্ষ।

তবে বাল্কে এলপিজি বিক্রির এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছে এলপি গ্যাস পরিবেশক সমিতি। সমিতির পক্ষ থেকে বাল্কে এলপিজি বন্ধের আহ্বান জানিয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রীকে চিঠিও দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে সংগঠনটির সভাপতি খোরশেদুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, এলপি গ্যাস লিমিটেড একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়ন্ত্রিত বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য এলপি গ্যাস লিমিটেডের ভূমিকা রয়েছে। বর্তমানে এলপি গ্যাস নিজেদের সক্ষমতা না বাড়িয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে এলপিজি বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অথচ ৩৩ কেজি ও ৪৫ কেজির সিলিন্ডারে বোতলজাত করা হলে বাল্কে বিক্রির প্রয়োজন হতো না। প্রাইভেট কোম্পানিগুলোর এমনিতেই বাজারে আধিপত্য রয়েছে, এখন এলপি গ্যাস কোম্পানি তাদের এলপিজি বাল্কে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করলে ডিলাররা বঞ্চিত হবে, ক্রেতারা ঠকবেন।

এলপিজিএল সূত্রে জানা যায়, স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ১৭ ট্রাক (প্রতি ট্রাকে ২৩৮টি সিলিন্ডার) এলপিজি সরবরাহ দিতো। সপ্তাহে পাঁচদিন এ কার্যক্রম চলে। এতে দিনে প্রায় ৫০ টন হিসেবে সপ্তাহে সাড়ে তিনশ টন এলপিজি সরবরাহ দিতো। কিন্তু জানুয়ারি থেকে বাড়িয়ে দিনে ২৪ ট্রাক সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে। ফলে দিনে ৭১ টনের মতো এলপিজি বোতলজাত করে সরবরাহ দিয়ে আসছে এলপিজিএল। এজন্য প্রতিষ্ঠানটির ৩০-৪০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নিয়মিত ওভার টাইম দিতে হয়।

এলপিজিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু হানিফ জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের স্টোরেজ ক্যাপাসিটি রয়েছে তিনশ মেট্রিক টনের। আমরা নিয়মিতভাবে ইস্টার্ন রিফাইনারি থেকে যেসব এলপিজি পাই, সেগুলো বোতলজাত করে বিপণন প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে সরবরাহ করি। এখন ইস্টার্ন রিফাইনারি আগের চেয়ে বেশি এলপিজি দিচ্ছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে আমরা গত জানুয়ারি থেকে অতিরিক্ত কাজ করছি। প্ল্যান্ট চালু রাখছি রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত। এভাবে তো চলতে পারে না। একজন শ্রমিক পুরো বছর তো ওভারটাইম করতে পারবে না। ওভারটাইম করতে করতে কোনো শ্রমিক অসুস্থ হলে এর দায় কে নেবে? তাছাড়া আমাদের মেশিনগুলোও অনেক আগের, পুরোনো।

‘আমরা এখনো বাল্কে বিক্রি শুরু করিনি। টেন্ডার ডেকেছি। তবে বিপিসির অনুমোদনের পরই বিক্রির কথা আসবে। নিয়মিত বোটলিং করার পরেও যদি অতিরিক্ত এলপিজি রয়ে যায়, তখন বাল্কে বিক্রি করা হবে।’

আবু হানিফ বলেন, আমরা সাড়ে ১২ কেজির এক সিলিন্ডার এলপিজি বিক্রি করে বিপণন প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ৫১১ টাকা করে পাই। কিন্তু বাল্কে বিক্রি করলে একই পরিমাণ গ্যাসের জন্য সাড়ে আটশ টাকা করে পাবো। এতে সরকার লাভবান হবে।

বর্তমানে বেসরকারি পর্যায়ে ১২ কেজির এলজিপির দাম ১ হাজার ৩৯১ টাকা নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। গত ৪ মার্চ থেকে এ দাম কার্যকর হয়। প্রতি লিটার এলপিজির দাম নির্ধারণ করা হয় ৬৪ টাকা ৭৮ পয়সা। অথচ গ্রাহক পর্যায়ে সাড়ে ১২ কেজির বিপিসির এলপিজি সিলিন্ডারের সরকার নির্ধারিত দাম ৫৯১ টাকা।

ইকবাল হোসেন/আরএডি/এএ/জেআইএম