পণ্ডিতমশাই ভট্চার্যি বামুন, সাদাসিধে শান্তশিষ্ট নিরীহ মানুষ। বাড়িতে তার সরষের তেলের দরকার পড়েছে, তাই তিনি কলুর বাড়ি গেছেন তেল কিনতে।
Advertisement
কলুর ঘরে মস্ত ঘানি, একটা গরু গম্ভীর হয়ে সেই ঘানি ঠেলছে, তার গলায় ঘণ্টা বাঁধা। গরুটা চলছে চলছে আর ঘানিটা ঘুরছে, আর সরষে পিষে তা থেকে তেল বেরুচ্ছে। আর গলার ঘণ্টাটা টুংটাং টুংটাং করে বাজছে।
পণ্ডিতমশাই রোজই আসেন রোজই দেখেন, কিন্তু আজ তার হঠাৎ ভারি আশ্চর্য বোধ হলো। তিনি চোখমুখ গোল করে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। তাই তো! এটা তো ভারি চমৎকার ব্যাপার!
কলুকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ওহে কলুর পো, ও জিনিসটা কি হে?’ কলু বললো, ‘আজ্ঞে ওটা ঘানিগাছ, ওতে তেল হয়।’ পণ্ডিতমশাই ভাবলেন, এটা কি রকম হলো? আম গাছে আম হয়, জাম গাছে জাম হয়, আর ঘানি গাছের বেলায় তেল হয় মানে কি? কলুকে আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘ঘানি ফল হয় না?’ কলু বললে, ‘সে আবার কি?’
Advertisement
পণ্ডিতমশাই টিকিতে হাত বুলিয়ে ভাবতে লাগলেন তার প্রশ্নটা বোধহয় ঠিক হয়নি। কিন্তু কোথায় যে ভুল হয়েছে, সেটা তিনি ভেবে উঠতে পারলেন না। তাই খানিকক্ষণ চুপ করে তারপর বললেন, ‘তেল কী করে হয়?’ কলু বললো, ‘ঐখেনে সর্ষে দেয় আর গরুতে ঘানি ঠেলে আর ঘানির চাপে তেল বেরোয়।’ এইবারে পণ্ডিতমশাই খুব খুশি হয়ে ঘাড় নেড়ে টিকি দুলিয়ে বললেন, ‘ও বুঝেছি! তৈল নিষ্পেষণ যন্ত্র!’
তারপর কলুর কাছ থেকে তেল নিয়ে পণ্ডিতমশাই বাড়ি ফিরতে যাবেন, এমন সময় হঠাৎ তার মনে আরও একটা খট্কা লাগল- ‘গরুর গলায় ঘণ্টা কেন?’ তিনি বললেন, ‘ও কলুর পো, সবি তো বুঝলুম, কিন্তু গরুর গলায় ঘণ্টা দেবার অর্থ কী? ওতে কি তেল ঝাড়াবার সুবিধা হয়?’
কলু বললো, ‘সব সময় তো আর গরুটার উপরে চোখ রাখতে পারি নে, তাই ঘণ্টাটা বেঁধে রেখেছি। ওটা যতক্ষণ বাজে, ততক্ষণ বুঝতে পারি যে গরুটা চলছে। থামলেই ঘণ্টার আওয়াজ বন্ধ হয়, আমিও টের পেয়ে তাড়া লাগাই।’
পণ্ডিতমশাই এমন অদ্ভুত ব্যাপার আর দেখেননি; তিনি বাড়ি যাচ্ছেন আর কেবলই ভাবছেন, ‘কলুটার কি আশ্চর্য বুদ্ধি! কি কৌশলটাই খেলিয়েছে! গরুটার আর ফাঁকি দেবার যো নেই। একটু থেমেছে কি ঘণ্টা বন্ধ হয়েছে, আর কলুর পো তেড়ে উঠেছে!’
Advertisement
এই রকম ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার মনে হল, ‘আচ্ছা, গরুটা যদি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাথা নাড়ে তাহলেও তো ঘণ্টা বাজবে, তখন কলুর পো টের পাবে কী করে?’
ভট্চার্যি মশায়ের ভারি ভাবনা হলো। গরুটা যদি শয়তানি করে ফাঁকি দেয়, তা হলে কলুর তো লোকসান হয়। এই ভেবে তিনি আবার কলুর কাছে ফিরে গেলেন। গিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ হে, ঐ যে ঘণ্টার কথাটা বললে, ওটার মধ্যে একটা মস্ত গলদ থেকে গেছে। গরুটা যদি ফাঁকি দিয়ে ঘণ্টা বাজায় তাহলে কী করবে?’
কলু বিরক্ত হয়ে বললে, ‘ফাঁকি দিয়ে আবার ঘণ্টা বাজাবে কি রকম?’ পণ্ডিতমশাই বললেন, ‘মনে কর যদি এক জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে মাথা নাড়ে, তা হলেও ত ঘণ্টা বাজবে, কিন্তু ঘানি ত চলবে না। তখন কী করবে?’
কলু তখন তেল মাপছিল, সে তেলের পলাটা নামিয়ে পণ্ডিতমশায়ের দিলে ফিরে গম্ভীর হয়ে বলল, ‘আমার গরু কি ন্যায়শাস্ত্র পড়ে পণ্ডিত হয়েছে, যে তার অত বুদ্ধি হবে? সে আপনার টোলে যায়নি, শাস্ত্রও পড়েনি, আর গরুর মাথায় অত মতলব খেলে না।’
পণ্ডিতমশাই ভাবলেন, ‘তাও তো বটে। মূর্খ গরুটা ন্যায়শাস্ত্র পড়েনি, তাই কলুর কাছে জব্দ আছে।’
লেখা: সংগৃহীতছবি: সংগৃহীত
প্রিয় পাঠক, আপনিও অংশ নিতে পারেন আমাদের এ আয়োজনে। আপনার মজার (রম্য) গল্পটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়। লেখা মনোনীত হলেই যে কোনো শুক্রবার প্রকাশিত হবে।
কেএসকে/এমএস