তুরস্কের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় এলাকায় অবস্থিত ‘দার্দানিলেস প্রণালী’তে ৪.৬ কিলোমিটারের দীর্ঘ ‘চানাক্কালে ১৯১৫ সেতু’ নির্মাণ করা হয়েছে। এটিই বর্তমান বিশ্বের সর্ববৃহৎ ঝুলন্ত সেতু। বিশ্বের ১০টি দীর্ঘতম মিড-স্প্যান সেতুর মধ্যে তিনটিই তুরস্কে। এই সেতু ব্যবহার করে তুরস্কের এশীয় অঞ্চল থেকে ইউরোপীয় অঞ্চলে পৌঁছানো যাবে মাত্র ছয় মিনিটে।
Advertisement
শুক্রবার (১৮ মার্চ) তুরস্কের অন্যতম মেগাপ্রকল্প ‘১৯১৫ চানাক্কালে সেতু’ ও ‘মালকারা-চানাক্কালে হাইওয়ের’ উদ্বোধন করেন দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান।
এ সময় তিনি বলেন, এশিয়া-ইউরোপের সঙ্গে সংযোগকারী বিশ্বের দীর্ঘতম ঝুলন্ত সেতু। এমন একটি জায়গায় অবস্থিত যেখানে পারাপার হতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো। এখন মাত্র ছয় মিনিটে ইউরোপ ভ্রমণ করা যাবে। ঝুলন্ত সেতু হিসেবে জাপানকে পেছনে ফেলে তুরস্ক এখন প্রথম স্থানে। দেশটির আকাশি কাইকিও সেতুর চেয়েও দীর্ঘ।
চানাক্কালের বার্ষিকীতে বিশ্বের দীর্ঘতম ঝুলন্ত সেতুর উদ্বোধন
Advertisement
এরদোয়ান বলেন, সেতুটি তৈরি করতে ২.৫ বিলিয়ন ইউরো ব্যয় হয়েছে। এ প্রকল্পটি আমাদের অর্থনীতিতে ৫.৩ বিলিয়ন ইউরো (৫.৮ বিলিয়ন ডলার) উৎপাদনে, ১১৮ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানে ২.৪ বিলিয়ন ইউরো জাতীয় আয়ে অবদান রাখবে। বিশ্বের ১৩৪টি দেশ সেতুর মডেলটি ব্যবহার করেছিল। পাবলিক-প্রাইভেট কো-অপারেশন মডেল পারফরম্যান্সের দিক থেকে আমরা (তুরস্ক) ইউরোপে তৃতীয় ও বিশ্বে ১৩তম স্থানে আছি।
এই পদ্ধতির মাধ্যমে তুরস্ক গত ২০ বছরে শুধু পরিবহন খাতে ৩৭.৫ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটি আমাদের নিজেদের তহবিল থেকে নয়, বাইরে থেকে এনে করেছি।
চানাক্কালে ১৯১৫ সেতু
বাজেট ও সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতার কথা উল্লেখ করে এরদোয়ান বলেন, সেতুর এক স্প্যান থেকে দ্বিতীয় স্প্যানের দূরত্ব ২০২৩ মিটার, এই বিষয়টিই এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ঝুলন্ত সেতুতে রূপান্তর করেছে। এর ৩১৮ মিটার লম্বা লাল-সাদা পিলারগুলো তুরস্কের জাতীয় পতাকাকে প্রতিফলিত করে এবং সেগুলো বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু সাসপেনশন পিলার। এই সেতু তুরস্কের ভিশন-২০২৩ রূপকল্পের অংশ। এটি নির্মাণে ১০ কোটি ইউরো ব্যয় হয়েছে।
Advertisement
তিনি বলেন, ১৯১৫ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে গ্যালিপলি উপদ্বীপে গ্যালিপুলি যুদ্ধের সাথে মিলিয়ে সেতুটির নামকরণ করা হয়েছে। তুর্কি ভাষায় এ যুদ্ধ চানাক্কালে যুদ্ধ নামেও পরিচিত। তুরস্ক ও দক্ষিণ কোরিয়ান একটি কোম্পানি সেতুটি নির্মাণ করেছে। নির্মাণ তত্ত্বাবধান করেছে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ মডেল নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তুরস্কে এশিয়া ও ইউরোপকে সংযোগকারী এটি ষষ্ঠ সেতু।
সেতুর এক স্প্যান থেকে দ্বিতীয় স্প্যানের দূরত্ব ২০২৩ মিটার
এরদোয়ান তার দুই দশকের প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হিসেবে চলাকালীন বসফরাসের ওপর তৃতীয় সেতুসহ অনেক মেগা অবকাঠামো প্রকল্প চালু করেন। তিনি একটি ইস্তাম্বুল চ্যানেল নির্মাণের পরিকল্পনা করেন বলে জানিয়েছেন বসফরাসের বিকল্প হিসেবে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী কিম বু-কিউমও নতুন সেতুটিকে ‘তুরস্কের অর্থনীতির একটি প্রধান ধমনী’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, এটি মানুষ ও পণ্য চলাচলকে ব্যাপকভাবে সহজ করবে। এ সেতুটি ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ার সঙ্গে সংযোগকারী একটি আন্তর্জাতিক লজিস্টিক হাব হিসেবে তুরস্ক তার অবস্থানকে আরও দৃঢ় করতে সক্ষম করবে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী কিম বু-কিয়াম
কিম জোর দিয়ে বলেন, ১৯১৫ চানাক্কালে সেতুর সমাপ্তি ইতিহাসের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি পূর্ব-পশ্চিম পণ্য বিনিময়ে একটি নতুন পথ খুলে দিয়েছে। নির্মাণ প্রক্রিয়া চলাকালীন তুরস্ক সরকারের অটল সমর্থন, চানাক্কালে প্রদেশের কর্মকর্তাদের ও রাষ্ট্রপতি রেসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের নেতৃত্বের প্রশংসা করেন।
এ সময় কিম উভয় দেশের কোম্পানিকে প্রশংসা ও অভিনন্দন জানান। সেতু নির্মাণে যারা অবদান রেখেছেন, পরিকল্পিত তারিখের আগে ব্রিজের সফল সমাপ্তির কারণে তাদেরও অভিনন্দন জানান তিনি।
সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভাষণ দিচ্ছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান
দুটি ভ্রাতৃপ্রতিম দেশ- তুরস্ক ও দক্ষিণ কোরিয়া, যাদের রক্তের বন্ধন রয়েছে জানিয়ে কিম বলেন, ১৯৫০ সালে কোরিয়ার যুদ্ধের সময়, আমাদের দুই দেশের মধ্যে কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও, হাজার হাজার তুর্কি সৈন্য এশিয়া মহাদেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে দীর্ঘ দূরত্বে ভ্রমণ করেছে কোরিয়া প্রজাতন্ত্রকে সাহায্য করার জন্য। তখন আমরা একটি কঠিন পরিস্থিতিতে ছিলাম। কোরিয়ান জনগণ এ সত্যটি কখনই ভুলে যায়নি। একটি ঐতিহাসিক প্রতিশ্রুতি যা দুই দেশের সম্পর্ককে শক্তিশালী করে। আমরা বিশ্বাস করি যে দুই দেশের মধ্যে আমাদের সম্পর্ক চানাক্কালে সেতুর দুটি সুউচ্চ টাওয়ারের মতো পূর্ব ও পশ্চিমকে সংযোগকারী একটি শক্তিশালী স্তম্ভে পরিণত হবে।
সেতু সর্ম্পকে কিছু তথ্য
গ্যালিপোলির কিংবদন্তি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধা হিসেবে একটি আর্টিলারি শেল প্রতীকী আকারে, যা তুরস্কের চানাক্কালে নৌ বিজয় নামেও পরিচিত। স্পিয়ার টাওয়ারটি ৩১৮ মিটার (১,০৪৩ ফুট) উঁচু। মধ্যবর্তী স্প্যানটির দৈর্ঘ্য ২০২৩ মিটার (১.২৬ মাইল) স্প্যানটি ২০২৩ সালের প্রতীক, তুরস্কের প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার ১০০তম বার্ষিকী। সেতুটির মোট দৈর্ঘ্য ৪.৬০৮ কিলোমিটার (২.৯ মাইল) ও এর লাল-সাদা টাওয়ারগুলো তুরস্কের পতাকার প্রতিনিধিত্ব করে।
১৯১৫ চানাক্কালে সেতু
চানাক্কালে বিজয়ের ১০৭তম বার্ষিকী
সেতুটি চানাক্কালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৮ মার্চ ১৯১৫ সালে গ্যালিপোলি অভিযানে ব্রিটিশ ও ফরাসি সৈন্যদের বিরুদ্ধে অটোমান বাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ নৌ বিজয়ের ১০৭তম বার্ষিকীতে যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এরদোয়ান বলেন, সেতুটি ‘দারদানেল শহীদদের স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখবে।’
আগের দিন, এরদোয়ান প্রচারাভিযানের সময় নিহত সৈন্যদের স্মরণ করে বলেন, গ্যালিপোলির যুদ্ধ ছিল আমাদের জাতির সাহসীকতার সাক্ষ্য। চানাক্কালে বিজয় শুধু তুরস্কের জন্যই নয়, বলকান, মধ্যপ্রাচ্য ও অন্যান্য স্থানের সুদূরপ্রসারী অঞ্চলের জন্যও তাৎপর্যপূর্ণ। চানাক্কালে আমাদের ভাগ করাসহ ভাগিতাকে প্রকাশ করে।
১৯১৫ চানাক্কালে সেতুর কাছে এরদোয়ান
১০৬ বছর আগে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় অটোমান সাম্রাজ্যের গ্যালিপোলি অভিযানে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যুদ্ধে কয়েক হাজার সৈন্য নিহত হন। ব্রিটেন ও ফ্রান্স তাদের মিত্র রাশিয়াকে সুরক্ষিত করতে চেয়েছিল, কারণ গ্যালিপোলি উপদ্বীপ তখনকার রাশিয়ান সাম্রাজ্যের জন্য একটি সমুদ্র পথ সরবরাহ করে।
তাদের লক্ষ্য ছিল অটোমানদের তৎকালীন রাজধানী ইস্তাম্বুল দখল করা। তুরস্কের একটি নৌ আক্রমণ প্রতিহত করেছিল ও আট মাসের আক্রমণে উভয় পক্ষের হাজার হাজার হতাহত হয়েছিল। স্থল অভিযানও ব্যর্থ হলে হানাদার বাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়। মিত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে বিজয় তুরস্কের পক্ষের মনোবলকে বাড়িয়ে তোলে, যেটি ১৯১৯–১৯২২ সালে স্বাধীনতার যুদ্ধ পরিচালনা করে ও অবশেষে ১৯২৩ সালে একটি প্রজাতন্ত্র গঠন করে।
একেআর/এমআরএম/এএসএম