জাগো জবস

একবার বিসিএস পরীক্ষা দিয়েই সফল সুমন

মো. সুমন জিহাদীর জন্ম সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে। বাবা মো. শাহজাহান আলী ও মা তাসলিমা খাতুন কহিনুর। সুমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক ও যুক্তরাজ্যের এক্সেটার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি বর্তমানে উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে পদায়ন লাভ করেন। তবে এখনো পোস্টিং হয়নি। এর আগে নওগাঁ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নেজারত ডেপুটি কালেক্টর ও ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

Advertisement

সম্প্রতি তার বিসিএস জয়ের গল্প ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন জাগো নিউজকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাজেদুর আবেদীন শান্ত—

জাগো নিউজ: ছোটবেলা কেমন কেটেছে? সুমন জিহাদী: ছোটবেলা কেটেছে দুরন্ত ও উড়ন্ত। কুষ্টিয়ার পদ্মা নদীর ধারে গড়ে ওঠা গ্রামীণ লোকালয়ে বড় হয়েছি। নদীতে মাছ ধরেছি, সাঁতার কেটেছি, বিলে শাপলা-শালুক তুলেছি। সে এক অসাধারণ সময়। বন্ধুদের নিয়ে ধান কাটতে ও নাড়া উঠাতে গিয়েছি। স্কুলে যেতাম দলবেঁধে। ফেরার পথে ব্যাগ রেখে গাছে উঠে আম-জাম পারতাম। কলা গাছের ভেলা তৈরি করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নদীতে ভাসতাম। রাতে এলাকায় ঘন ঘন বিদ্যুৎ যেত। তখন সমবয়স্ক ছেলেমেয়েরা বের হয়ে লুকোচুরি খেলতাম। দৌড়াদৌড়ি করতাম। আমাদের মায়েরাও বের হতেন। গল্প করতেন। তখন বিটিভিতে মজার মজার সিরিয়াল হতো। আলিফ লায়লা, স্পেল বাইন্ডার, নাইট রাইডার, আর্থ ফাইনাল কনফ্লিক ইত্যাদি। আসলে সে সময়টি মনে হয় জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ছিল।

জাগো নিউজ: পড়াশেনায় কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল? সুমন জিহাদী: না, কোনো প্রতিবন্ধকতা সেভাবে ছিল না। আমার বাবা-মা বরং আমাদের পড়াশোনার জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। পড়াশোনাই আমাদের মুখ্য ভাবনা ছিল। আমাদের চার ভাই-বোনকেই আব্বা পড়াতেন। আম্মা আমাদের শৃঙ্খলা আর নিরাপত্তার বিষয়টি দেখতেন। সঠিক সময় খাওয়া, ঘুম, বাইরে যাওয়া, ফিরে আসা এসব। তবে হ্যাঁ, খুব স্বচ্ছল ছিলাম না আমরা। তাই অনেক সময় প্রাইভেট টিউটরের কাছে যাওয়া বা কোচিং করা হয়নি। কিন্তু আমাদের বাবা শিক্ষক হিসেবে অসাধারণ ছিলেন।

Advertisement

জাগো নিউজ: বিসিএসের স্বপ্ন দেখেছিলেন কখন থেকে? সুমন জিহাদী: একেবারে ভার্সিটির চতুর্থ বর্ষ থেকে। যখন বুঝতে শিখেছি যে, এ সার্ভিসে দারুণ বৈচিত্র্য আছে। মানুষের সাথে থেকে অনেক কিছু করার আছে। তবে ছোটবেলা থেকে মহাকাশে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। এস্ট্রনাট হওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু কীভাবে যেন সব এলোমেলো হয়ে গেছে। আসলে মধ্যবিত্ত ঘরে স্বপ্নে স্থির থাকা খুব কঠিন। কেননা এখানে স্বপ্নগুলো বর্তমান বাস্তব ও প্রেক্ষিত দ্বারা মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়। স্থির থাকা যায় না। আকাশ ভালোবাসা থেকে আমি পরবর্তীতে মহাকাশ বিষয়ক সায়েন্স ফিকশন উপন্যাসও লিখেছি বেশ কয়েকটি।

জাগো নিউজ: বিসিএস যাত্রার গল্প শুনতে চাই—সুমন জিহাদী: সত্যি বলতে বিসিএস যাত্রার আমার বিশেষ কোনো গল্প নেই। একবারই বিসিএস দিয়েছি, ৩৪তম বিসিএস। ভার্সিটিতে পড়ার সময় শেষের দিকে এসে বিসিএস পড়াশোনা শুরু করলাম। হল জীবনের সীমাবদ্ধতাগুলো অতিক্রম করে, আর্থিক সংকটকে মোকাবেলা করে জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার গল্প আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অনেক। আমিও তাদের একজন। পড়েছি, লিখেছি, ভাইভায় গুছিয়ে কথা বলতে শিখেছি এবং লক্ষ্য অর্জন করেছি। সরল অঙ্কের মতো। কিন্তু সরল অঙ্কের মতো এখানেও জটিলতা আছে, সব বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের বিষয় আছে, হতাশ না হওয়ার বিষয় আছে।

জাগো নিউজ: কততম বিসিএসের কোন ক্যাডারে আছেন?সুমন জিহাদী: ৩৪তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে আছি।

জাগো নিউজ: বিসিএসের প্রস্তুতি কেমন নিতে হয়? ভাইভার ধরন সম্পর্কে যদি বলতেন—সুমন জিহাদী: বিসিএসের প্রস্তুতি নিঃসন্দেহে বহুমাত্রিক। প্রিলিমিনারির জন্য বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞানের মতো নানা বিষয় থাকে। নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন হওয়ার কারণে এখানে সূক্ষ্ম বিষয়গুলোও নির্ভুলভাবে জানতে হয়। অল্প সময়ে সঠিক উত্তর স্পর্শ করতে হয়। এ কারণে যারা যত বেশি চর্চা করেন, যত বেশি প্রশ্ন সমাধান করেন; তারা পরীক্ষার হলে ভালো করেন। আরও একটি বিষয় হলো বুঝে বুঝে পড়তে হবে। না বুঝে পড়লে প্রশ্ন একটু ভিন্ন কোণ থেকে হলে সেটা বুঝতে পারা যাবে না। এ কারণে গ্রুপ করে পড়াশোনা, আলোচনা করে পড়াটা জরুরি।

Advertisement

লিখিত পরীক্ষার পড়ার স্টাইল বিস্তারিত। এখানে লেখার অভ্যাস জরুরি। লেখার একটি সুন্দর কাঠামো তৈরি করতে হবে। লেখার সুচনায় কী থাকবে, বিস্তারিত বডিতে কোন কোন বিষয় এলে সেটি পরীক্ষকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে এবং একটি বস্তুনিষ্ঠ লেখনি হিসেবে বিবেচিত হবে, সেটি নিয়ে ভাবতে হবে। খুব গদবাধা পয়েন্টিং না করাই ভালো। যেমন- সুচনা, বর্ণনা, উপকারিতা, অপকারিতা ধরনের না। বিষয়ের ভেতরে ঢুকে তার তাত্ত্বিক বর্ণনা, বাস্তব প্রেক্ষিক, ব্যবহারিক মাত্রাসমূহের প্রভাব, সুপারিশমালা ইত্যাদি। ভাইভায় আবার নিজের আরও একটি দক্ষতা দেখাতে হয়। সেটি হলো আলোচনা করার দক্ষতা, নিজেকে উপস্থাপন করার দক্ষতা, বিনয়ের সাথে দ্বিমত করার দক্ষতা এবং আলোচনার স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর আলোকপাত করার প্রবণতা।

ভাইভা পরীক্ষায় উপস্থিত বুদ্ধির পরীক্ষাও হয়ে যায়, হয়ে যায় নিজের মানসিকতা ও রুচির পরিচয়। পোশাক পরিচ্ছদ, বাচনভঙ্গি ও বাচনের সময় অঙ্গভঙ্গি সবই কিন্তু নজরে আসে পরীক্ষকদের। এ জন্য সে সময় নিজেকে ছাত্র হিসেবে নয় বরং একজন অফিসার হিসেবে, আগাম নেতৃত্বের সম্ভাবনাময় ব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরতে পারলে ভালো। অ্যানালাইসিস করার ক্ষমতা প্রয়োজন, সাথে থাকতে হবে প্রয়োজনীয় অনেক তথ্য। নিজ জেলা, নিজ গ্রাম, সেখানকার আর্থসামাজিক অবস্থা, সাংস্কৃতিক উপাদান, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ঘটনা সবই গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়ের জ্ঞান, আন্তর্জাতিক জ্ঞান সব নিয়েই আলোচনা হতে পারে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর শাসনামলের নানা দিক আমাদের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বড় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। তাই বঙ্গবন্ধু ও তার রাষ্ট্রদর্শন, স্বাধীনতা ও জাতি গঠনে তার অবদান সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হবে, মুখে বয়ান করার দক্ষতা থাকতে হবে।

জাগো নিউজ: কারো কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন কি? সুমন জিহাদী: অনুপ্রেরণা তো আসলে অনেকেই। কাছের মানুষ, গ্রামের মানুষ, ভার্সিটির অগ্রজ, দেশের অনেক মেধাবী ও প্রতিভাবান সবাই তো অনুপ্রেরণা। তবে বাবা-মা, ভাই-বোন, স্ত্রী-পুত্র সবাই আমার অনুপ্রেরণার উৎস। বিসিএসের বিষয়ে আমার বড় ভাই ও আমার স্ত্রী আমাকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন।

জাগো নিউজ: ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? সুমন জিহাদী: সরকারের প্রদত্ত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করব। মানুষের জন্য কিছু করার চেষ্টা করব প্রতিটি পর্যায়ে। আর লেখালেখি, সাহিত্যচর্চা, বাদ্যযন্ত্রচর্চা ও গবেষণামূলক কিছু কাজের মাধ্যমে নিজের একটি জগৎ সৃষ্টি করব, যা একান্ত আমার।

জাগো নিউজ: করোনা দুর্যোগে আপনার ভূমিকা কী ছিল? সুমন জিহাদী: আমি সরকারের নীতিমালা বাস্তবায়নে জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনের অংশ হিসেবে সম্মুখভাগে কাজ করেছি। মানুষের বাড়ি বাড়ি ত্রাণ নিয়ে ছুটেছি। সামাজিক দূরত্ব বাস্তবায়ন, লকডাউন করা, মৃতব্যক্তির সঠিক অন্তেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করা, টিকা কার্যক্রম বাস্তবায়নে কাজ করা ইত্যাদি কাজে অংশ নিয়েছি। করোনাকালে ‘এ যাত্রায় বেঁচে গেলে’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলাম। কবিতাটি ভীষণ সমাদৃত হয়। অনেকেই বলেন, করোনাকালে এটি আতঙ্কিত মানুষের মাঝে নতুন আশার সঞ্চার করেছিল। আমি সেটাকেও আমার একটি অবদান ও অর্জন বলে মনে করি।

এসইউ/এমএস