সাহিত্য

মৌতাত: মনন ও মানবতার গল্প

ইসরাত জাহান

Advertisement

অমর একুশে বইমেলা থেকে সংগ্রহ করেছি কবি নুসরাত সুলতানার ‘মৌতাত’ গল্পগ্রন্থটি। কবি বলার কারণ, আমি নুসরাত সুলতানাকে চিনতাম একজন কবি হিসেবে। আমি বরাবরই তার কবিতার বিমুগ্ধ পাঠক। ‘শহিদ সালাউদ্দিন বলছি’ কবিতাটি পড়ে শিহরিত হয়েছিলাম।

এবারে আমি গল্পকার নুসরাত সুলতানার গল্পগ্রন্থ মৌতাত পড়ে আবারও মুগ্ধ হলাম। এতো চমৎকার কন্টেন্ট, গদ্যের সুনিপুণতা আমাকে গল্পগুলোর ভেতরে নদীর স্রোতের মতো টেনে নিয়ে গেছে।

হরিৎপত্র প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত গল্পগ্রন্থে মোট নয়টি গল্প আছে। প্রথম গল্পটি অস্তিত্বে বৃষ্টি। মানসিক প্রতিবন্ধী বোনের সম্ভ্রম রক্ষায় ভাইয়ের ত্যাগ, কারাবরণ এ গল্পের উপজীব্য। আর এ ত্যাগ ঘিরেই রচিত সন্ধ্যা আর আবীরের প্রেমের বিচ্ছেদ। কিন্তু শেষ দেখায় বৃষ্টি তাদের সম্পর্কে গেঁথে দেয় চমৎকার এক অস্তিত্ব। যে অস্তিত্বের নাম সন্ধ্যার মেয়ে বর্ষা।

Advertisement

পরবর্তী গল্পটি তৃতীয় নয়ন, বেশ ম্যাচুয়েড একটি কনসেপ্ট নিয়ে লেখা গল্পটি। সহপাঠী মলি ও রাহিল বন্ধুত্বের মাঝে উড়ে আসা প্রেমে ভেসে যেতে চায় মলি। নারীসঙ্গ উপভোগকারী প্রফেসর নাজিব আযাদের সাথে। একদিকে প্রফেসর নাজীবের প্রতি চরম মোহ-মুগ্ধতা। অন্যদিকে রাহিলের প্রতি প্রগাঢ় বন্ধুত্ব, ভালোবাসা।

গল্পের একপর্যায়ে মলির প্রিয় প্রফেসরকে বাঁচাতে রাহিল নিজের জীবন বিপন্ন করে তোলে। এরপর রাহিলকে উদ্দেশ্য করে মলিকে বলতে শোনা যায়, ‘রাহিল এভাবে বুঝি হৃদয়ে তীর মেরে ফোঁটায় ফোঁটায় প্রেম ঝরাতে হয়!’ রাহিলের প্রগাঢ় ভালোবাসা ও মলির নারীসুলভ মায়ায় এক সময় ওরা ওদের গন্তব্য খুঁজে পায়। ত্রিভুজ প্রেমের এ গল্পের আঙ্গিক বিনির্মাণ এবং চরিত্র চিত্রণ বেশ চমৎকার।

মৌতাত গল্পগ্রন্থে আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে ক্রূর হাসি গল্পটি। নিবেদিতা ও প্রাঞ্জলের সোশ্যাল মিডিয়ায় পরিচয় হয়। সেখানে দুজনে প্রেমে পড়ে। প্রেমের জোয়ারে ভাসতে থাকা নিবেদিতা দেখা করতে চায় প্রিয় মানুষটির সাথে। তখন বাধা হয়ে দাঁড়ায় উচ্চতা। নিবেদিতা দৈহিক উচ্চতার চেয়েও প্রেম, মেধা সবকিছুর উচ্চতাকে প্রাধান্য দিয়ে কাছে আসে প্রাঞ্জলের। কিন্তু পুঁজিবাদী সমাজ কেবল বস্তুর মূল্যই বোঝে। প্রেমের কাছে উচ্চতাকে তুচ্ছ করে এক সময় পরিণতির আগেই নিয়তির ক্রূর হাসিতে প্রেম তার দিক হারিয়ে ফেলে।

আরও ভালো লেগেছে কুলখানি, আশ্রিতা, যুদ্ধ জন্ম। কৃষাণী গল্পটি একটু অন্যরকম। একজন নারী স্বামীর সব অন্যায় মুখ বুঁজে সহ্য করে। তালাকপ্রাপ্ত হয়ে বাবার সংসার থেকে ফিরে আসা। তারপরও খুঁজে ফেরে তার প্রতিদিনকার আটপৌরে সংসার। এই গল্পে লম্পট আব্বাস মৃধার চরিত্র গল্পকার দারুণ ফুটিয়ে তুলেছেন।

Advertisement

পরিশেষে এটাই বলবো, গল্পকার নুসরাত সুলতানার আলাদা একটি চোখ আছে। যে চোখে তিনি আশপাশের প্রতিটি বিষয় সুচারুভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। তীক্ষ্মভাবে সেগুলো তার গল্পে তুলে আনেন। গল্পে দিয়েছেন দারুণ সব বার্তা। তৃতীয় নয়ন গল্পে বলেছেন, ‘মানুষ অতীত স্মৃতি আর বর্তমানের রঙিন স্বপ্ন এই দুয়ে মিলে বাঁচে।’ ক্রূর হাসি গল্পে প্রশ্ন রেখে গেছেন, ‘মানুষ কী মানুষকে বাহ্যিক অবয়ব দিয়ে চেনে নাকি মেধা, মনন আর মানবতা দিয়ে চেনে?’

প্রত্যেকটি গল্পেই আছে দারুণ বার্তা। সব শেষে চমক। এ কারণে তার প্রতিটি গল্পই দারুণ। গল্পের চরিত্রগুলো তার বর্ণনায় অসাধারণ ভাবে প্রকাশিত হয়েছে। তবে সামনে আরও গভীর ও গদ্য সমৃদ্ধ উপন্যাস আশা করছি লেখক নুসরাত সুলতানার কাছে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক।

এসইউ/এমএস