নিত্যপণ্যের বাজারে যেন দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। আমদানি করা জিনিসের দাম বাড়ছে, দেশে উৎপাদিত পণ্যের দামও বাড়ছে। বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে কিছু পণ্যের দাম বাড়ার পেছনে যুক্তি থাকলেও দেশি পণ্যের দাম বাড়ছে অযৌক্তিকভাবেই।
Advertisement
আমাদের দেশে একশ্রেণির ব্যবসায়ী সব সময় দাম বাড়ানোর মওকা খুঁজতে থাকে। আকাশে মেঘ জমলেও তারা পণ্য মূল্য বাড়ানোর যুক্তি খুঁজে পান। লাভ করার জন্যই ব্যবসা, কিন্তু আমাদের দেশে কিছু ব্যবসায়ী লাভের নামে মানুষের পকেটের বদলে যে গলা কাটতে চান, সেটা অস্বীকার করা যাবে না। মানুষের ব্যয় বাড়ছে প্রতিদিন, কিন্তু আয় বাড়ছে না। মাথাপিছু গড় আয় বৃদ্ধির গল্প অসংখ্য মানুষের কাছে পরিহাসের মতো মনে হয়।
এক সপ্তাহের ব্যবধানে চাল, ডাল, তেল, চিনি, আটা, ময়দা, আলু, পেঁয়াজ থেকে শুরু করে মৌসুমি শাকসবজির দামও বেড়েছে। বাজারে নিত্যপণ্যের দাম অসহনীয় হওয়ায় এ মুহূর্তে মানুষের আয় বাড়ানোর পাশাপাশি উৎপাদনমুখী শিল্পে কর্মসংস্থানের কোনো বিকল্প নেই বলে কেউ কেউ মনে করছেন।
পরিস্থিতি সামাল দিতে তিনি কম খাওয়ারও হাস্যকর পরামর্শও কারও কারও মুখ থেকে শোনা যাচ্ছে। জিনিসপত্র কেনার সামর্থ্য যাদের থাকবে না, তাদের আর কম খাওয়ার পরামর্শ দিতে হবে না, তারা নিরূপায় হয়েই অনাহার-অর্ধাহারে থাকতে বাধ্য হবে।
Advertisement
রাষ্ট্রায়ত্ত বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাব অনুযায়ী, এক সপ্তাহের ব্যবধানে মোটা ও মাঝারি চালের দাম বেড়েছে। ৫০-৫৬ টাকার মাঝারি মানের চাল গতকাল ৫০-৫৮ টাকায় এবং ৪৬-৪৮ টাকার মোটা চাল ৪৬-৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
চালের দাম বাড়লে ডাল আর পিছিয়ে থাকবে কেন? এক সপ্তাহ আগে রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি বড় দানার মসুর ডালের দাম ছিল ৯৫-১০০ টাকা, যা বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ১০০-১০৫ টাকায়। মাঝারি দানার মসুর ডালের দাম ছিল ১০৫-১১০ টাকা, যা বর্তমানে ১১০-১১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি ছোলার দাম ছিল ৭০-৭৮ টাকা, যা বর্তমানে ৭০-৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাতে আটা-ময়দার দামও অনেকটা বেড়েছে। এক সপ্তাহ আগে প্রতি কেজি খোলা আটার দাম ছিল ৩৪-৩৬ টাকা, যা গতকাল বিক্রি হয়েছে ৩৫-৪০ টাকায়। ৪০-৪৫ টাকার প্যাকেট আটা ৪২-৪৫ টাকা, ৪৭-৫০ টাকার খোলা ময়দা ৪৮-৫০ টাকা এবং ৫২-৫৮ টাকার প্যাকেট ময়দা গতকাল ৫২-৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
এক সপ্তাহের ব্যবধানে পেঁয়াজের দামও কেজিপ্রতি ৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। আগে প্রতি কেজি আমদানি করা পেঁয়াজের দাম ছিল ৪০-৫৫ টাকা, যা গতকাল বিক্রি হয়েছে ৪৫-৬০ টাকায়। ১৪-২০ টাকার আলু বর্তমানে ১৮-২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
Advertisement
২ মার্চ আন্তমন্ত্রণালয়ে সভা করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ওই সভার তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে ভোজ্যতেলের মোট চাহিদা প্রায় ২০ লাখ টন। শুধু রমজান মাসে আড়াই থেকে তিন লাখ মেট্রিক টন। আমদানি হয়েছে ১৮ লাখ মেট্রিক টন এবং দেশে উৎপাদন হয় ২ লাখ ৩ হাজার মেট্রিক টন। অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে ৫ লাখ মেট্রিক টন, অপরিশোধিত পাম অয়েল প্রায় ১১ লাখ টন এবং প্রায় ২৪ লাখ মেট্রিক টন সয়াবিন বীজ (যা থেকে ৪ লাখ মেট্রিক টন অপরিশোধিত তেল উৎপন্ন হয়)। অর্থাৎ সারা বছরের চাহিদার চেয়ে ২ লাখ টন ভোজ্যতেল বেশি আমদানি হয়েছে। এ হিসাবে দেশে ভোজ্যতেলের কোনো সংকট নেই। সংকট না থাকলে দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ে কেন, তা খুঁজে বের করতে হবে। সাধারণ মানুষের স্বার্থের বিষয়টি সরকারের অগ্রাধিকার বিবেচনায় রাখতে হবে যেকোনো মূল্যে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম সহনীয় করার পন্থা ঠিক করতে রোববার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সভাপতিত্বে আন্তমন্ত্রণালয় সভায় নিত্যপণ্যের ভ্যাট-ট্যাক্স কমানোর সিদ্ধান্ত হয়। কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সভায় উপস্থিত ছিলেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম ছাড়াও বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের সচিব, পুলিশ মহাপরিদর্শক এবং বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিনিধিরা ওই সভায় অংশ নেন।
বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘মিনি কেবিনেটের মতো আলোচনা সভা হয়েছে। বিশ্বে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ছে, এর কোনো মাত্রা নেই। প্রতিদিনই দেখছি দাম বাড়ছে। সেটার প্রভাব আমাদের দেশেও এসেছে। রোজার মধ্যে অন্যান্য জিনিসেরও দাম বাড়তে পারে, সেটি মাথায় রেখেই আমরা বসেছিলাম। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তেল, গ্যাসের সরবরাহ কিছু কিছু জায়গায় কমে যাচ্ছে। গমের সরবরাহ রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে আসত, সেখানেও আমরা অসুবিধায় পড়তে পারি, দাম বাড়তে পারে। কীভাবে এটা নিয়ন্ত্রণে বা সহনীয় পর্যায়ে রাখা যায় সে জন্য সভা হয়েছে। চাল-গমের বাজার যাতে স্থিতিশীল থাকে তার জন্য আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাব।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘এখন থেকে ওএমএস কার্যক্রম বাড়ানো হবে, যাতে ন্যায্যমূল্য বা স্বল্পমূল্যে নিত্যপণ্য জনগণের হাতে পৌঁছে দিতে পারি। দ্রব্যের সাপ্লাই চেইন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করব। পণ্য যে যেখানেই মজুত রাখেন সেটা আমরা নিয়ন্ত্রণ করব। কেউ যাতে মজুত বেশি করে দাম বাড়াতে না পারে। পাশাপাশি ট্যাক্স-ভ্যাট কমানো যায় কি না আমরা সেটা নিয়েও খুব শিগগির সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছি। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ভ্যাট ও ট্যাক্স কমানো বা তুলে দেওয়া, ডিউটি কিংবা ট্যাক্স যেটাই হোক। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের ওপর অর্থাৎ ভোজ্যতেল, চিনির ওপর কতখানি কমানো যায় আমরা শিগগির একটা ঘোষণা দেব।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘রোজার অতিরিক্ত চাহিদা বিবেচনা করে ত্বরিত আমদানির ব্যবস্থা করার জন্য আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। আমরা মোটামুটি সবাইকে উৎসাহ দেব, যাতে প্রয়োজনীয় জিনিস আমদানি করে বাজার স্থিতিশীল রাখে।’
মন্ত্রীর এসব বক্তব্য আশাজাগানিয়া হলেও মানুষ আর কথায় আস্থা রাখতে ভরসা পায় না। ভালো কথা নয়, মানুষ বাজারে সরকারি উদ্যোগের প্রতিফলন দেখতে চায়। দাম সহনীয় রাখার জন্য সরকার যেসব উদ্যোগ-পদক্ষেপ নিচ্ছে মাঠপর্যায়ে তার সঠিক বাস্তবায়ন না হলে সবকিছু বাগাড়ম্বর হয়েই থাকবে।
জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা যাতে কোনো সুযোগ নিতে না পারে, সে জন্য আগামী দু-একদিনের মধ্যে একটি টাস্কফোর্স গঠনের কথা জানিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী মন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, ‘দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সুযোগ নিয়ে কোনো অসাধুতা যেন প্রশ্রয় না পায়। এজন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করব আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিয়োজিত করতে। আমরা দু-একদিনের মধ্যে টাস্কফোর্স গঠন করব, যাতে কেউ সুযোগটা না নিতে পারে। বিভিন্ন জিনিসের সরকার যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে, কেউ তার চেয়ে বেশি নিলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সংকট মোকাবিলায় টিসিবির মাধ্যমে এক কোটি মানুষকে ছয়টি পণ্য দেওয়ার চেষ্টার কথা উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেছেন, কমপক্ষে চারটি পণ্য গ্রামাঞ্চলেও পাঠানোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ঢাকা শহরে ১৫ লাখ লোক কীভাবে দেওয়া যায়, সেটার যাতে অপব্যবহার না হয় সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
লাইনে দাঁড়িয়েও অনেক মানুষ টিসিবির পণ্য পাচ্ছে না, এমনটা জানানোর পর বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আগে যেখানে দেড়শ’ ট্রাক ছিল এখন সেখানে সাড়ে চারশ’ ট্রাক নিয়ে নেমেছি। প্রতিদিন রাতারাতি তো বাড়ানো সম্ভব নয়। রোজা সামনে রেখে এক কোটি মানুষকে টিসিবির মাধ্যমে পণ্য দেওয়ার ব্যবস্থা করছি। মেশিন চাপলেই যে চলে আসবে, তা তো নয়। আমরা ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করছি।’
মানুষকে জিম্মি করে কেউ যাতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘোলাটে করার অপচেষ্টা করতে না পারে সেদিকে যেমন সতর্ক নজর রাখতে হবে, তেমনি সরকারও যেন অসৎ ব্যবসায়ী বা কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর কাছে জিম্মি না হয়ে থাকে। বামপন্থি একটি রাজনৈতিক জোট আগামী ২৮ মার্চ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে হরতাল আহ্বান করেছে। হরতাল আহ্বান করার গণতান্ত্রিক অধিকার যেমন আছে, তেমনি হরতাল পালন করা না করার অধিকারও উন্মুক্ত। হরতাল নিয়ে কোনো পক্ষেরই কোনো ধরনের বাড়াবাড়ি করা ঠিক হবে না।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক। সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা।
এইচআর/ফারুক/জিকেএস