দেশজুড়ে

মৃতপ্রায় শীতলক্ষ্যার তীর ঘেঁষাও দুষ্কর

নারায়ণগঞ্জের মূল শহরের বুক চিরে বয়ে গেছে শীতলক্ষ্যা নদী। এর পূর্বে মেঘনা, পশ্চিমে বুড়িগঙ্গা ও দক্ষিণ-পশ্চিমে ধলেশ্বরী নদী। পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদও জেলার পশ্চিম দিক দিয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ হয়ে নারাণগঞ্জ সদরে ধলেশ্বরী নদীতে মিলিত হয়েছে।

Advertisement

প্রাচীনকাল থেকেই বিশ্বজুড়ে এই নদীটির পরিচিতি রয়েছে। নারায়ণগঞ্জের প্রাণ এই শীতলক্ষ্যা বর্তমানে দখল আর দূষণে মৃতপ্রায়। দূষণের মাত্রা এতটাই যে, পানির দুর্গন্ধের কারণে নদীর ধারে কাছেও যাওয়া যায় না।

রুমার গডেনের সেই শীতলক্ষ্যার পানি এখন আলকাতরা

বিশিষ্টজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শীতলক্ষ্যা নদীকে ঘিরেই প্রাচ্যের ড্যান্ডিখ্যাত নারায়ণগঞ্জ শহর গড়ে উঠেছিল। ১৯৪৬ সালে এই নদী এবং এই শহরকে নিয়ে ইংরেজ সাহিত্যিক রুমার গডেন তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্যা রিভার’ লিখেছিলেন। পরবর্তীকালে ফরাসি চিত্রনির্মাতা জ্যাঁ রেনোয়া এর ছায়া অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। মার্গারেট রুমার গডেন ও তার বড় বোন উইনসাম রুথ কে গডেন (জন গডেন নামে লিখতেন) কিশোর বয়সে ১৯১৪ সালে বাবার কর্মসূত্রে নারায়ণগঞ্জে এসিছিলেন। দুই বোনের লেখা স্মৃতিকথা ‘টু আন্ডার দ্যা ইন্ডিয়ান সান’ এ শীতলক্ষ্যার বর্ণনা আছে।

Advertisement

‘দ্যা রিভার’র কেন্দ্রীয় চরিত্র ইংরেজ কিশোরী হ্যারিয়েটের চোখে স্রোতস্বিনী শীতলক্ষ্যার স্বচ্ছ জল, অসংখ্য জলযান, গাঙচিল-মাছরাঙার ওড়াউড়ি, নীল আকাশের যে চিত্র ফুটে উঠেছিল সেই চিত্র যেন কল্পনাতীত।

কিন্তু আজ শীতলক্ষ্যা গেলেই দেখা মিলবে উল্টো চিত্র। পানি তো নয় যেন আলকাতরা। উৎকট গন্ধে পানির ধারে কাছে থাকাই যেন দায়।

বর্জ্যের ডাম্পিং জোন শীতলক্ষ্যা

সম্প্রতি সরেজমিনে নৌকায় ও শীতলক্ষ্যা পাড় ঘুরে দেখা যায়, নদীর পাড়ে ময়লা আবর্জনার স্তূপ পড়ে আছে। এমন কোনো বর্জ্য নেই, যা শীতলক্ষ্যায় ফেলা হচ্ছে না। সেইসঙ্গে শিল্প প্রতিষ্ঠানের বর্জ্যতো বলারই অপেক্ষা রাখে না।

Advertisement

পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, শীতলক্ষ্যা ঘিরে গড়ে উঠেছে ৪১৭টি কল-কারখানা। এর মধ্যে ১০৫টি কারখানারই কোনো বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) নেই। ফলে এসব কারখানার বর্জ্য সরাসরি গিয়ে শীতলক্ষ্যায় পড়ে। বাকি ৩১২টি কারখানার নামেমাত্র শোধনাগার থাকলেও তা ব্যবহার না করার অভিযোগ রয়েছে। তারা গোপনে কৌশলে শীতলক্ষ্যাতেই দূষিত বর্জ্য ফেলে।

কল-কারখানার বর্জ্য ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের অনেক এলাকায় ডাস্টবিন না থাকায় বাসা এবং মার্কেটের ময়লার স্তূপ সড়ক-মহাসড়কের পাশে ফেলে রাখা হয়। সেই ময়লা পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের মাধ্যকে কয়েক দফা স্থান বদল হলেও একপর্যায়ে শীতলক্ষ্যায় গিয়েই পড়ে।

ব্যবহারের উপযোগিতা হারিয়েছে শীতলক্ষ্যার পানি

পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, শীতলক্ষ্যা নদীর পানিতে সহনীয় মাত্রার অক্সিজেন না থাকায় এটি জলজ প্রাণীর জন্য এখন আর উপযোগী নেই। যার কারণে নদীতে মাছও নেই। গৃহস্থালির কাজেও শীতলক্ষ্যার পানি ব্যবহারের উপযোগী নয়। পানিতে জীববৈচিত্র টিকে থাকার জন্য ন্যূনতম ৪ দশমিক ৫ মিলিগ্রাম অক্সিজেন থাকার কথা। কিন্তু শীতলক্ষ্যার পানিতে রয়েছে শূন্য দশমিক ৫ মিলিপ্রাম অক্সিজেন। বর্ষাকালে কিছুটা বেড়ে এটা ২ মিলিগ্রাম হয়ে থাকে। এমনটা হলে কোনো মৎস্য সম্পদ কিংবা জলজ সম্পদই বেঁচে থাকার জন্য প্রেয়োজনীয় অক্সিজেন পায় না।

খলিল নামে এক জেলে বলেন, বর্ষাকালে কিছুটা মাছ পাওয়া গেলেও তার জন্য বহু দূর যেতে হয়। অথচ একসময় জাল ভরে মাছ উঠতো এ নদীতেই।

মাছ ব্যবসায়ী জামাল হোসেন বলেন, আগে নদী থেকে হরেক রকমের মাছ ধরেছি। বিকেল হলেই বড়শি নিয়ে নদীর পাড়ে বসে যেতাম। কিছুক্ষণ বসলেই অনেক মাছ পাওয়া যেত। এখন মাছ তো দূরের কথা একটা সাপও দেখি না।

অরাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন ‘আমরা নারায়ণগঞ্জবাসী’র সভাপতি বীরমুক্তিযোদ্ধা নুর উদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, নারায়ণগঞ্জ নদীবেষ্টিত জেলা। জেলার সঙ্গে শীতলক্ষ্যা, বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী ও বালুনদী রয়েছে। মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীও নারায়ণগঞ্জের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কিন্তু শীতলক্ষ্যা, বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী ও বালুনদী দূষণের মাত্রা ছাড়িয়ে বিষাক্ত হয়ে গেছে। নারায়ণগঞ্জের সস্তাপুর, শিবু মার্কেট, ফতুল্লা অঞ্চল ও সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকার ডাইং ফ্যাক্টরিগুলোতে ইটিপি থাকলেও তারা খরচ কমাতে ইটিপি ব্যবহার করে না। কারো কারো ইটিপিও নেই। অন্যান্য ফ্যাক্টরির বর্জ্যও শীতলক্ষ্যাতে পড়ে। সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্যও পড়ে। সবমিলিয়ে একটা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, শীতলক্ষ্যা নদীর পানি এখন আর পানি নাই। এই নদীতে নানান প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। অনেকে শখের বশে বড়শি দিয়ে মাছ শিকার করতো। এখন আর সেই দৃশ্য দেখা যায় না। ১৯৬২ রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ শীতলক্ষ্যা নদীতে ভ্রমণ করতে এসেছিলেন। তিনি শীতলক্ষ্যার পানি দেখে অভিভূত হয়েছিলেন এবং বোতলে করে পানিও নিয়ে গেছিলেন। আর এখন শীতলক্ষ্যা নদীর কাছেও যাওয়া যায় না।

বাধাহীন দখলে সংকুচিত হচ্ছে নদী

নদীর পাড় ঘেঁষে গড়ে ওঠা বড় বড় শিল্প কারখানার বাধাহীন দখলে নদীর বিস্তৃতি সংকুচিত হয়ে আসছে। নদীর পাড়ে সীমানা খুঁটির দিকে কোনো খেয়াল নেই। নদীখেকোরা ক্রমশই তাদের থাবা বিস্তার করে চলছে। সেই সঙ্গে নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে তোলা হয়েছে অসংখ্যা অবৈধ স্থাপনা। গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ব্যবসা বাণিজ্য। মাঝে মাঝে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) অভিযানে তাদের উচ্ছেদ করলেও আবার দখল হয়ে যায়।

যা বলছে বিআইডব্লিউটিএ

বিআইডব্লিউটিএর নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দরের যুগ্ম পরিচালক শেখ মাসুদ কামাল জাগো নিউজকে বলেন, নদী দখলের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে। অবৈধ দখল উচ্ছেদ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের অভিযান চলতে থাকবে। উচ্ছেদ করার পর আবার দখল করার প্রবণতা এখন কমে আসছে। ২০১০ সাল থেকে উচ্ছেদ অভিযান চলে আসছে। তখন উচ্ছেদ করার পরও আবার দখল করে নিতো। কিন্তু পরে অভিযান ধারবাহিকভাবে চলমান থাকার কারণে তাদের অর্থ এবং সময়ের অপচয় হয়। যার কারণে আগের চেয়ে তুলনামূলকভাবে এই প্রবণতা হ্রাস পেয়েছে।

পরিবেশ অধিদপ্তর যা বলছে

পরিবেশ অধিদপ্তর নারায়ণগঞ্জের উপ-পরিচালক শেখ মোজাহিদ জাগো নিউজকে বলেন, তরল বর্জ্য নির্গতকারী প্রতিষ্ঠান যাদের ইটিপি নেই আবার যাদের ইটিপি আছে তারা সঠিকভাবে পরিচালনা করছে কিনা সেটা আমরা তিন পর্যায়ে মনিটরিং করে থাকি। একটি টিম জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে এগুলো পরীক্ষা করে দেখে যাদের ইটিপি নেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। আরেকটি টিম মোবাইল কোর্ট। যারা পরিবেশ দূষণকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা হিসেবে অভিযান পরিচালনা করে থাকে। অপরটি হচ্ছে নিয়মিত কোর্টে মামলা দায়ের। এটা আমরা নিয়মিত করে থাকি। এই মাসেও ১০টি মামলা দায়ের করেছি। গত দুই মাসে আমরা ৫টি প্রতিষ্ঠান স্থায়ীভাবে বন্ধ করার জন্য নোটিশ দিয়েছি। এগুলো বন্ধ আছে।

তিনি আরও বলেন, হাইকোকের্টর নির্দেশে অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে। আমরা ইতোমধ্যে প্রায় ৪০টি অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। সার্বিকভাবে পরিবেশবিরোধী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলমান ছিল এখন আরও জোরদার করা হয়েছে।

এফএ/জেআইএম