ফেসবুকে একজন লিখেছেন, ‘ক্রিকেটে পাপন-সাকিব আর শিল্পী সমিতিতে জায়েদ-নিপুণের দ্বন্দ্ব সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে। একটি চলছে কয়েক বছর ধরে, আরেকটি কয়েক মাস। কিন্তু দুটি ঘটনাই গোটা জাতিকে বিভক্ত শুধু নয়, বিরক্তও করে যাচ্ছে। লেবু বেশি চিপলে তিতা হয়ে যায়। এ দুটি ঘটনাও তিতা শুধু নয় রীতিমতো পচে দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে।’
Advertisement
৩৮৬ জন ভোটারের শিল্পী সমিতির নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে যা হচ্ছে, তা বাড়াবাড়ির সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এখানে সাধারণ মানুষের কোনো স্বার্থ জড়িত নয়, তবুও মানুষ বিপুল কৌতূহল নিয়ে শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক পদ নিয়ে মিউজিক্যাল চেয়ার খেলার আপডেট জানার জন্য অপেক্ষা করে। সিনেমায় দর্শকদের বিনোদন দেওয়ার সক্ষমতা অনেক আগেই হারিয়েছে এফডিসি। সাধারণ মানুষ এখন বিনোদন পাচ্ছে নির্বাচনের ফলাফল ঘিরে নাটকীয়তায়।
তবে সাকিবের সাথে ক্রিকেট বোর্ডের যে চোর-পুলিশ খেলা; তার সাথে গোটা বাংলাদেশের মানুষের আবেগ-ভালোবাসা, স্বার্থ জড়িত। দলমত নির্বিশেষে বাংলাদেশের সবাই চান, সাকিব আল হাসান বাংলাদেশের হয়ে সব ম্যাচে খেলুন। কারণ বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার দলে থাকলে বাংলাদেশের মনোবল অনেক বেড়ে যাবে। সাকিব দলে থাকা মানে একই সঙ্গে একজন ব্যাটসম্যান এবং বোলার থাকা; একের ভেতরে দুই। শেষ পর্যন্ত সাকিব দক্ষিণ আফ্রিকা যাচ্ছেন। তবে তার আগে যে নাটক হয়েছে, তা সিনেমাকেও হার মানায়।
একসময় একটা বিজ্ঞাপন প্রচারিত হতো বিভিন্ন টেলিভিশনে, ‘বাংলাদেশের জান সাকিব আল হাসান’। আসলেই সাকিব তার পারফরম্যান্স দিয়ে গোটা বাংলাদেশের জান হয়ে গেছেন। সবাই চান, সাকিব দেশের হয়ে নিজেকে উজাড় করে দেবেন, জয় ছিনিয়ে আনবেন। কিন্তু যখন দেখি সাকিব দেশের হয়ে খেলাটা উপভোগ করছেন না। বরং তার প্রায়োরিটিতে দেশের আগে থাকে আইপিএল, খেলার চেয়ে বেশি মনোযোগ থাকে ব্যবসায়, খেলার বায়োবাবল ভেঙে চলে যান বিজ্ঞাপনের শ্যুটিংয়ে, যখন বলেন বাংলাদেশের হয়ে খেলাটা তিনি আর উপভোগ করছেন না; তখন আমরা শঙ্কিত হই, আমাদের মন খারাপ হয়, আমরা ক্ষুব্ধ হই।
Advertisement
মানসিক ও শারীরিক ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে সাকিব দক্ষিণ আফ্রিকা যাচ্ছেন, এজন্য তাকে অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। একই সঙ্গে ধন্যবাদ জানাচ্ছি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনকেও। তিনি নরমে-গরমে, কৌশলে সাকিবকে খেলতে পাঠাতে পেরেছেন। তিনি আমাদের অনেক সাধারণ মানুষের মতো ক্ষুব্ধ না হয়ে, অনুরাগ-বিরাগের ঊর্ধ্বে উঠে সাকিবের সমস্যাটা মন থেকে বুঝে তার পাশে দাঁড়িয়েছেন।সাকিব ক্রিকেট বোর্ডের চুক্তিভুক্ত খেলোয়াড়। তিনি যেমন দলের হয়ে খেলতে বাধ্য। আবার প্রয়োজনে ছুটি নেওয়ার অধিকারও তার আছে। বিশ্বের অনেক দেশের ক্রিকেটাররাও প্রয়োজনে ছুটি পান। তবে সাকিবের ছুটি নিয়ে এত জল ঘোলার কারণ, তিনি তার এই ছুটির অধিকারের অপব্যবহার করেছেন। ছুটি নিয়ে তিনি আইপিএল খেলেছেন, বিজ্ঞাপনের শ্যুটিং করেছেন। আর মাঠে বাংলাদেশ নাস্তানাবুদ হয়েছে।
বারবার ছুটিতে থাকা সাকিবের অভাব অনুভূত হয়েছে তীব্রভাবে। তবে ছুটি নিয়ে সাকিবের এবারের নাটক ছাড়িয়ে গেছে আগের সব নাটকীয়তা। আইপিএল খেলবেন বলে এবারও দক্ষিণ আফ্রিকা সফর থেকে ছুটি নিয়েছিলেন সাকিব আল হাসান। কিন্তু আইপিএলে কোনো দল না পাওয়ায় তার খেলার সম্ভাবনা তৈরি হয়। সাকিবের সাথে কথা বলেই দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের দলে তাকে রাখা হয়। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকা রওয়ানা হওয়ার চারদিন আগে বিজ্ঞাপনের শ্যুটিংয়ের জন্য দুবাই যাওয়ার আগে বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের জানান, তিনি দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যাওয়ার জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত নন।
এ অবস্থায় যাওয়া দলের অন্য সদস্যদের সঙ্গে প্রতারণার শামিল। অন্তত ওয়ানডে সিরিজে তিনি খেলতে চান না। পরে বোর্ডকে জানান, তিনি টেস্টও খেলতে চান না। তার মানে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরেই যেতে চান না। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বোর্ড সভাপতির কণ্ঠেও ছিল ক্ষোভ। তিনি বলে দেন, তারা যে সিদ্ধান্ত নিতে চান, তা সবার ভালো নাও লাগতে পারে। বোর্ড সভাপতি এও বলে দেন, আইপিএলে দল পেলে নিশ্চয়ই সাকিব ক্লান্তির কারণে সেখানে যাওয়া থেকে বিরত থাকতেন না। পরদিন বোর্ডের পরিচালক খালেদ মাহমুদ সুজনও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছিলেন, সাকিব ইস্যুতে ফুলস্টপ দেওয়ার সময় এসেছে।
বোর্ড সভাপতি ও পরিচালকের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় ক্ষোভ থাকলেও সাকিবের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তারা নির্মোহ ছিলেন, কৌশলী ছিলেন। সাকিব চেয়েছিলেন ‘ছুটি’, বোর্ড তাকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ‘বিশ্রাম’ দেয়। বিশ্রামের সময় তিনি কোনো প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট খেলতে পারবেন না, অন্য কোনো বাণিজ্যিক কাজেও অংশ নিতে পারবেন না। ছুটির বদলে বিশ্রাম আসলে সাকিবের ওপর এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপ দেওয়ার জন্যই।
Advertisement
বিশ্রাম নেওয়ার পরদিনই এ বছরের চুক্তির তালিকা ঘোষণা করা হয়। সেখানেও তিন ফরম্যাটেই সাকিবকে রাখা হয়। আমার ধারণা এটাও সাকিবের ওপর এক ধরনের চাপ প্রয়োগের জন্যই করা। আমার বিশ্বাস, এই কৌশলের খেলায়ই সাকিবকে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে পাওয়া গেছে। অনেকে এই কৌশলের খেলায় হারজিত হিসাব করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু ব্যাপারটা জয়-পরাজয়ের নয়। সাকিবকে পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত জিতেছে বাংলাদেশ ক্রিকেটই।
মাঠে এবং মাঠের বাইরে সাকিব খুব হিসাবি মানুষ। আইপিএলে দল না পাওয়ায় সাকিবের কমপক্ষে দুই কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। লম্বা বিশ্রামের ফাঁদে পড়ে মোহামেডানের হয়ে ডিপিএল খেলতে না পারলে সেখানেও এক কোটি টাকা ক্ষতির ঝুঁকি। আর সাকিবের প্রতি আমাদের ভালোবাসা তিনি দেশের হয়ে খেলেন বলেই। কিন্তু তিনি যদি দিনের পর দিন, সিরিজের পর সিরিজ দলের হয়ে নাই খেলেন; তাহলে সেই ভালোবাসার জোয়ারে ভাটার টান পড়বে। আর ভালোবাসা কমে গেলে কমে যাবে বিজ্ঞাপনের চাহিদাও। সেখানে আর্থিক ক্ষতির ঝুঁকি।
তারচেয়ে বড় কথা এবারের ছুটি চাওয়াটা এতটাই নজিরবিহীন ছিল যে, এবার বেশিরভাগ মানুষ, এমনকি সাকিবকে যারা ভালোবাসেন; তারাও তার সমালোচনা করেছেন। সবমিলিয়ে হিসাবী সাকিব হিসাব মিলিয়ে দেখেছেন, এবার দক্ষিণ আফ্রিকা না গেলে ক্ষতির পরিমাণটা অনেক বেড়ে যাবে। তাই সাকিব দেরিতে হলেও দক্ষিণ আফ্রিকায় দলের সাথে যোগ দিচ্ছেন, এটাই আমাদের প্রাপ্তি, আমাদের অত হিসাবে কাজ নেই।
সাকিবকে নিয়ে ক্রিকেট বোর্ড সত্যিই বিপদে আছে। যত যাই করুন, সাকিব শেষ পর্যন্ত দেশের সেরা পারফরমার। তাই শৃঙ্খলার দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনায় নিলে তার বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, সেটা তারা নিতে পারেন না। সাকিবকে বাদ দিলে আন্দোলন হবে। এটা সাকিবও জানেন, তাই এই সুযোগটাই তিনি বারবার নেন। আমি নিশ্চিত, সাকিব বারবার ছুটিছাটা এবং শৃঙ্খলা ইস্যুতে যা করেন, দলের অন কেউ করলে এতদিনে তার ক্যারিয়ারে ‘ফুলস্টপ’ পড়ে যেতো। কিন্তু দলের সবার জন্য সমান নিয়ম থাকা উচিত। সাকিবের কারণে দলে এই সমতাটা প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না বিসিবি। সাকিব থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে যদি নতুনরাও তার মতো আচরণ করতে চায়, দলে আর কোনো শৃঙ্খলা থাকবে না। ক্রিকেটপ্রেমী প্রধানমন্ত্রীও সাকিব আল হাসানকে পছন্দ করেন। অনেকে মনে করেন, এটাও সাকিবের ব্যাপারে কোনো যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার পথে অন্তরায়। তাই বোর্ডকে একটু কৌশলী হতেই হয়।
তবে শুধু প্রধানমন্ত্রী নন, আমরাও সাকিবকে পছন্দ করি, ভালোবাসি। সাকিবকেও এই ভালোবাসার মূল্য দিতে হবে। সামর্থ্যের শেষ বিন্দু দিয়ে দেশের হয়ে খেলতে হবে। সাকিব যতই ভালোই খেলুন, তিনি দেশ বা দলের চেয়ে বড় নন। সাকিবের প্রায়োরিটি তালিকায় আইপিএল, বিপিএল, বিজ্ঞাপন, ব্যবসা সবকিছুর পাশাপাশি সবার ওপর যেন বাংলাদেশ থাকে। সাকিবকে নিয়ে বিতর্ক যেন এবার শেষ হয়, নতুন করে যেন আর কোনো বিতর্ক তৈরি না হয়।১৩ মার্চ, ২০২২
লেখক : বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।
এইচআর/ফারুক/জিকেএস