গাইবান্ধা জেলা শহরের আসাদুজ্জামান গার্লস হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে পাঠদান চলছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির ভবন এতই ঝুঁকিপূর্ণ যে, সবসময় দুর্ঘটনার আতঙ্কে থাকেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। তবে ভবনটি দূর থেকে দেখে বিষয়টি বোঝার উপায় নেই, কিন্তু ভেতরে গেলে চোখে পড়ে ছাদে ও দেওয়ালের পলেস্তারা খসে পড়ার চিত্র। দেখা মেলে আরসিসি পিলার ও গ্রেট বিমগুলোতে বিস্তৃত ফাটল। দোতলা এই ভবনে ২২ কক্ষের পাঁচটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। অবশিষ্ট ১৭টি কক্ষের প্রায় সবগুলোই ঝুঁকিপূর্ণ। বিকল্প কোনো ব্যবস্থা না থাকায় বাধ্য হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন জেনেও সেখানে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। এ কারণে সন্তানদের স্কুলে পাঠিয়ে আতঙ্কে থাকেন অভিভাবকরাও।
Advertisement
পৌর শহরের ডিবি রোডে ১ নম্বর ট্রাফিক মোড় এলাকায় ১৯৬৬ সালে এক একর জমির ওপর আসাদুজ্জামান গার্লস হাইস্কুলটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৬৮ সালে ২২ কক্ষের দ্বিতল ভবনটি নির্মাণের পর থেকে এখানেই স্কুলের কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। এরপর ১৯৯৬ সালে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের ফ্যাসিলিটিজ ডিপার্টমেন্ট তিনতলা ভিতবিশিষ্ট তিনকক্ষের একটি একতলা ভবন নির্মাণ করে। পরে প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব অর্থায়নে দোতলার কাজ সম্পন্ন করা হয়।
২০০৩ সালে স্কুলটিতে কলেজ শাখা চালু করা হয়। এরপর ২০১৬ সালে তিনতলা ভিতবিশিষ্ট তিনকক্ষের আরও একটি একতলা ভবন নির্মাণ করে জেলা পরিষদ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে স্কুল শাখায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ হাজার ৫০ জন আর কলেজ শাখায় রয়েছে সাড়ে তিনশ শিক্ষার্থী। স্কুল শাখায় শিক্ষক রয়েছেন ২০ জন এবং কলেজ শাখায় শিক্ষক আছেন ১১ জন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ১৯৬৬ সালে নির্মিত এ বিদ্যালয় ভবনে ২০০৮ সালে ত্রুটি দেখা দেওয়ার পর ধীরে ধীরে শ্রেণিকক্ষগুলো জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। ছাদ ও দেওয়ালের পলেস্তারা খসে পড়ছে। বৃষ্টির সময়ে ছাদ চুয়ে পানি পড়ছে মেঝেতে। অনেক কক্ষের দরজা-জানালা নেই। ফলে সবসময় দুর্ঘটনার আতঙ্কে থাকেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। অবস্থা দিনদিন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। পাঠদান চালু রাখার স্বার্থে ঝুঁকিপূর্ণ ১৭টি কক্ষেই চলছে পাঁচটি শ্রেণির ক্লাস।
Advertisement
বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, স্কুল কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ১৯৬৮ সালে স্কুলের উত্তর ও পশ্চিম অংশজুড়ে ২২ কক্ষের দুইতলা ভবন নির্মাণ করা হয়। এই ভবনে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির ক্লাস নেওয়া হয়। এর মধ্যে নিচতলার একটি কক্ষে অধ্যক্ষ বসেন, দুইটি সহকারী শিক্ষকদের বসার কক্ষ, একটি অফিস কক্ষ, একটিতে লাইব্রেরি, একটি নামাজ ঘরসহ সাতটি শ্রেণিকক্ষ রয়েছে। এই সাতটি শ্রেণিকক্ষের দুইটি ২০১৬ সালে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। অবশিষ্ট পাঁচটিকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ওপর তলার নয়টি কক্ষের তিনটিকে ২০০৮ সালে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। অবশিষ্ট ছয়টিকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও কক্ষগুলোতে এখনো শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা হচ্ছে।
শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আরসিসি পিলার ও গ্রেট বিমগুলোতে বিস্তৃত ফাটল দেখা দেওয়ায় ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। শিক্ষার্থীরা ভয়ে ভয়ে ক্লাস করে থাকে। ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় অনেক অভিভাবক তাদের ছেলেমেয়েকে বিদ্যালয়ে আসতে দিতে চান না।
দশম শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী জান্নাতুল মাওয়া জানায়, ভবনে ফাটল দেখা দিয়েছে। ছাদের পলেস্তারা খসে পড়ে। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনটিতে তারা ভয়ে ভয়ে ক্লাস করে।
শিক্ষক মৃণাল কান্তি সরকার বলেন, প্রায় ১২ বছর ধরে ঝুঁকি নিয়ে পাঠদান করতে হচ্ছে। যে কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তারা শিক্ষার্থীদের নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন। অনেকে তাদের ছেলেমেয়েদের বিদ্যালয়ে আসতে দিতে চান না। এতে দিনদিন শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমছে।
Advertisement
এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. ইদ্রিস আলী সরকার বলেন, বর্তমানে বিদ্যালয়ের মূল ভবন বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। যে কারণে ভয়ে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে আসতে চায় না। অবকাঠামোগত উন্নয়ন করে শিক্ষার মৌলিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা না গেলে শিক্ষার্থীরা আরও স্কুলবিমুখ হবে এবং ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়তেই থাকবে। দ্রুত এ বিষয়ে একটি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে বিকল্প পাঠদানের পদক্ষেপ নিতে গত বছরের অক্টোবরে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে জেলা প্রশাসক, পৌরসভার মেয়র, গণপূর্ত বিভাগ ও জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে লিখিত আবেদন দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে স্থানীয় সংসদ সদস্য, জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) ঝুঁকিপূর্ণ ভবনটি পরিদর্শন করেছেন।
এ বিষয়ে বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি শাহ মাঈনুল ইসলাম বলেন, পুরো ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে বিকল্প কোনো ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষর কাছে আবেদন করা হয়েছে। জেলা শিক্ষাপ্রকৌশল বিভাগের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়েছে। এখনো কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে রাখা সম্ভব নয়। যে কোনো সময় বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
তিনি আরও বলেন, দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয়রাও বিদ্যালয়ের এ দুরবস্থা থেকে উত্তরণের দাবি জানিয়ে আসছেন।
জানতে চাইলে গাইবান্ধা শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. বেলাল আহম্মেদ বলেন, গতমাসে (ফেব্রুয়ারি) ভবনটি পরিদর্শন করা হয়েছে। পরিদর্শন শেষে ভবনটি ভেঙে ফেলে জন্য একটি প্রতিবেদন গাইবান্ধা পৌরসভার মেয়র বরাবর দেওয়া হয়। পরে সেই প্রতিবেদন নিয়ে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে আলোচনা সভা হয়।
তিনি আরও বলেন, এখন এই ভবনটি ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণে স্থানীয় সংসদ সদস্য ডিও লেটার দিলে আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে পারবো।
এমআরআর/জিকেএস