আমাকে কেউ যদি প্রশ্ন করে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করে আইন পাস করার পরেও ধর্ষণ বন্ধ বা না কমার কারণ কী? একবাক্যে এর উত্তর হবে, বিচারহীনতা। বাংলাদেশে প্রতিদিন/প্রতিমাসে/প্রতিবছরে যে পরিমাণ ধর্ষণ, ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা বা ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে তার কত অংশের মামলা হয় বা মামলা পরবর্তী বিচার নিশ্চিত হয় সেই পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়।
Advertisement
কিছুদিন পরপর একটি করে ধর্ষণের ঘটনা সামনে আসে বা আলোচনায় আসে আর আমরা সচেতন হয়ে উঠি এই নিয়ে আলোচনায়। হয়তো আসামী গ্রেফতার পর্যন্তই সেইসব আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকে। তারপর কোন মামলার কী হয় সে খবর আর আসে না আমাদের সামনে।
জামালপুরের স্কুলছাত্রী ১৬ বছর বয়সী আশামনি। স্কুলে আসা যাওয়ার পথে তাকে বিরক্ত করতো একটি বখাটে ছেলে। আমাদের সমাজে নারীদেরকে স্কুল কলেজে আসা যাওয়ার পথে টিজ করা বা বিরক্ত করা একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এটিকে প্রতিরোধের বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনের যেন কোন মাথাব্যথা থাকে না। স্থানীয় কর্তারা যতটা সচেতন থাকেন কোন ছেলে মেয়ে কোথায় বসে গল্প করছে বা কোন ছেলে বড় চুল রাখলো এই নিয়ে তার সিঁকি ভাগও নারী ইস্যুতে এগিয়ে আসে না।
আশামনিকে স্কুলে যাওয়ার পথে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করেছে তামিম নামের এক যুবক। ঘটনার পরবর্তী সময়ে বাসায় এসে একটি সুইসাইডাল নোট লিখে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় আশামনি। আশামনির পিতার করা মামলায় অভিযুক্ত তামিমকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। আশার সংবাদ কিন্তু মামলার তুলনায় বিচার পাওয়ার সংখ্যার দিকে তাকালে আমাদের আশার ফুলটি আগুনে পোড়া ধবংস্তুপের মত হয়ে যায়।
Advertisement
কী লেখা ছিলো আশামনির সেই চিঠিতে? চিঠিতে আশামনি বিচারের আবেদন করে গেছে। চিঠিতেই জানা যায় ছেলেটি এলাকার কোন এক চেয়ারম্যানের ভাতিজা। অর্থাৎ, গ্রামে তারা প্রতাপশালী। তুলে নিয়ে যাওয়া এবং সারাদিন আটকে রেখে ধর্ষণের পিছনে এই ক্ষমতার গরমও কাজ করেছে। খোঁজ নিলে হয়তো এই তামিমের আরও অনেক ধরনের অপরাধের খোঁজ পাওয়া যাবে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আশামনির শেষ ইচ্ছা কি পূর্ণ হবে? পরিসংখ্যান ছাড়াও বলা যায় যতগুলো ধর্ষণের মামলা হয়েছে তার মধ্যে অতি সামান্যই বিচারের মুখ দেখেছে। ধর্ষণের ঘটনা ও ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার ঘটনার সংখ্যা জানা গেলেও কতগুলো মামলার বিচার হয়েছে এই সংক্রান্ত সঠিক তথ্য এখনও কোথাও পাওয়া যায়নি। পুঁথিগত পরিসংখ্যান বাদ দিলেও গত তিন/চার বছরে যে কয়টি ধর্ষণ বা ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা বা আত্মহত্যার ঘটনা সামনে এসেছে তার একটিরও বিচারের সংবাদ আমাদের কাছে আসেনি। তাই সাদা চোখেই বলে দেয়া যায় অন্যান্য ঘটনার মত হয়তো আশামনির ঘটনাও মামলাজটে আটকে থাকবে বা হয়তো ক্ষমতার বলে আসামী খালাসও পেয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশের নারী সমাজ এখনও পর্যন্ত সাহসী কিন্তু সামাজিক বাস্তবতা তাদেরকে কতদিন সাহসী হতে দিবে এটি একটি বড় আশংকার বিষয়। চারদিকে নারী নির্যাতনের ঘটনা বেড়েই চলেছে। ধর্মের নামে ফতোয়া দিয়েও চলছে নারীদের গৃহকোণে আটকে রাখার ফন্দি। রাস্তাঘাটে নারীরা নিজের মত করে চলতে ফিরতে পারছে না। সরকার একদিকে বলছে নারীর ক্ষমতায়ন, নারীদেরকে সবকাজে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছে অথচ নারীদের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না। কর্মস্থল, গণপরিবহন, নিজের বাসা, বিদ্যালয়, মাদ্রাসা কোথাও নারীরা নিরাপদ নয়।
কোন একটি ঘটনা ঘটলেই অপরাধীর অপরাধকে ছাপিয়ে সামনে চলে আসে নারীর কী দোষ ছিলো সেটি। এই যে ভিক্টিম ব্লেইমিং এর একটি সংস্কৃতি আমাদের সমাজে সুকৌশলে চালু করা হয়েছে এটিকে মোকাবিলার জন্য কোন অস্ত্র হাতে নেই। ধর্ষণ ঘটলেও ধর্ষকের চেয়ে প্রাধান্য পায় নারীটি কোন পোশাকে ছিল- জাতীয় আলোচনা বা কেন নারীরা এতো খোলামেলা চলাফেরা করবে। এই মানসিকতা কি কেবল সাধারণ মানুষের মধ্যে? না। এই কুৎসিত মানসিকতা পোষণ করে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজনও। মিডিয়া থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিটি স্তরে নারীকে কেন্দ্র করে যে মানসিকতার প্রকাশ ঘটে সেই সাংস্কৃতিক লড়াইটা নেই এখন আর।
Advertisement
অনেক লেখা হচ্ছে, আলোচনা হচ্ছে। প্রতিবছর নারী দিবস এলেই সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে নারীর ক্ষমতায়ন, লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণ ইত্যাদি ভারী ভারী বিষয়ে বক্তব্য আসে সামনে। অথচ, আশামনিরা কেন নিজের জীবন বিলিয়ে দিচ্ছে পরিবারের সম্মান রক্ষার্থে সেটি নিয়ে ভাবছি না আমরা কেউ। আশামনির কীসের লজ্জা ছিল? কেন তাকে এভাবে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হলো? কারণ, বাচ্চা মেয়েটি দেখেছে সমাজে ধর্ষকের কোন সমস্যা হয় না কিন্তু ধর্ষণের শিকার হওয়া নারীটিসহ তার পরিবারকে নানাভাবে হেয় করা হয়। আশামনি দেখেছে এই সমাজে নারীদের কোন মর্যাদা নেই।
আজকে যদি ধর্ষণের অপরাধে দুই একজনের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা যেত তাহলে হয়তো আশামনিরা সাহসের সাথে লড়তে পারতো। নিজে রুখে দাঁড়িয়ে বিচার চাইতে পারতো। ধর্ষণে একজন নারীর কিছুই হারায় না কিন্তু ধর্ষকের হারানোর আছে অনেক কিছু। সমাজে ধর্ষকদের লজ্জা থাকা উচিত। আমরা নারীরা আশাহত হই যখন দেখি আমাদের কন্যারা এভাবে সুইসাইডাল নোট রেখে যায়। আমাদের লজ্জা হয় সভ্য ও উন্নত দেশের নাগরিক পরিচয় দিতে যখন আশামনিরা জীবনের বিনিময়ে বিচারের দাবি রেখে যায়।
লেখক: কলামিস্ট, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট।
এইচআর/জেআইএম