জাতীয়

বিড়ি শ্রমিকদের আন্দোলন ‘মালিকদের সাজানো’

বাংলাদেশে প্রতিবছর বাজেট ঘোষণার আগে বিড়ির ওপর করবৃদ্ধি ঠেকাতে শ্রমিকদের আন্দোলন করতে দেখা যায়। এমনকি বাজেট পাস হওয়ার পরেও এই আন্দোলন চলতে থাকে। অথচ বিড়ি শ্রমিকদের এই আন্দোলন স্বতঃস্ফূর্ত নয়, মালিকদের সাজানো। গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) পরিচালিত ‘বাংলাদেশে বিড়িশ্রমিক আন্দোলনের কারণ অনুসন্ধান: একটি গুণগত বিশ্লেষণ’ শীর্ষক গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে।

Advertisement

বাংলাদেশে বিড়ি শিল্পের নিবিড়তা, শ্রমিক আন্দোলন সংঘটনের প্রবণতা এবং তীব্রতার ওপর ভিত্তি করে লালমনিরহাট, রংপুর, পাবনা এবং কুষ্টিয়ায় ২০২১ সালে গবেষণা কার্যক্রমটি পরিচালিত হয়। বিড়ি শ্রমিক, শ্রমিক নেতা এবং স্থানীয় সুশীল সমাজ ও সংগঠন থেকে উদ্দেশ্যমূলক নমুনায়নের ভিত্তিতে মোট ৯২ জনকে এই গবেষণার জন্য নির্বাচন করা হয়।

শনিবার (১২ মার্চ) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে প্রজ্ঞা এবং অ্যান্টি টোব্যাকো মিডিয়া অ্যালায়েন্স (আত্মা) এই গবেষণার ফল প্রকাশ করে। ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস্ (সিটিএফকে) এই গবেষণায় সার্বিক সহায়তা দিয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, বিড়ি শ্রমিকদের এই আন্দোলন আয়োজনের পুরো দায়িত্বে থাকে মালিকপক্ষের কিছু লোক এবং বিড়ি কোম্পানির মার্কেটিং অফিসার ও এজেন্টরা। বিক্ষোভ সমাবেশ ও মানববন্ধন কর্মসূচিগুলোতে তথাকথিত শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে কোম্পানির লোকজনও বক্তব্য দেন। শ্রমিকদের কাজ শুধু রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা। মূলত সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিড়ি শ্রমিকদের ঢাকায় নিয়ে আসেন বিড়ি কোম্পানির মালিকরা। আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য শ্রমিকদের পরিবহন, খাবারসহ সব ব্যয় মালিক পক্ষ বহন করে। নিজস্ব অর্থ দিয়ে এসব আন্দোলনে অংশ নেওয়ার সামর্থ্য দরিদ্র বিড়ি শ্রমিকদের নেই। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং জাতীয় তামাকবিরোধী মঞ্চের আহ্বায়ক ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, গবেষণার ফলাফলের সঙ্গে আমি একমত। এটা একটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ খাত। সরকারের উচিত হবে এই শিল্পকে নিরুৎসাহিত করা।

রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে প্রজ্ঞা এবং আত্মা আয়োজিত অনুষ্ঠানে গবেষণার ফল প্রকাশ করা হয়

Advertisement

অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে সিটিএফকে বাংলাদেশের লিড পলিসি অ্যাডভাইজর মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, শ্রমিক শোষণের বড় উদাহরণ বিড়ি শিল্প। কর বৃদ্ধি ঠেকাতে সাজানো আন্দোলনে প্রকৃত লাভবান হয় মালিক পক্ষই।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রাক্তন চেয়ারম্যান ড. নাসির উদ্দিন আহমদ বলেন, বিড়ি শ্রমিকদের আন্দোলন যে সাজানো সে বিষয়ে আমি শতভাগ একমত। কারণ এনবিআর চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় আমি এগুলো দেখেছি।

জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের সমন্বয়কারী ও অতিরিক্ত সচিব হোসেন আলী খোন্দকার বলেন, বিড়ি শিল্পে শিশু শ্রম বন্ধ করতে কঠোর মনিটরিং করতে হবে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) রিসার্চ ডিরেক্টর ড. মাহফুজ কবীর বলেন, স্বল্প আয়ের মানুষেরাই বিড়ির প্রধান ভোক্তা। উচ্চ হারে করারোপ করে বিড়ির ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে হবে। গবেষণায় দেখা গেছে, বিড়ি শ্রমিকদের এই আন্দোলনে প্রকৃত লাভবান হন মালিকরাই। ২০১৯ সালে বিড়ি শ্রমিকদের আন্দোলনের ফলে বিড়ির ওপর বর্ধিত কর প্রত্যাহার করে নেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। ফলে এক হাজার শলাকা বিড়িতে মালিকদের আয় বৃদ্ধি পায় ২৮ টাকা। অথচ শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো হয় প্রতি হাজারে মাত্র ৬ টাকা। বাজেটে বিড়ির শুল্ক না বাড়িয়ে কেবল খুচরামূল্য বৃদ্ধি করায় ২০১৮-২০২০ এই তিন বছরে প্রতি এক হাজার শলাকায় মালিকদের মুনাফা বেড়েছে ১১৮ দশমিক ৮ টাকা। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিড়ির ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে বিড়ির ওপর উচ্চহারে করারোপের সুপারিশ করা হয় গবেষণায়। একই সঙ্গে বর্ধিত কর থেকে আহরিত রাজস্ব বিড়ি শ্রমিকদের পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ব্যয় করা, কর আইন ও শ্রম আইন বিশেষত শিশুশ্রম ব্যবহার সংক্রান্ত আইন প্রতিপালনে বিড়ি শিল্পকে কঠোর মনিটরিংয়ের আওতায় আনা এবং বিড়ি শিল্প মালিকদের বিকল্প ব্যবসায় যেতে সরকারের পক্ষ থেকে ঋণসহ অন্যান্য সহযোগিতা প্রদানের সুপারিশ করা হয়। আত্মার কো-কনভেনর নাদিরা কিরণের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেন প্রজ্ঞার হাসান শাহরিয়ার। আত্মার কনভেনর মর্তুজা হায়দার লিটন, গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের (জিএইচএআই) কান্ট্রি লিড মুহাম্মদ রুহুল কুদ্দুস, প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়েরসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিনিধি এবং তামাকবিরোধী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন।

Advertisement

এমওএস/কেএসআর/এমএস