ইউক্রেন আক্রমণের জেরে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত দেশে পরিণত হয়েছে রাশিয়া। পশ্চিমা দেশগুলো গণহারে নিষেধাজ্ঞা দিলেও মস্কোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে এশিয়ার হাতেগোনা কয়েকটি দেশ। ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের প্রতিবাদ জানায়নি চীন, কোনো নিষেধাজ্ঞাও দেয়নি। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, লাওস, মঙ্গোলিয়ার মতো দেশগুলো জাতিসংঘে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আনা নিন্দা প্রস্তাবে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
Advertisement
তবে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ানের মতো পশ্চিমা মিত্ররা রাশিয়ার ওপর বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপের অনুকরণে সুইফট গ্লোবাল পেমেন্ট সিস্টেম থেকে রাশিয়ার কয়েকটি ব্যাংককে বাদ দিয়েছে টোকিও এবং সিউল। তবে মস্কোর গায়ে তাদের এই নিষেধাজ্ঞার আঁচ লেগেছে খুব সামান্যই। কারণ, পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন নিষেধাজ্ঞায় এশিয়ার যে কয়টি দেশ ও অঞ্চল যোগ দিয়েছে, রাশিয়ার বৈশ্বিক বাণিজ্যে তাদের অংশ মাত্র আট শতাংশের মতো।
আন্তর্জাতিক থিংক ট্যাংক ইনস্টিটিউট ফর পলিসি, অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্সের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সৈয়দ মুনির খসরুর মতে, এশিয়ার দুই জায়ান্ট চীন ও ভারতকে নিষেধাজ্ঞাদাতার কাতারে না আনলে মস্কোর ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ, রাশিয়ার বৈশ্বিক বাণিজ্যের ১৮ শতাংশের জন্য দায়ী এ দুটি দেশ।
তাছাড়া, আট বছর আগে ক্রিমিয়া দখলের পর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিল রাশিয়া। তখন থেকেই মস্কো এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা সামলাতে প্রস্তুতি নিয়েছে। মুনিরের কথায়, ২০১৪ সালের পর বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের অংশ হিসেবে মার্কিন ডলারের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে স্বর্ণ এবং চীনা ইউয়ানে ঝুঁকতে শুরু করে রাশিয়া।
Advertisement
গ্যাস জায়ান্ট গ্যাজপ্রমসহ রাশিয়ার বহু ব্যাংক ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বর্তমানে লেনদেনের ক্ষেত্রে চীনা মুদ্রা ইউয়ান ব্যবহার করছে। আর এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে।
চীনের নীরবতার কারণ কী?বেইজিংয়ের জন্য বিষয়টি রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার মূল্য চুকানো অথবা এ থেকে ফায়দা নেওয়ার কৌশল মাত্র। চীন আগে থেকেই রাশিয়ার বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। তার ওপর ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরুর কয়েক সপ্তাহ আগে রাশিয়া থেকে গম আমদানিতে বিধিনিষেধ তুলে নেয় বেইজিং এবং আরও বেশি গ্যাস আমদানির জন্য ৩০ বছর মেয়াদী চুক্তি করে।
জাতিসংঘ ও রাশিয়ায় সিঙ্গাপুরের সাবেক রাষ্ট্রদূত বিলাহারি কৌসিকানের মতে, চীনের উদ্দেশ্য তিনটি। প্রথমত, তিব্বত, জিনজিয়াং ও তাইওয়ানের কারণে চীন সার্বভৌমত্ব, আঞ্চলিক অখণ্ডতা এবং হস্তক্ষেপ না করার মতো আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কিছু নীতিতে বেশ সংবেদনশীল।
তিনি বলেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন এই নীতির চরম লঙ্ঘন হলেও সেক্ষেত্রে দ্বিতীয় উদ্দেশ্য রয়েছে। চীনের অন্য কোনো অংশীদারের কৌশলগত গুরুত্ব রাশিয়ার ধারেকাছেও নেই।
Advertisement
তাছাড়া, পশ্চিমা-আধিপত্যপূর্ণ আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায়ও অস্বস্তি রয়েছে চীনের। তাদের কাছে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও জাপানের বাজার রাশিয়ার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সে কারণে পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতেই বেশি আগ্রহী বেইজিং।
কার পক্ষে ভারত?ভারত-ভিয়েতনামের জন্য রাশিয়া হচ্ছে সবচেয়ে বড় অস্ত্র সরবরাহকারী। আর গত মাসে মস্কো সফরে গিয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ গ্যাস পাইপলাইন নিয়ে আলোচনা করেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। কৌসিকান বলেন, ভারতের কাছে সোভিয়েত আমলের অস্ত্রের বড় মজুদ রয়েছে, যা তাকে সচল রাখতে হবে। আর তার পেছনে কারণ হলো চীন।
রাশিয়ার সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক থাকলেও ভারত জাপান-অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে মার্কিন নেতৃত্বাধীন কোয়াডেরও অংশ, যেটিকে এ অঞ্চলে চীন-বিরোধী জোট হিসেবে দেখা হয়।
‘ভারত কার পক্ষে?’ সম্প্রতি রাশিয়ায় নিযুক্ত সাবেক ভারতীয় রাষ্ট্রদূত পঙ্কজ সরণ টুইট করেছেন, ‘আমরা আমাদের পক্ষে?’
রাশিয়া ইস্যুতে এশিয়ার অবস্থান অনেকটা এমনই। এখানকার সরকারগুলো বাণিজ্য সংঘাত থেকে শুরু করে মানবাধিকারের মতো ইস্যুগুলোতে কোনো একটি পক্ষ বেছে নিতে পারে, তবে অর্থনৈতিক ইস্যুতে তারা সবসময়ই বাস্তববাদী।
অধ্যাপক মুনির বলেন, আপনি আশা করতে পারেন, বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারত রুশ আগ্রাসনের নিন্দা করবে। কিন্তু দেশগুলো নিজস্ব ভূরাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থই বেশি দেখে, ন্যায়নীতি বা আন্তর্জাতিক নিয়মের প্রতি শ্রদ্ধা কম।
বড় শক্তির চাপইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের নিন্দা প্রস্তাবে এশিয়ার নীতিগত বিভাজন আরও স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেওয়া পাঁচ দেশের একটি উত্তর কোরিয়া। মিয়ানমার নিন্দা প্রস্তাবের পক্ষে মত দিলেও তা ছিল দেশটির ক্ষমতাচ্যুত গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতিনিধির ভোট। দেশটিতে ক্ষমতা দখল করা জান্তা সরকার বরাবরই রাশিয়ার পক্ষে কথা বলে আসছে। অভ্যুত্থানের পরেও তাদের কাছে অস্ত্র সরবরাহ করা দেশগুলোর একটি রাশিয়া।
সিঙ্গাপুরের এনইউএস ডিপার্টমেন্ট অব পলিটিক্যাল সায়েন্সের সহযোগী অধ্যাপক চং জা ইয়ানের মতে, এ অঞ্চলের অন্য ছোট অর্থনীতির দেশগুলো রাশিয়া, চীন ও পশ্চিমা চাপের মধ্যে আটকা পড়েছে। এ ধরনের দেশগুলো সাধারণত বড় শক্তির সমালোচনা এড়িয়ে চলে। কারণ তাতে শাস্তির মুখে পড়ার ভয় রয়েছে।
তিনি বলেন, এদের মধ্যে বিশ্বাস রয়েছে, রাশিয়ার আগ্রাসন মারাত্মক এবং সার্বভৌমত্বের জন্য চ্যালেঞ্জ। তাই তারা নীরব থাকার পথ বেছে নেয়। এ ধরনের দেশগুলো মস্কোর সমালোচনা করতে না চাইলেও তাকে সমর্থনও করে না।
এছাড়া, এশিয়ার অনেক দেশেরই চীনের সঙ্গে আঞ্চলিক বিরোধ রয়েছে। তাদের দুশ্চিন্তা হলো, ইউক্রেনে কী ঘটছে তাতে সূক্ষ নজর রেখেছে বেইজিং। ভবিষ্যতে এ ধরনের বিবাদে কী ফল হবে তা বুঝতে চেষ্টা করছে চীন।
মার্কিন থিংক ট্যাক কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনের ভারত, পাকিস্তান ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সিনিয়র ফেলো মঞ্জরি চ্যাটার্জি মিলার বলেন, এশিয়ার বেশিরভাগ দেশই চায় ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের ভারসাম্যপূর্ণ উপস্থিতি। তবে ভারত এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশ চায়, চীন ইস্যুতে রাশিয়া ভারসাম্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করুক।
এটি হয়তো রাশিয়ার নিন্দা জানানো থেকে এশীয় দেশগুলোর বিরত থাকার কারণ কিছুটা ব্যাখ্যা করবে, তবে এর উল্টো দিকটাও ভেবে দেখা দরকার- চীন এই রুশ আগ্রাসন থেকে কী শিক্ষা নিচ্ছে?
মঞ্জরি চ্যাটার্জির কথায়, রাশিয়াকে আটকানো না গেলে চীন কী বুঝবে? নিষেধাজ্ঞায় যদি কাজ না হয়? ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরে চীনের সীমালঙ্ঘন বা তাইওয়ানের ভবিষ্যতের জন্য এর অর্থ কী হবে?
এ বিশ্লেষকের মতে, বিষয়টি বেশ জটিল হতে চলেছে। আগ্রাসনের সঙ্গে তেলের দাম আর নৃশংসতা বাড়তে থাকলে তারা কতক্ষণ চুপ থাকতে পারবে।
সূত্র: বিবিসি
কেএএ/এএসএম