শিক্ষার্থী নির্যাতন ও নিপীড়নের পূর্বের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। অভিযোগ রয়েছে, হলের শিক্ষার্থীদের প্রতিদিন নতুন নতুন কায়দায় নির্যাতন করা হয়। ছাত্রলীগের দেওয়া নিয়মের ব্যতিক্রম করলেই শিক্ষার্থীদের ওপর নেমে আসে অমানবিক নির্যাতন। হলের বিভিন্ন বর্ষের শিক্ষার্থীরা এমন অভিযোগ করেছেন।
Advertisement
বৃহস্পতিবার (১০ মার্চ) রাতে তুচ্ছ ঘটনায় অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবু তালিবকে গভীর রাতে ডেকে নিয়ে তার চারজন সিনিয়র তাকে রাতভর নির্যাতন করে হল থেকে বের করে দেন। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয় বলে জানিয়েছেন হলের অন্যান্য শিক্ষার্থীরা।
শুক্রবার তার নির্যাতনের ঘটনাটি সামনে আসে। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী জানান, সমাজকল্যাণ বিভাগের শেখ শান্ত আলম, ইসলামের ইতিহাস বিভাগের ইমদাদুল হক বাঁধন, তথ্য বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের শাহাবুদ্দিন ইসলাম বিজয় ও আইন বিভাগের নাহিদুল ইসলাম ফাগুন- এই চারজন তাকে নির্যাতন করেন। তারা সবাই বঙ্গবন্ধু হলের ২০১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থী এবং সবাই হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মেহেদী হাসান শান্তর অনুসারী হিসেবে পরিচিত। মেহেদী হাসান শান্ত বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাসের অনুসারী।
ঘটনার বর্ণনায় নির্যাতনকারীদের ব্যাচের একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, বঙ্গবন্ধু হলের ২০১(ক) নং রুমে অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবু তালিবকে (ভুক্তভোগী) শান্ত, বাঁধন, বিজয় ও ফাগুন হাতে না ধরে সিগারেটে আগুন ধরিয়ে মুখে দিতে বলেন। না দিতে চাইলে পরে একাধিকবার স্ট্যাম্প দিয়ে আঘাত করা হয়। তৃতীয় বর্ষের শান্তর (নির্যাতনকারী) সামনে স্মৃতি চিরন্তনের পাশে সিগারেট খাওয়ায় তাকে নির্যাতন করা হয়। এসময় তারা তালিবের বাবা-মা তুলে গালিগালাজ করতে থাকের। তালিবকে হল থেকে চলে যেতে বলেন তারা।
Advertisement
তৃতীয় বর্ষের একাধিক শিক্ষার্থী গেস্টরুমে উপস্থিত থেকে প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে আরও বলেন, আবু তালিবকে এই চারজন সবচেয়ে বেশি নিপীড়ন করেন। এছাড়াও প্রোগ্রামে উপস্থিত না থাকার অভিযোগে ১০-১২ জন শিক্ষার্থীকে হল থেকে বের করে দেওয়া হয় এবং পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ৩০১(ক) নম্বর রুম গত তিনদিন থেকে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়। ফলে ওই কক্ষের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা থাকা সত্ত্বেও তারা বিভিন্ন হলে ঘুরে ঘুরে রাত কাটাচ্ছেন।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী আবু তালিবের সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের। ঘটনা সম্পর্কে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি হল থেকে একেবারে বের করে দেওয়ার ভয়ে কথা বলা থেকে বিরত থাকেন। বর্তমানে তিনি হলের বাইরে অবস্থান করছেন।
এছাড়াও গতকাল বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মহিদুল ইসলাম মুকুলকে ৪০১ নম্বর রুমে নিয়ে নির্যাতন করার অভিযোগ রয়েছে। ওয়াইফাইয়ের পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করা ও সিনিয়রের রুমে বিছানায় পা তুলে বসাকে কেন্দ্র করে স্ট্যাম্প ও রড দিয়ে অমানবিক নির্যাতন করে উর্দু বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ও হল শাখা মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সভাপতি আশরাফুল চৌধুরী রনি। এসময় হাতে ছুরি নিয়ে হত্যার হুমকিও দেওয়া হয় তাকে। আর এসবের সমঝোতার জন্য গতকাল রাতে আবার মহিদুল ইসলাম মুকুলকে গেস্টরুমে ডাকা হয়। এ ঘটনায় অভিযুক্ত উর্দু বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী রনি। হলে মেহেদী হাসান শান্তর রাজনীতি করেন তিনি।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্তরা সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। তাদের দাবি, বঙ্গবন্ধু হলে এ ধরনের কোনো ঘটনাই ঘটেনি। তবে হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মেহেদী হাসান শান্ত বলেন, এটা তাদের রুমমেটদের বিষয়। এতে ছাত্রলীগের সংশ্লিষ্টতা নেই।
Advertisement
হলের অন্যান্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের অনুসারীরা গণরুমে থাকা শিক্ষার্থীদের দিনের বেলা বিভিন্ন দলীয় প্রোগ্রামের পাশাপাশি রাতে দুই দফা গেস্টরুমে ডাকেন। ক্লাস পরীক্ষা থাকলেও একজনের প্রোগ্রাম না করার ‘অপরাধে’ রুমের সবাইকে বের করে দেওয়া হয়। কয়েকদিন আগেও প্রোগ্রাম না করার কারণে তিনজনকে হল থেকে বের করে দেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
এ বিষয়ে মেহেদী হাসান শান্ত জাগো নিউজকে বলেন, আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বঙ্গবন্ধু হল নিয়ে কয়েকটি গোষ্ঠী রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র করে দলের সুনাম নষ্ট করার চেষ্টা করছে। আমরা সবসময় শিক্ষার্থীদের পক্ষে আছি। যারা এ কাজের সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য হল প্রশাসনকে জানিয়েছি।
এ বিষয়ে হলের হাউস টিউটর ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ রাকিব উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, হলে কী হচ্ছে না হচ্ছে ২৪ ঘণ্টাই কি আমরা এগুলো দেখবো? আমাদের তো ক্লাস রয়েছে, পরিবার রয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. মো. আকরাম হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের গেস্টরুমে একটা সিসিটিভি ক্যামেরা আছে। এখানে আমরা কোনো ধরনের নির্যাতনের ঘটনা দেখিনি। আমরা চেষ্টা করছি, কোনো প্রমাণ পাই কি না। যাদের ব্যাপারে অভিযোগ এসেছে, আমরা বিষয়গুলো আরও ভালো করে দেখবো।
তিনি বলেন, গেস্টরুমের ফুটেজ সবসময়ই আমরা দেখি। আমরা দেখি, দু/চারজন শিক্ষার্থী প্রায়ই ওখানে বসে গল্প করে। এছাড়া আর কিছুই হয় না।
আল সাদী ভূঁইয়া/ইএ/এএসএম