একুশে বইমেলা

প্রতিদিন নিয়ম করে লেখার চেষ্টা করি: রণজিৎ সরকার

রণজিৎ সরকার কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক। তিনি শৈশব থেকেই জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় লিখছেন। ২০১২ সালে প্রথম বই প্রকাশ হলেও এ পর্যন্ত তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৫৫টিতে দাঁড়িয়েছে। তিনি কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার অর্জন করেছেন। লেখালেখির নেশা থেকেই পেশা হিসেবে নিয়েছেন সাংবাদিকতা। রণজিৎ সরকার একটি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকীয় বিভাগে কর্মরত।

Advertisement

সম্প্রতি তার লেখালেখি, বই প্রকাশ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন লেখক ও সাংবাদিক সালাহ উদ্দিন মাহমুদ—

জাগো নিউজ: এবারের বইমেলায় আপনার কয়টি বই প্রকাশ হয়েছে?রণজিৎ সরকার: এবার বড়দের একটি উপন্যাস ‘জননীজন্ম’। বইটি প্রকাশ করেছে বেহুলাবাংলা। আর ছোটদের একটি ‘গল্পে গল্পে দশরত্ন’ অন্যটি ‘প্রাণিজগতে আনন্দে একদিন’ প্রকাশ করেছে বাবুই। এ ছাড়া বিগত বছরের বইগুলো আছে।

জাগো নিউজ: আপনার বই প্রকাশের এক দশক পূর্তি হলো, কেমন লাগছে?রণজিৎ সরকার: আমার প্রথম বই প্রকাশ হয় ২০১২ সালে। ‘স্কুল ছুটির পর’ ছোটদের গল্পের বই। বইটি মেলায় এসেছিল ৩ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার। ওইদিন বিকেলে ২০ কপি বই নিয়ে এলে এক ঘণ্টার মধ্যে বিক্রি হয়ে যায়। একটা শিশুর কথা খুব মনে পড়ে। ওই শিশু আমার অটোগ্রাফ চেয়েছিল। আমি লজ্জায় স্টলের সামনে থেকে পালিয়ে যাই। তারপর থেকে নিজেকে অপরাধী মনে হয়। ওইদিনের স্মৃতি বারবার মনে পড়ে। শিশুটি মনে হয় বইমেলায় এসে বলবে, আমি সেই মেয়েটি যাকে প্রথম অটোগ্রাফ দেননি। আজও শিশুটির অপেক্ষায় আছি। এখন অটোগ্রাফ দেওয়ার সময় শিশুটির কথা মনে হয় খুব। সেই ২০১২ সাল থেকে ২০২২ সালে এসে ৫৫টি বই প্রকাশ হয়ে গেল। লেখালেখি, বই প্রকাশ ও পাঠকের ভালোবাসা পেয়ে এক দশকে অনেক ভালো লাগা ও ভালোবাসার জায়গা তৈরি হয়েছে। যা লেখালেখি ছাড়া সম্ভব হতো না। ভালো লাগার অনেকগুলো কারণ আছে। প্রথমত আমার পাঠকের একটা চাহিদা আছে বলেই এত বই প্রকাশ হয়েছে। দ্বিতীয়ত আমি প্রতিদিন নিয়ম করে লেখার চেষ্টা করি। তা পরিকল্পনা অনুযায়ী। ফলে পাণ্ডুলিপি তৈরি হয়ে যায়। প্রতিটি বই প্রকাশের অনুভূতি আমার একই রকম। প্রতিটি মা যেমন তার সন্তানদের সমানভাবে ভালোবাসেন; ঠিক তেমনই আমার বইগুলোর অনুভূতি একই রকম থাকে। তবে ভালো লাগাটা বেশি তখনই হয়; যখন একটা ভালো লেখা হয়, তখনকার অনুভূতিটাই বেশি ভালো লাগে। ভালো লেখার অপেক্ষায় আছি।

Advertisement

জাগো নিউজ: এ পর্যন্ত আপনার অর্ধশতাধিক বই প্রকাশ হয়েছে, জার্নিটা কেমন ছিল?রণজিৎ সরকার: প্রতিটি লেখকের প্রথম বই প্রকাশের গল্প থাকে। আমারও আছে। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে পত্রিকায় লেখা প্রকাশ হয়। বই পড়তাম। আর মনে মনে ভাবতাম, কবে আমার একটা বই প্রকাশ হবে। অনেক গল্প প্রকাশ হলো। ২০১১ সালে খুব ইচ্ছা হলো একটা বই প্রকাশ করা দরকার। বই প্রকাশ না হলে অনেকেই লেখক হিসেবে গণ্য করবে না। তাই মনে হলো, একটা বই প্রকাশ করা দরকার। তখন অনেক লেখক বড় ভাইকে বললাম। অনেকে প্রকাশককে বললেন কিন্তু তারা তরুণ লেখকের বই প্রকাশ করতে চান না। অনেক টাকা চান। তখন তো আমি ছাত্র। এত টাকা কোথায় পাবো? একদিন আমি আমার প্রকাশিত গল্পগুলো নিয়ে বাংলাবাজারে গেলাম। বিভিন্ন প্রকাশনীতে ঘুরতে থাকলাম। কিন্তু কেউ গুরুত্ব দেন না। পাত্তা দেন না। ঘুরতে ঘুরতে আফতাব বুক হাউজে গেলাম। আফতাব ভাই গল্পগুলো দেখে একটা ভূতের পাণ্ডুলিপি দিতে বললেন। নাম ঠিক হলো ‘ভূতের ফাঁসি’। কিছু বই কেনার শর্ত দিলেন। আমিও রাজি হয়ে গেলাম। পাশে ছিল শুভ্রপ্রকাশের দোকান। শ্যামল দাদা ‘স্কুল ছুটির পর’ একটা গল্প দেখে পছন্দ করলেন। সাথে আরও কয়েকটা গল্প দিতে বললেন। তারও শর্ত ছিল কিছু বই কেনার। আমি রাজি হয়ে গেলাম। শুভ্রপ্রকাশ থেকে ‘স্কুল ছুটির পর’ ২০১২ সালে মেলায় প্রকাশ হলো। তারপর ওই মেলাতেই প্রায় এক হাজার কপি বিক্রি হয়। ‘ভূতের ফাঁসি’ বইটা ভালো বিক্রি হয়। আমাকে আর বই কিনে নিতে হয়নি। প্রথম বই থেকে আমি রয়্যালিটি পাওয়া শুরু করি। পরের বছর তো আমার চারটা বই প্রকাশ হয়। তার পরের বছর ছয়টা, তার পরের বছর আট, তার পরের বছর দশটা, এভাবে এখন ৫৫টা বই প্রকাশ হয়েছে।

জাগো নিউজ: একটি বইয়ের জন্য ‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক’ পুরস্কার পেয়েছেন, অনুভূতি কেমন ছিল?রণজিৎ সরকার: ‘স্কুলে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল’ কিশোর উপন্যাসের জন্য পুরস্কারটি পেয়েছি। আসলে কি জানেন, আমার মনে হয় কোনো লেখক পুরস্কার প্রাপ্তির আশায় লেখেন না। তবে এ কথা সত্য, প্রতিটি মানুষ কিন্তু তার কাজে স্বীকৃতি চায়। আর স্বীকৃতি পেলে সে মনের দিক দিয়ে ভালো থাকে। আত্মবিশ্বাস বাড়ে, উৎসাহ পায়। কাজের গতি বাড়ে। কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার আমার জীবনের প্রথম পুরস্কার। এ পুরস্কারের প্রভাব কিছুটা হলেও পড়বে। এ পুরস্কার আমাকে অনেকের কাছে পরিচিত করেছে। পুরস্কার একজন লেখককে লেখার প্রতি, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়। সম্মানিত বোধ করছি, খুবই অনুপ্রাণিত বোধ করছি। সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা।

জাগো নিউজ: শিশুসাহিত্য নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?রণজিৎ সরকার: শিশুসাহিত্য নিয়ে ভাবনার জায়গা অনেক আছে। শিশুদের মনন ও সৃজনশীল করে গড়ে তুলতে হবে। আর এর জন্য দরকার ভালো বই। ভালো বই লেখার দায়িত্ব কিন্তু একজন লেখকের। লেখকের সাথে জড়িয়ে আছেন এক সচেতন অভিভাবক। একজন অভিভাবক যদি ভালো বই শিশুকে তুলে দেন, তাহলে সে কিন্তু ভালো কিছু জানতে পারবে। ভালো বই পড়ে নিজের বোধশক্তিটা বাড়াতে পারবে। বোধশক্তি তৈরি হলে খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকবে। অন্যকে বোঝাতে তার সহজ হবে। একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারবে। লিখতে লিখতে কোন লেখাটি ভালো হবে, তা বলা যাবে। তবে আমি আজীবন ভালো লিখতে চাই। সময় বলে দেবে কোন লেখাটি অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

জাগো নিউজ: সমকালীন সাহিত্যচর্চার গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে আপনার অভিমত জানতে চাই—রণজিৎ সরকার: সাহিত্য-শিল্পের প্রধান কাজ হলো মানুষের হৃদয়ে প্রবেশ করা। চিন্তা-ভাবনা, অনুভূতি ও মন পরিবর্তন করে হৃদয়কেও জাগিয়ে তোলা। সমাজ পরিবর্তনে বড় ভূমিকার রাখা। বর্তমান লেখকরা পাঠকের মনে কতটুকু নাড়া দিতে পারছেন এবং সমাজ পরিবর্তনে ভূমিকা পালন করছেন? যতটুকু প্রয়োজন; ততটুক মনে হয় হচ্ছে না। বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে সাহিত্যচর্চারও দিক পরিবর্তন হয়েছে। সাহিত্যচর্চায় তথ্যযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। ফেসবুকে এ চর্চাটি আমি পজিটিভভাবেই দেখি। কেউ যদি ফেসবুকে সাহিত্যচর্চা করতে করতে সিরিয়াস ধারায় চলে আসেন, তাহলে সে সাহিত্যচর্চা ভালো। খারাপ কাজে সময় ব্যয় না করে সাহিত্যচর্চায় সময় দেয়া অনেক ভালো। লেখালেখি এমন এক কাজ, যা নিজেরটা নিজেকেই করতে হয়। অন্য কেউ করতে পারেন না। সে জন্য নিজের পাঠাভ্যাস, জীবনাভিজ্ঞতা, দৃষ্টিভঙ্গির ওপর গড়ে ওঠে লেখকসত্তা। কিন্তু সাহিত্যাঙ্গনে এখন দেখা যায় সন্ত্রাসী, অপহরণকারী, প্রতারক, দালাল ও ব্যবসায়ীদের মতো সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। এতে অনেক অকবি-অসাহিত্যিককে বড় করে দেখানো হচ্ছে। প্রকৃত লেখক আড়ালে পড়ে যাচ্ছেন। বর্তমান বাংলা সাহিত্যে বহুমুখীনতার অভাব দূর করার জন্য লেখকদের সচেতন হওয়া খুবই প্রয়োজন।

Advertisement

জাগো নিউজ: অ্যামাজান থেকে আপনার লেখা বই প্রকাশ হয়েছে, কেমন সাড়া পাচ্ছেন?রণজিৎ সরকার: Amelia journey with animals—শিশু-কিশোরদের গল্পের বই। বইটি প্রাণী নিয়ে মজা করে লেখা। বইটি প্রকাশ হওয়ার পর থেকে অনেক সাড়া পাচ্ছি। ইচ্ছা আছে, প্রতি মাসে একটি করে বই দেওয়ার চেষ্টা করব। মজার ব্যাপার হলো, অ্যামাজানে বইটি প্রকাশ হওয়ার পর বাংলাদেশের অনেক প্রকাশকের কাছ থেকে সাড়া পেয়েছি। তারা বলেছেন, বইটি বাংলা-ইংরেজি ভাষায় প্রকাশ করতে চান। পরে বইটি কাদের বাবু ভাইয়ের ‘বাবুই’কে দিয়েছি। এবার বইমেলায় বইটি বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় প্রকাশ হয়েছে। বইটির নাম একটু পরিবর্তন হয়েছে। বাংলা নামটা হলো ‘প্রাণীজগতে আনন্দে একদিন’ আর ইংরেজি নাম হলো ‘Joy in the animal kingdom One day’। বই দুটি মেলায় ভালো সাড়া পাচ্ছে।

জাগো নিউজ: নতুন যারা লিখতে চান, তাদের জন্য কী পরামর্শ দেবেন?রণজিৎ সরকার: আমি নিজেও তো তরুণ। উপদেশ দেওয়ার মতো যোগ্যতা মনে হয় আমার নেই। তবে আমার অভিজ্ঞতা থেকে কিছু কথা বলতে পারি, তা হলো একজন লেখককে ধৈর্যশীল হয়ে সাধনার মধ্য দিয়ে সাহিত্যচর্চা করতে হবে। সাহিত্যচর্চা ২৪ ঘণ্টা পরিশ্রমের কাজ। এ পরিশ্রমে ফাঁকি দিলে চলবে না। সফল হতে হলে মনের ভেতর সব সময় লেখালেখি ও বইপড়ার চিন্তা নিয়ে কাজ করতে হয়। এ চিন্তার কিন্তু যন্ত্রণাও আছে। এটা বলি সাহিত্যচর্চার সৃজনশীল যন্ত্রণা। যন্ত্রণাটি ধৈর্য ধরে সহ্য করতে হবে। যন্ত্রণাটি একজন লেখকের উপভোগের বিষয়ও বটে। বিশেষ করে একজন লেখককে কিন্তু কালজয়ী বইগুলো পড়ে ফেলতে হবে। এতে একজন তরুণ লেখকের জন্য অনেক উপহার আছে। নিজের একটি অভ্যাসের কথা দিয়ে শেষ করি, আমি কিন্তু প্রতিদিন নিয়ম করে কয়েক ঘণ্টা পড়ি আর লিখি।

এসইউ/জেআইএম