দু’সপ্তাহে পা রাখলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। অন্যভাবে বললে, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন চলছে ১৪ দিন হলো। তা কবে নাগাদ শেষ হবে, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। অথচ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সামরিক শক্তির মুখে ‘পুচকে’ ইউক্রেন দুইদিনও টিকবে কিনা, যুদ্ধ শুরুর আগে তা নিয়ে সন্দিহান ছিলেন অনেকে। কিন্তু সব জল্পনা-কল্পনা, বিশ্লেষণ ভুল প্রমাণ করে লড়াই এখনো টিকিয়ে রেখেছেন ইউক্রেনীয়রা অথবা তাদের সেই সুযোগ দিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
Advertisement
রাশিয়ার কথিত এই ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ শুরুর আগে থেকেই পশ্চিমারা বলে আসছে, পুতিনের একমাত্র লক্ষ্য গোটা ইউক্রেন দখল করা। তার জন্য কয়েক মাস ধরে পূর্ব ইউরোপে সৈন্য সমাবেশ বাড়িয়েছেন তিনি। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন আক্রমণের আগেই সাবেক সোভিয়েত দেশটির সীমান্তে রাশিয়া দেড় লাখের বেশি সৈন্য জড়ো করেছিল বলে দাবি পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর।
এছাড়া চলতি মাসের শুরুর দিকে রাশিয়া ৬৪ কিলোমিটার দীর্ঘ বিশাল এক সামরিক বহর কিয়েভ উপকণ্ঠে হাজির করেছে বলে জানা গেছে। সেই বহরের স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবি প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে। কিন্তু তারপর এক সপ্তাহ পার হলেও এ নিয়ে তেমন কোনো খবর পাওয়া যায়নি। এসব সৈন্য-সমরাস্ত্র যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিয়েছে বলেও শোনা যায়নি। কিয়েভ থেকে ২০ কিলোমিটারেরও কম দূরত্বে স্থির হয়ে রয়েছে রুশ সেনাদের বিশাল সেই গাড়িবহর।
NEW: Russia's 40-mile long convoy of tanks, artillery and supplies that has stalled miles from Kyiv after Ukrainian strikes, depicted in a 3D rendering. Pentagon spokes John Kirby told MSNBC today that Ukrainians hit the convoy's lead vehicles, forcing it to halt.:@Maxar pic.twitter.com/MvKZMh20Qq
Advertisement
পুতিন বাহিনীর এই ৬৪ কিলোমিটার দীর্ঘ বহর আজও কেন কিয়েভে ঢুকলো না, তা নিয়ে অনেক ধরনের কথা শোনা যাচ্ছে। কেউ বলেছেন, বিশাল বহরটি মূলত ট্রাফিক জ্যামে পড়ে দাঁড়িয়ে গেছে। কারণ স্যাটেলাইটের ছবিতে দেখা গেছে, গাড়িগুলো পুরো রাস্তা জুড়ে থাকায় বিপরীত দিক থেকে অন্য যানবাহন চলাচলের জায়গা নেই বললেই চলে। ফলে কিয়েভের প্রবেশমুখে হয়তো অনেক গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকায় রুশ বহর এগোতে পারছে না।
This is a thread that will explain the implied poor Russian Army truck maintenance practices based on this photo of a Pantsir-S1 wheeled gun-missile system's right rear pair of tires below & the operational implications during the Ukrainian mud season.1/ pic.twitter.com/LmxW43v6gy
— Trent Telenko (@TrentTelenko) March 2, 2022দ্বিতীয় কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, ইউক্রেনের কর্দমাক্ত রাস্তায় হয়তো রুশ গাড়িগুলোর চাকা আটকে গেছে। এ ধরনের বেশ কিছু ছবিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানো হয়েছে, যদিও তার সত্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া, রুশ বহরটির জ্বালানি ও সৈন্যদের খাবার ফুরিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনার কথাও বলেছেন কিছু বিশ্লেষক। এটিও কতটুকু সত্য, তা নির্ণয় করা কঠিন।
ইউক্রেন যুদ্ধ এত দীর্ঘায়িত হওয়ার অন্যতম কারণ, রাশিয়া এখন পর্যন্ত তার মহাশক্তিশালী বিমানবাহিনী খুব একটা ব্যবহার করেনি। তাদের কাছে আকাশযান রয়েছে অন্তত ৪ হাজার ১৭৩টি, এর মধ্যে যুদ্ধবিমানই ৭৭২টি। সেই তুলনায় ইউক্রেনের যুদ্ধবিমান মাত্র ৬৯টি। রাশিয়ার হেলিকপ্টার রয়েছে ১ হাজার ৫৪৩টি, এর মধ্যে অ্যাটাক হেলিকপ্টার ৫৪৪টি। অন্যদিকে ইউক্রেনের হেলিকপ্টার ১১২টি, অ্যাটাক হেলিকপ্টার ৩৪টি।
Advertisement
ফলে রুশ বিমানবাহিনী পুরো শক্তির মাত্র চার ভাগের এক ভাগ ব্যবহার করলেও ইউক্রেনের প্রতিরোধ গড়ার সুযোগ খুবই কম। এখন পর্যন্ত সেটিও দেখা যায়নি।
রাশিয়ার সুখোই এসইউ-৩৫ যুদ্ধবিমান। ছবি সংগৃহীত
এর পেছনে অবশ্য কিছু গণমাধ্যমে এমন বিশ্লেষণও দেখা গেছে যে, যুদ্ধে রুশ যুদ্ধবিমান ধ্বংস হলে এর উন্নত প্রযুক্তি পশ্চিমাদের হাতে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সে কারণেই ইউক্রেন অভিযানে রাশিয়া বিমান বাহিনী খুব একটা ব্যবহার করছে না।
তবে এসবই যে ইউক্রেন বা পশ্চিমাপন্থি মতামত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এর বিপরীত দিকটা বিবেচনা করলে প্রথমেই সামনে আসবে, ইউক্রেনে প্রচুর রুশপন্থি মানুষের বসবাস। তারাও জেলেনস্কি সরকারকে পছন্দ করেন না। এদের মধ্যে পুতিনের প্রতি তীব্র সমর্থন রয়েছে। ফলে রুশ প্রেসিডেন্ট কখনোই চাইবেন না, নিজের পক্ষের লোক ক্ষতিগ্রস্ত হোক।
এই দাবির পক্ষে কথা বলবে পুতিনের যুদ্ধবিরতির ঘোষণাই। এরই মধ্যে ইউক্রেনের বেশ কয়েকটি শহরে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে বেসামরিক লোকদের বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিচ্ছে ক্রেমলিন। গত দু’সপ্তাহে ইউক্রেন থেকে ২০ লাখের বেশি মানুষ আশপাশের দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছেন। বিশ্লেষকদের একাংশের বিশ্বাস, এ ধরনের বেসামরিক লোকজন সরে গেলেই পূর্ণমাত্রায় আক্রমণ করবে রাশিয়া।
ইউক্রেন ছেড়ে হাঙ্গেরির পথে একটি পরিবার। ছবি সংগৃহীত
এছাড়া, ইউক্রেনে পুরোমাত্রায় যুদ্ধ বাঁধলে দেশটিতে থাকা পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত্র হতে পারে, যার ফলে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এরই মধ্যে চেরনোবিলসহ বেশ কয়েকটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে রাশিয়া। মস্কো অভিযোগ করেছে, ইউক্রেনীয় বাহিনী খারকিভের পরমাণু চুল্লিতে হামলা চালিয়ে তার দায়ভার রাশিয়ার ওপর চাপিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। আর ইউক্রেন অভিযোগ করেছে, রুশ বাহিনী সম্প্রতি জাপোরিঝজিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রে গোলা নিক্ষেপ করেছে।
তবে যে পক্ষের হাতেই হোক, পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার প্রভাব ছড়িয়ে পড়তে পারে আশপাশের দেশগুলোতেও। আর সেটি হলে আরও ভয়ংকর চাপের মুখে পড়তে হবে পুতিনকে, যা তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
অবশ্য রুশ প্রেসিডেন্টকে নিয়ে একটা কথা প্রচলিত আছে, পুতিনকে নিয়ে আপনি যে ধারণাই করবেন, তিনি সেটা ভুল প্রমাণিত করবেন। অনেকে বলেছিলেন, পুতিন কখনো ক্রিমিয়া দখল করবেন না; তিনি সেটা করেছেন। অনেকে বলেছিলেন, পুতিন পশ্চিমাদের ভয়ে ইউক্রেন আক্রমণ করবেন না; তিনি সেটা করেছেন। আজ অনেকে বলছেন, পুতিন ইউক্রেনে না জেতা পর্যন্ত সরবেন না। কে জানে, হতে পারে তিনি সেটাও করে বসলেন।
মূলত, গত কয়েক বছরে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী মনোভাব আর চীনের উত্থানে বিশ্ব অনেকটা ভুলতে বসেছিল, রাশিয়াও এই দুনিয়ার অন্যতম পরাশক্তি। হয়তো সেটাই মনে করিয়ে দিতে পশ্চিমাদের তোয়াক্কা না করে ইউক্রেন আক্রমণ করেছেন পুতিন। আজ সেটি যখন সবার মনে পড়েই গেছে, তাহলে আর শক্তি খরচ করে লাভ কী! এবার ক্ষান্ত দেওয়া যাক। তবে শেষ কথা হলো, এই মুহূর্তে পুতিন কী চান এবং কী করবেন, তা তিনিই ভালো জানেন।
কেএএ/এএসএম