দেশজুড়ে

বান্দরবানে ঝিরি-ঝরনা শুকিয়ে তীব্র পানি সংকট, হুমকিতে জলজপ্রাণী

বান্দরবানে তীব্র পানি ও জলজপ্রাণী সংকট দেখা দিয়েছে। ঝিরি-ঝরনা শুকিয়ে যাওয়ায় এ সংকট তৈরি হয়েছে। হুমকির মুখে পড়ছে জীববৈচিত্র্য। সম্প্রতি সরেজমিন বান্দরবানের বিভিন্ন ঝিরি-ঝরনা ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।

Advertisement

বান্দরবানের রুপালি ঝরনা, বাদুরা ঝরনা, সাইংগ্যা ঝিরি, সিদ্দিকনগর ঝিরি, লামিপাড়া ঝিরি, শৈলপ্রপাত ঝিরিসহ বিভিন্ন ঝিরি-ঝরনা ঘুরে দেখা যায়, পানিশূন্য প্রায় সব ঝিরি-ঝরনা। তীব্র পানি সংকটে দিন কাটাচ্ছেন ঝিরি ও ঝরনার আশপাশে বসবাস করা জনগোষ্ঠীরা। ঝিরিতে ছোট ছোট কূপ করে পানি সংগ্রহ করে সংকট নিবারণের চেষ্টা করছেন তারা।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঝিরি-ঝরনা শুকিয়ে যাওয়ায় নিম্নআয়ের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর আমিষের জোগানদাতা ছোট-বাড় বিভিন্ন মাছ, শামুক ও কাঁকড়া কোনো কিছুই পাচ্ছেন না তারা। বান্দরবানে অবাধে পাথর উত্তোলন, জোত পারমিটের নামে নির্বিচারে বৃক্ষনিধন এ সংকটের মূল কারণ বলে দাবি করছেন স্থানীয়রা।

সিদ্দিকনগর এলাকায় বসবাসকারী মাদরাসাছাত্র মাহমুদ জাগো নিউজকে জানান, তাদের এলাকায় দুটি ঝিরি ছিল। যেখান থেকে স্থানীয়রা পানি, মাছ ও কাঁকড়াসহ বিভিন্ন ধরনের খাবার উপযোগী জলজপ্রাণী সংগ্রহ করতেন। এছাড়া হরিণ, বন্যশূকর, বানর, বনমোরগসহ নানা প্রজাতির বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণ ছিল এলাকায়। এখন আর এসব দেখা যায় না।

Advertisement

লাইমিপাড়ার বাসিন্দা ফ্লোরা বম জাগো নিউজকে বলেন, ‘লাইমিপাড়ায় বাসবাসকারীদের একমাত্র পানির উৎস লাইমিপাড়া ঝিরি। আগে ঝিরি থেকে পর্যাপ্ত পানি পাওয়া গেলেও এখন তেমন পাওয়া যায় না। ঝিরিতে রিং ওয়াল বসিয়েও তেমন পানি পাওয়া যাচ্ছে না। পরিবার-পরিজন নিয়ে আমরা চরম পানিকষ্টে আছি। জলজপ্রাণীরও সংকট রয়েছে।’

শৈলপ্রপাত এলাকার ডাংলিয়াম বম জাগো নিউজকে জানান, এখানে কয়েকশ পরিবারের বসবাস। পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় নলকূপ বা ডিপ টিউবওয়েল বসানোর সুযোগ নেই। পানির জন্য ঝিরিই একমাত্র ভরসা। এখানে বসবাসরত বেশিরভাগ জনগণ নিম্নআয়ের হওয়ায় আমিষের জন্য ঝিরি, প্রোটিনের জন্য পাহাড়ের বন্যপ্রাণীই তাদের একমাত্র ভরসা। যেখানে পাথর আছে সেখানে একটু-আধটু পানি আছে।

সুয়ালক এলাকার পারভিন আক্তার মুন্নি বলেন, ‘আগে বাড়ির পাশে বসানো রিং ওয়ালটি পানিতে পরিপূর্ণ থাকতো। বছরদুয়েক ধরে রিং ওয়াল তো দূরে থাক ঝিরিতে এসে ছোট ছোট কূপ করে এক কলসি পানি ভরতেই কষ্ট হয়।’

রুপালি ঝরনাকে ঘিরে পর্যটকদের আসা-যাওয়া থাকায় অস্থায়ী দোকান গড়ে তোলেন এলাকার জাফর আহমেদ। এখনো ঝরনা দেখতে প্রতিদিন অনেক পর্যটক আসে। তার আশঙ্কা, এভাবে ঝরনা ফোয়ারা শুকিয়ে গেলে হয়তো পর্যটকই আর আসবে না।

Advertisement

তিনি বলেন, ‘আগে ঝরনার ফোয়ারা ছিল অনেক বেশি। এখন দিন যত যাচ্ছে পানির ফোয়ারা ততই কমছে। ঝিরির নিচে কূপটি পানিতে পরিপূর্ণ থাকতো। মাছ, কাঁকড়া, শামুক, ঝিনুকসহ নানা জলজপ্রাণীও পাওয়া যেতো। পানি শুকিয়ে যাওয়ায় এখন কোনোকিছুই পাওয়া যায় না।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক ব্যক্তি জানান, ঝিরি-ঝরনা পানিশূন্য হওয়ার পেছনে জুমচাষের জন্য জঙ্গল পরিষ্কারের নামে পাহাড়ে আগুন দিয়ে গুল্ম থেকে বিভিন্ন গাছ-গাছালি পোড়ানো, কলাগাছ নিধন, ব্যবসায়িক স্বার্থে জোত পারমিটের নামে নির্বিচারে বন উজাড় করা অনেকাংশে দায়ী।

পার্বত্য চট্টগ্রাম বন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলন বান্দরবান চ্যাপ্টারের সভাপতি জুয়ামলিয়ান আমলাই। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, সাধারণত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝিরি-ঝরনা ও নদ-নদী পানিশূন্য হওয়ার কারণ মনে করলেও মানুষসৃষ্ট সমস্যাগুলো এর অন্যতম কারণ।

তিনি বলেন, পাথরকে ‘পাহাড়ের প্রাণ’ হিসেবে বিবেচনা করা হলে গাছকে সঞ্চালনকারী হিসেবে আখ্যা করা হয়। প্রচলিত আছে ভূগর্ভস্থ পানির স্থর থেকে সর্বনিম্ন ১০০ ফুট গভীর পর্যন্ত পানি শোষণের ক্ষমতা রাখে পাথর। গাছের মূল সেই পানিকে নিজে শোষণের পাশাপাশি মাটির বিভিন্ন স্তরে সঞ্চার করে। প্রাণ (পাথর)-সঞ্চালন (গাছ) না থাকলে নির্জীব মরুভূমি ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। উন্নয়নের নামে অবাধে পাথর উত্তোলন, জোত পারমিটের নামে বৃক্ষনিধন ঝিরি-ঝরনা শুকিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ।

এ বিষয়ে বান্দরবান বনবিভাগীয় কর্মকর্তা হক মহবুব মোরশেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘গ্রীষ্মকালে ঝিরি-ঝরনাগুলো কিছুটা শুকিয়ে যায়। তবে অতিমাত্রায় শুকিয়ে যাওয়ার বেশকিছু কারণও রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘সাধারণত বৃষ্টির মৌসুমে প্রবাহিত পানিকে পাথর, গাছপালা, গুল্মসহ কয়েকটি মাধ্যমে ধারণ করে রাখে পাহাড়। যা গ্রীষ্ম মৌসুমে বিন্দু বিন্দু করে প্রবাহিত হয়ে ঝিরি থেকে ঝরনায় গিয়ে মিলিত হয়। পানি ধারণ করে রাখার মাধ্যমগুলো ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাওয়ায় এ সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে বলে ধারণা করা যায়।’

বান্দরবানের সার্বিক পরিস্থিতি ও বড় মাদকের ওপর বিজিবি নজর না দেওয়ায় নিরাপত্তাহীনতার অভাবে শতভাগ রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না জানিয়ে বনবিভাগীয় এ কর্মকর্তা বলেন, ‘বান্দরবানে রিজার্ভ ফরেস্ট এলাকাগুলো এখন ডি ক্যাটাগরির বনাঞ্চলে রূপ নিয়েছে। এছাড়া বান্দরবানের বেশিরভাগ জায়গা লিজ দেওয়া। ব্যক্তিমালিকানাধীন হওয়ায় তারা আম, লিচু, কাজুবাদাম, কুলসহ নানা ফলদ বাগানের আবাদ করছেন। এতে মাটির রক্ষা আবরণ (ঘাস, গুল্ম ইত্যাদি) চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে করে মাটির উর্বরতা হ্রাস, ভূমিক্ষয়সহ নানা হুমকিতে পড়বে পরিবেশের ভারসাম্য।’

বন ও বন্যপ্রাণীর খাদ্য নিশ্চিত করতে জোত পারমিটে ২৫ শতাংশ বনজ ও বন্য ফলদগাছ লাগানোর জন্য নির্দেশনা উল্লেখ করা থাকলেও জনবল স্বল্পতার কারণে শতভাগ তদারকি করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান বনবিভাগীয় কর্মকর্তা হক মহবুব মোরশেদ।

এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সহায়তায় স্ট্রেনদেনিং ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্ট ইন চিটাগং হিল ট্রাক্টস (এসআইডি-সিএইচটি) প্রকল্পের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ঝিরি-ঝরনায় পানি সংরক্ষণ করে রাখতে ওয়াটার সেট নির্মাণসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।

নয়ন চক্রবর্তী/এসআর/জেআইএম